আত্মহত্যা তো শুধুমাত্র মারা যাওয়ার ইচ্ছে, তাই না?
অনুভূতিগত যন্ত্রণার কারণে মানুষের মনে যে বেদনার জন্ম হয় তার ফলেই সে আত্মহত্যার চিন্তা করে। তারা চায় যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে এবং সেজন্য তখন তারা মৃত্যুর পথই বেছে নেয়। আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে মানুষের মনের একাকিত্ব, হতাশা, অসহায়তা প্রভৃতি প্রকাশ পায় এবং এসবের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তাদের মনে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও চিন্তাভাবনা দেখা দেয় না।
কাউকে দুর্দশাগ্রস্ত দেখে যদি আমি তার জীবনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করি তাহলে কি আমি তার মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছি বলে মনে হবে?
কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে সে আত্মহত্যা করার কথা ভাবছে কিনা, তাহলে তার মানে এই নয় যে তার মাথায় আত্মহত্যার কথা ঢোকানো হচ্ছে। অন্যদিকে, কাউকে জিজ্ঞাসা করলে তাকেও তার সমস্যা বা দুর্দশাকে স্বীকার করার একটা সুযোগ করে দেওয়া যাবে এবং সে কী অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে সেকথাও সে অপরকে মন খুলে বলতে পারবে। নিউ ইয়র্কে দু'হাজারের বেশি কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে তাদের মনে আত্মহত্যার চিন্তা দেখা দিচ্ছে কিনা তা জানতে চাওয়ার ফলে তাদের মনে আদৌ অনুভূতিগত সমস্যা বা আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়নি। এমনকী, অবসাদগ্রস্ত ছাত্র-ছাত্রী বা যাদের মধ্যে অবসাদের ঝুঁকি রয়েছে তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার চিন্তা জেগে ওঠেনি।
আত্মহত্যার চিন্তার মধ্য দিয়ে মানুষের মনে মৃত্যুর ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে- এক্ষেত্রে আমি এমন কিছু কি করতে পারি যার ফলে তার মানসিকতার বদল ঘটতে পারে?
আত্মহত্যার চিন্তার মধ্য দিয়ে মানুষ তার মনের যন্ত্রণা বা বেদনার অবসান করতে চায় এবং সেক্ষেত্রে যে তার মরে যাওয়ার ইচ্ছে হবেই তেমন নয়। আত্মহত্যার মতো পদক্ষেপ করার পরেও বেঁচে ফেরা এমন অনেক মানুষ জানিয়েছে যে গোল্ডেন গেট ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক পরেই তাদের এই কাজের জন্য নিজেদের মনে দুঃখ বোধ জেগেছে।
আত্মহত্যার ভাবনাকে মানুষে প্রায়শই প্রকাশ করেন বা নিজের মন থেকে আত্মহত্যার চিন্তা দূর করার জন্য বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সাহায্যের সঙ্গে একজন দ্বাররক্ষীর হস্তক্ষেপ (গেটকিপার ইন্টারভেনশন)-এর বিষয়টি আমাদের জানা আছে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা অবশ্যই সম্ভব - চূড়ান্ত বিপদের বিরুদ্ধে সতর্ক থেকে ও আত্মহত্যাকে অবশ্যম্ভাবী মনে না করে।
আমি কীভাবে বুঝব যে চিন্তাটি (''আমি আর নিতে পারছি না'') হতাশা বা ব্যর্থতাজনিত, নাকি এর পেছনে অন্য গুরুতর কারণ রয়েছে?
সব মানুষই আত্মহত্যার চিন্তা করা মাত্রই যে আত্মহত্যার পদক্ষেপ করে তা নয়। এক্ষেত্রে আত্মহত্যার চিন্তা সত্যিই সাংঘাতিক বিপদ বা সংকট ডেকে আনছে কিনা তা বোঝার জন্য তিনটি উপাদান বা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, যেমন- বারবার ঘটনা ঘটা, ঘটনার প্রাবল্য এবং নিয়ন্ত্রণ।
আত্মহত্যার চিন্তা যদি বারবার মনে আসে এবং তা যদি তীব্র চিন্তা হয় ও সেখানে যদি মনের কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল হয়। এছাড়াও ঘটনাটি যদি সুপরিকল্পিত এবং সুষ্ঠভাবে ঘটানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে তা জরুরি অবস্থার মতোই একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
যদি আপনি শোনেন যে কোনও ব্যক্তি তার মনের হতাশা প্রকাশ করছে বা তার জীবনের সবকিছু শেষ করে দিতে চাইছে তাহলে তিনটি প্রশ্নের মাধ্যমে আপনি বোঝার চেষ্টা করতে পারেন যে ওই ব্যক্তিটি কতখানি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে:
আপনার মধ্যে কি প্রায়শই এই চিন্তা দেখা দিচ্ছে?
