লজ্জা এমন এক আবেগ যা আপনার অন্তরাত্মাকে কুরে কুরে খায়।
- কার্ল জাং
আমার স্বামী আত্মহত্যার করার আগে অবধি আমি ভাবতাম এটা শুধু অন্যদের সাথেই হয়। স্বপ্নেও ভাবিনি কখনও যে আমার সাথে, আমার পরিবারের সাথে এই ধরনের কিছু ঘটতে পারে। আত্মহত্যার সাথে আমার পরিচয় ছিল খবরের শিরোনামে, আর আমার স্কুলের এক ঘনিষ্ট বন্ধুকে দিয়ে যার মা-বাবা আত্মহত্যা করেছিল। তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম, তাও স্পষ্ট মনে আছে যে আমার আশেপাশে কেউ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করত না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আত্মহত্যা একটা লজ্জার বিষয়।
নিয়তির এমনই পরিহাস, যে আমার স্বামী যখন আত্মহত্যা করলেন তখন আমাকেও এই লজ্জা ঘিরে ধরেছিল। নিজের পরিবারকে কী বলব? নিজের বন্ধু-বান্ধবদের কী বলব? তারা কি আমার স্বামীকে অপরাধী ভাববে? তারা কি ভাববে না যে স্ত্রী হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ? আমি মাথা খাটিয়ে দুই রকম বয়ান ভাবলাম: একটা যেটা মোটামুটি সবাইকে বলব (দীর্ঘ অসুস্থতা, অকস্মাৎ মৃত্যু বা এমন কারণ যা মেনে নেওয়া সহজ) আর একটা আসল কারণ (আত্মহত্যা)। পরিস্থিতি ও লোক বুঝে আমি ঠিক করব যে যে কাকে কোনটা বলা যায়।
অতীতের দিকে ফিরে দেখলে আজ বুঝতে পারি যে অধিকাংশ পরিবারই যারা কোনও নিকট সদস্যকে আত্মহত্যায় হারিয়েছেন বা প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই এই লজ্জার শিকার। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। কিন্তু কীভাবে আমি এর ‘শিকার’ হলাম? আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা আমাদেরকে শেখায় যে আত্মহত্যা হল দণ্ডনীয় অপরাধ ও মহাপাপ। উদাহরণস্বরূপ মধ্যযুগে ইউরোপ কেউ আত্মহত্যা করলে তাকে কবর দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না, তাঁর পরিবারকে সমাজ থেকে বহিস্কার করা হত এবং তাঁর সম্পত্তি অধিগ্রহন করা হত। বর্তমানে সমাজ এতটা নিষ্ঠুর না হলেও সেই লজ্জার সাবেকি ধারা আজও কোনও না কোনও রূপে আমাদের মাঝে বয়ে চলেছে। সমাজে আত্মহত্যাকে আজও মেনে নেওয়া হয় না কারণ একে চারিত্রিক বা নৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়।
এই কুণ্ঠা আসলে কলঙ্কের। এতে লজ্জা পাওয়ারই কথা। এই কুণ্ঠা জন্ম নেয় বৃহত্তর সমাজে মনোরোগ বা আত্মহত্যা নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির থেকে। একেই বলে সামাজিক কুণ্ঠা। পাশাপাশি নিজস্ব কুন্ঠার কারণে আত্মহত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এই লজ্জা, অভিযোগ ও উপদেশ চুপচাপ মেনে নিতে থাকেন।
এই সামাজিক কুণ্ঠা থেকেই জন্ম নেয় আত্মহত্যা সম্পর্কে নেতিবাচক ও ভ্রান্ত ধারণা। সাধারণত এই রকম পরিস্থিতিতে লোকে মৃত ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারকেই দোষারোপ করে। কিন্তু তারা যেটা উপলব্ধি করেন না সেটা হল যে আত্মহত্যার পথ মানুষে বিভিন্ন কারণে বেছে নেয় এবং তার সাথে “জড়িত মানসিক কষ্ট কোনও রোগভোগের চেয়ে কম নয়।” স্বাভাবিক রোগভোগে মৃত্যু হলে কি আমরা পরিবার পরিজনদের দোষারোপ করি? তাহলে আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা কেনও “আগে থেকে টের পাওনি” বা “কিচ্ছু বোঝা যায়নি”র মতন প্রশ্ন করব?
