যখন কোনও একটি পরিবারের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তখন আত্মীয়পরিজনের মনোবল ভেঙে পড়ে। ওই পরিস্থিতিতে তাঁদের মনে জমে থাকা দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, উত্তরহীন প্রশ্ন এবং বহু ভাবনাচিন্তা ভিড় করে আসে। 'কেন আমার জীবনে এমন ঘটল?' বা 'আমি কি আমার প্রিয়জনকে অবসাদ থেকে বের করে আনতে সক্ষম হলাম না?' অথবা 'আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটবার আগে কেন আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না?' কিংবা 'আমি ভাল মা বা বাবা হতে পারলাম না'-- আত্মঘাতীর পরিবারের লোকদের মুখে প্রায়শই এহেন ক্ষোভ বা আফশোস শোনা যায়। যে কোনও আত্মহত্যার ঘটনা কম করে ছয় জন মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। এদের মধ্যে পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, প্রতিবেশী, সহপাঠী বা বন্ধুবান্ধব- যে কেউ থাকতে পারে।
এহেন পরিস্থিতিতে পরিবারের মানুষজন এতটাই শোকাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে, সেখানে একপ্রকার গভীর শূণ্যতার জন্ম হয়। কখনও এককভাবে বা কখনও সংঘবদ্ধভাবে শোকের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই অবস্থা সাময়িকভাবে বা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। তবে এদের প্রত্যেকেরই এই সময় মনের ক্ষত সারানোর জন্য শেষ থেকে শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।
আঘাত: আত্মহত্যার ঘটনার ফলে পরিবারের সদস্যরা এমনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন যে তাঁরা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে অসাড় হয়ে পড়েন।
রাগ: মানুষের চরিত্রে রাগ এমন একটি রিপু, যা অমূল্য জীবনকে এক নিমেষে মূল্যহীন করে দেয়। পরিবারের সদস্য বা কোনও প্রিয়জনের রাগ অথবা ক্রোধ কোনও ব্যক্তির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। এই রাগ পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা কর্মজগতে সহকর্মীর উপরেও প্রভাব বিস্তার করে।
অপরাধ বোধ: আত্মহত্যার পরে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কারণ অনুসন্ধানের জন্য তৎপরতা দেখা যায়। কী করলে এই আত্মহত্যার ঘটনা ঠেকানো যেত- এই সব প্রশ্ন তুলে নিজেকে দোষ দেওয়ার পালা শুরু হয় এই সময়। ফলে অন্তরের স্বাভাবিক স্নেহ, ভালবাসার মতো দিকগুলি অগোচরে থেকে যায়।
ভয়: পরিবারের একজন সদস্যের আত্মহত্যার ঘটনা অন্যদেরকেও প্ররোচিত করে।
অবসাদ: এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে অনিদ্রা, খিদে কমে যাওয়া, ক্লান্ত বোধ করা বা জীবন থেকে সমস্ত আনন্দের অনুভূতিগুলিকে হারানোর মতো বিষয়গুলির মধ্যে দিয়ে।
অধিকাংশ নেতিবাচক অনুভূতি মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। যদিও এমন কিছু অনুভূতি রয়েছে যেগুলির ক্ষেত্রে এই সত্যটি খাটে না। আর শোকের বহিঃপ্রকাশ এক-এক জনের কাছে এক-এক রকম। এই বিষয়ে এমন কিছু প্রশ্ন থাকে, শত খুঁজলেও যার উত্তর পাওয়া যায় না।
আত্মহত্যার পরে পরিবারের করণীয় কাজগুলি হল -
দুঃখ হলে স্বাভাবিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এই ক্ষেত্রেও তেমনই হওয়া উচিত।
না-জানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় দিতে হবে। যদি কোনও প্রশ্নের আংশিক উত্তরও পাওয়া যায় তাহলে সেটিকেই মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
এই সময় পরিবারের সদস্যদের মিলেমিশে থাকা প্রয়োজন। কোনও প্রিয়জনের আত্মহত্যার ঘটনার পর প্রথম ছয় মাস পরিবারের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চলতে হবে। নিজেদের অনুভূতিগুলির আদান-প্রদান এই সময় খুবই জরুরি। এর জন্য নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি আলোচনা করা দরকার।
বাড়ির বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তাদের শিশু মনে যাতে আত্মহত্যার ঘটনা গভীর ছাপ না ফেলে সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে তারা পরিবারের কাছ থেকে অনেক ভালবাসা, স্নেহ পাওয়ার আশা করে। তাই বাচ্চাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো প্রয়োজন।
ছুটির দিন, কারও জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর মতো জীবনের বিশেষ দিনগুলি এই সময় আত্মঘাতীর পরিবারের মানুষের উপর প্রায় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই দিনগুলিতে নিজেদের কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। পারলে সকলের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে।
ক্ষত সারাতে সময় দিতে হবে। কারণ সময়ের সঙ্গে সব কিছুই ঠিক হয়ে যায়। দুঃখ কখনও চিরস্থায়ী হয় না। তবে ক্ষত সারানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ধৈর্যশীল হওয়াটা জরুরি। অন্যান্যদের এটা বোঝানোর দরকার নেই যে, আপনি ঠিক কোন অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছন। একই সঙ্গে অন্যান্যদেরও নিজের মতো করে শোক কাটিয়ে উঠতে হবে।
এই ক্ষেত্রে সব সময়েই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াটা একান্ত দরকার।
ডা. মনোজ শর্মা নিমহান্সের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
এই বিষয়ে আরও তথ্য জানতে যোগাযোগ করতে হবে নিমহান্স সেন্টার ফর ওয়েল বিইং (এন সি ডব্লিউ বি)। ফোন নং- ৯১৯৪৮০৮২৯৬৭০ বা (০৮০) ২৬৬৮৫৯৪। যোগাযোগের সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪.৩০।