আপনি কি আত্মহত্যার চিন্তা মন থেকে দূর করে তার বদলে অন্য চিন্তা করতে সক্ষম হচ্ছেন না হচ্ছেন না?
আপনার মনে যখন আত্মহত্যার চিন্তা আসে তখন নিজের মনের উপরে কতখানি নিয়ন্ত্রণ থাকে? আপনি কি সেই চিন্তাকে অতিক্রম করতে পারেন নাকি আপনার মধ্যে একপ্রকার অসহায়তার বোধ জাগে?
এক্ষেত্রে একটা বিষয় মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে একজন মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করার ঝুঁকি থাকুক বা না-থাকুক, আত্মহত্যার চিন্তা সাধারণত মানুষের মনের বা অনুভূতির দুর্দশাকেই প্রকট করে তোলে। একজন প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ মানুষের মনের এই দুর্দশার সঠিক বিচার করেন এবং তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করে থাকেন। যদি আপনি জানতে পারেন যে কোনও একজন মানুষের মনে আত্মহত্যার চিন্তা দেখা দিয়েছে তাহলে তাকে আপনি একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় সাহায্য নেওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে পারেন।
আমি কি সত্যি আত্মহত্যার ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারব?
একজন মানুষ যে আত্মহত্যার চিন্তা করছে তার সঙ্গে যদি বিশ্বাস, ভরসা এবং সমানুভূতি নিয়ে কথা বলা যায় তাহলে তারা তাদের জীবন শেষ করে দেওয়ার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিষয়টি নিয়ে তারা আবার খতিয়ে দেখার চেষ্টা করতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে যে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছে তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতার দিকটিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ না হন তাহলে প্রাথমিকভাবে তার সঙ্গে কথা বলে তাকে একজন প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সুপারিশ করুন, যিনি ওই ব্যক্তিকে তার মানসিক দুর্দশার মোকাবিলা করতে যথাযথ সাহায্য করবেন। এভাবে দ্বাররক্ষী বা গেটকিপার হিসাবে আপনি ওই ব্যক্তিকে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারেন। এছাড়াও আর কোনওভাবে আপনি তাকে সাহায্য করতে পারেন কিনা সে বিষয়টিও আপনি জানার চেষ্টা
করতে পারেন।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে সেটি হল কোনও গেটকিপারই একজন আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানুষের চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়বদ্ধ নয়। গেটকিপারের কাজ হল, যে মানুষটি আত্মহত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে তাকে সেই পথ থেকে সরিয়ে, সঠিক দিশা দেখানোর জন্য একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সাহায্যের ব্যবস্থা করা। আত্মহত্যাকারীকে তার জীবনের সব বাধার মোকাবিলা করতে সক্ষম করে তোলাটা একজন গেটকিপার নিশ্চিত করতে পারে না; গেটকিপার আসলে একজন আত্মহত্যাকারী মানুষ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করে। আর একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানুষটির মানসিক স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।
এই বিষয়ে আরও জানতে পড়ুন:
এই প্রবন্ধটি লিখতে সাহায্য করেছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডঃ দিব্যা কান্নান; ফর্টিস হেলথকেয়ারের মানসিক স্বাস্থ্য এবং বিহেভায়রল বিজ্ঞান বিভাগের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান কামনা ছিব্বর; দ্য অল্টারনেটিভ স্টোরির প্রতিষ্ঠাতা এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট পারাস শর্মা; এবং দি টকিং ক্যাম্পাস-এর সাইকোথেরাপিস্ট সেহেরাজাদি সঞ্চিতা সিওভান।