নেতিবাচক মানসিকতা বিভিন্ন ভাবে আসতে পারে: পরচর্চা, উদ্ভট আন্দাজ, অহেতুক প্রশ্ন, গণমাধ্যমে নিন্দা, অমানবিকতা, সমাজে এক ঘরে করে দেওয়া, মৃত ব্যক্তি ও তার পরিবারের পরিচয় প্রকাশ করে সমালোচনা। তার চেয়েও মারাত্মক হল আত্মহত্যাকে ঘিরে ‘নীরবতার দেওয়াল’ যা আমাদেরকে শেখায় যে এই ধরনের মৃত্যু সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্তরে নিষিদ্ধ, যা নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন, বরং একে গোপন রাখাই বাঞ্ছনীয়।
এরকম এলোপাথাড়ি কথাবার্তায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে এগোয় এবং সংশ্লিষ্ট পরিবারের মানসিক কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ ও যন্ত্রণা গুনিতকের হারে বৃদ্ধি পায়। সামাজিক কুণ্ঠা থেকে ধীরে ধীরে বিষয়টা ব্যক্তিগত কুণ্ঠায় পরিবর্তন হয় যা ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে, এবং গ্লানিবোধ ও নিজেকে দোষারোপ করার প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে। এই সব কিছুর প্রভাব সার্বিক স্বাস্থ্যের উপরেও পরে।
অন্ধকার এবং স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় যেমন ছত্রাক বৃদ্ধি পায়, তেমনই অজ্ঞানতা, ভয় এবং গৎবাঁধা নেতিবাচকতার আঁধারে আত্মহত্যা নিয়ে কুন্ঠা, লজ্জা, গোপনীয়তা ও নীরবতা বৃদ্ধি পায়। লেখিকা ম্যাগি হোয়াইট লজ্জা ও কুণ্ঠার নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে নিপুণ ভাবে বলেছেন: “নিজেকে নিয়ে কুণ্ঠাই আদতে লজ্জার জন্ম দেয়। এবং লজ্জা ও কুণ্ঠার এই করাল তান্ডব নৃত্য যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।” এ যেন সেই চিরন্তন ডিম-মুরগির ধাঁধা। যে কে আগে এল? যাই হোক সে প্রসঙ্গ আলাদা।
আত্মহত্যা এমন এক জনস্বাস্থ্য সমস্যা যা এড়ানো সম্ভব। ভৌগলিক সীমানা ও ব্যক্তি নির্বিশেষে যে কেউ এর শিকার হতে পারেন। এর জন্য সমাজের মূলস্রোতে আত্মহত্যা নিয়ে দায়িত্ব, যত্ন ও সমবেদনার সাথে আলোচনা প্রয়োজন। সমাজের সবাই একত্র হলে তবেই আমরা পারব আত্মহত্যা নিয়ে নীরবতার দেওয়াল ভেঙে সাহায্য ও সহমর্মিতার সেতু গড়তে। আত্মহত্যা এড়ানো সবার দায়িত্ব, কারণ প্রত্যেকের স্বার্থই এর সাথে জড়িত।
ডঃ নন্দিনী মুরলী পেশাদারী ভাবে যোগাযোগ, লিঙ্গ এবং বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন। সম্প্রতি নিজের প্রিয়জনকে আত্মহত্যায় হারানোর পর তিনি এম এস চেল্লামুথু ট্রাস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডেশনের সাথে হাত মিলিয়ে স্পিক নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেন, যার মূল উদ্দেশ্য হল আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা।