নিজের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন এমন কারোর সাথে দেখা হলে অনেক সময়ই আমরা দিশেহারা, শোকাহত বা উদ্বিগ্ন বোধ করি। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকলে কথা বলতে সুবিধা হয়।
১. শুধু শুনুন। প্রিয়জনের শোকে ব্যাকুল এক ব্যাক্তি শুধু মন খুলে একটু কথা বলতে চান। আপনি তাঁর সম্পর্কে সব কিছু নাই জানতে পারেন, বা তাঁর সমস্যার সমাধানও হয়ত আপনার দ্বারা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তা সত্বেও কোনও উপদেশ পরামর্শ ছাড়াই তাঁর কথা শোনা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আপনি বলতে পারেন, “আমি ভাবতেও পারছিনা যে তুমি কী করে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করছ! কিন্তু একটা কথা মনে রেখো যে আমি তোমার পাশে আছি, তোমার কথা শুনছি!”
২. আপনার পুরো পরিস্থিতিটা আদৌ জানা দরকার কি না সেটা ভেবে দেখুন। মানুষের স্বাভাবিক ধর্মই হল অন্যের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করার চেষ্টা করা যাতে সেই বিষয়ে তাঁর পক্ষে কোনও সহায়তা বা পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তির পরিবারের খুব নিকট কোনও সদস্যের পক্ষে সেই বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব না কারণ তাঁদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর এবং তাঁদের সমবেদনার প্রয়োজন পড়ে। এই নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া আকস্মিক মৃত্যুকে ঘিরে তাঁদের যন্ত্রণা এবং অসহায়তা বোধ কে বাড়িতে তোলে। তাই বিস্তারিত ভাবে কিছু জানার থাকলে এমন কারো সাথে কথা বলুন যিনি মৃত ব্যক্তির সাথে সরাসরিভাবে জড়িত ছিলেন না। যেমন কম ঘনিষ্ট কোনও বন্ধু বা আত্মীয়-স্বজন।
৩. তাঁদের মন খুলে কথা বলার সুযোগ দিন। তাঁরা যতটা যা বলতে চাইছেন সেটা প্রথমে মন দিয়ে শুনুন। জরুরী নয় যে সেটা এই আত্মহত্যাকে ঘিরে কোনও কথা হবে। অযথা তাঁদেরকে বিশদ বিবরণ দিতে বলবেন না। কেউ কেউ হয়ত তাঁদের মানসিক অবস্থার কথা বারবার বলতে চাইবেন, কেউবা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইবেন। ব্যক্তিবিশেষে নিজেদের মানসিক অবস্থার প্রকাশভঙ্গি আলাদা হয়।
৪. তাঁদের কষ্টটা যে স্বাভাবিক সেটা বুঝতে দিন। প্রিয়জনের আত্মহত্যার ঘটনার সাথে সাধারণত মানসিক কুন্ঠা জড়িয়ে থাকে, ফলে তাঁদের এটা বুঝতে দেওয়া প্রয়োজন যে এই সময় বিলাপ করা বা মৃত ব্যক্তির ওপরে রাগ হওয়াটাও স্বাভাবিক ব্যাপার। একেকজনের মানসিক শোকের প্রকাশ একেক রকমভাবে হয়, এবং এটাই স্বাভাবিক। প্রয়োজনে তাঁদের বোঝান যে কষ্ট চেপে না রেখে, কাঁদলেও অনেকটাই হালকা অনুভব করা সম্ভব।
৫. তাঁদের বোঝান যে এই মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে তাঁদের কোনও দোষ নেই। তাঁদের নিজের প্রিয়জনকে না বাঁচাতে পারার লজ্জা বা অপরাধবোধ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করুন।
৬. মনে রাখবেন তাঁদের সরিয়ে তোলা আপনার কাজ নয়। আপনি যদি নিজে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ না হন, তাহলে হয়ত তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না। তার চেয়ে বরং আপনি তাঁদের দিকে ভালবাসা, যত্ন ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিন। যদি নিজেকে মানসিকভাবে বিহ্বল মনে হয়, তাহলে ভরসাযোগ্য নিকট কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে অথবা হেল্পলাইনে যোগাযোগ করুন।
৭. প্রয়োজনে তাঁদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করতে বলুন। আপনি যদি লক্ষ্য করেন যে তাঁরা মানসিক ভাবে বিহ্বল হয়ে পড়ছেন, তাহলে সন্তর্পনে তাঁদের একজন কাউন্সেলারের সাথে অথবা হেল্পলাইনে কথা বলতে বলুন।
কী বলবেন না:
“এ বাবা! আমি ভাবতেও পারিনি যে উনি মৃত্যুর পথ বেছে নেবেন।”
“অন্তত উনি এখন ভালো আছেন।”
“কি হয়েছিল, বল তো? কেন করলেন উনি এ’রকম?”
“তুমি কি সত্যি কিছু টের পাওনি আগে?”
“আপনি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন?”
“আপনি নিশ্চিত যে ওঁনার কোনও মানসিক সমস্যা ছিল না?”
“চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে!”
নিজের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন এমন কারোর সাথে কথা বলার সময়, ভালোমনেও এই ধরণের কোনও মন্তব্য বা প্রশ্ন করা উচিৎ নয়। মনে রাখবেন, আত্মহত্যার কারণে যিনি নিজের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, এবং তিনি গভীর মানসিক বেদনা, আতঙ্ক, লজ্জা ও গ্লানি অনুভব করছেন।
কামনা ছিব্বর, কনসালট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও মনোবিভাগ প্রধান, মনোরোগ ও আচরণবিজ্ঞান বিভাগ, ফর্টিস হেলথকেয়ার এবং তনুজা বাবর, প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট, আইকল সাইকোলজিক্যাল হেল্পলাইন -এর সাথে আলোচনার পরে।