আমাদের আশেপাশে ঘটতে থাকা বিভিন্ন ঘটনা ও অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা ও বিশ্বাস গড়ে ওঠে, যা আমাদের ভাবাবেগ ও আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। সুতরাং আমাদের মানসিকতার সাথে আমাদের আচরণ জড়িত।
আমরা যখন ভারাক্রান্ত থাকি তখন আমাদের মাথা কাজ করে না, আমরা অনেক সময় বিপদের মুহুর্তে ভুল সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলি। এর ফলে আমাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত উভয় দিকেই প্রভাব পড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, হতাশাগ্রস্ত একজন ব্যক্তির নিজের আশেপাশে কিছুই ভাল লাগে না। সে সময় তাঁর মনোবল বাড়ানো গেলে, তাঁদের জীবন ও মানসিকতায় উন্নতির পাশাপাশি চারপাশের জগত সম্পর্কে তাঁর ধারণাও পাল্টে দেওয়া সম্ভব।
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বা সিবিটি কী?
মনোরোগের চিকিৎসায় বহুল চর্চিত এবং প্রচলিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হল কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি। এটি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি যাতে বিভিন্ন ধরনের আবেগ ও আচরণগত বিকারের চিকিৎসা সম্ভব। হতাশা বা দুশ্চিন্তার মত মানসিক সমস্যার চিকিৎসায় সিবিটি ওষুধের কার্য্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।
সিবিটি'র সাহায্যে একজন ব্যক্তির অসংলগ্ন চিন্তা ধারাকে বোঝা সম্ভব। এই সময় চিকিৎসক ব্যক্তিকে বিভিন্ন গঠনমূলক কাজ শিখতে সাহায্য করেন, যা পরবর্তীকালে যুক্তিবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এই চিকিৎসার লাভ দীর্ঘস্থায়ী এবং এখানে শেখা জিনিস জীবনের যে কোনও স্তরে কাজে লাগানো যেতে পারে।
নিম্নলিখিত মানসিক ব্যাধিতে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি ব্যবহার করে আশাতীত সুফল পাওয়া গেছে:
মনোবিকার যেমন ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, ইটিং ডিসঅর্ডার পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এবং মাদকাসক্তি।
বিঃদ্রঃ বাইপোলার এবং স্কিৎজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে, সিবিটি'র পাশাপাশি ওষুধপত্র চালিয়ে যেতে হবে।
বিভিন্ন অসুস্থতা যেখানে অত্যধিক যন্ত্রণা, ক্লান্তি, প্রি-মেন্সট্রুয়াল সিন্ড্রোম, মস্তিষ্কে আঘাত, ওজন বেড়ে যাওয়া, আতঙ্ক, সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডার।
অত্যাধিক রাগ, দুশ্চিন্তা, জুয়ার নেশা, ইত্যাদি।
শিশুদের মধ্যে হতাশা বা দুশ্চিন্তা বা অন্যান্য আচরণগত সমস্যা।
মানসিক চাপ, উদ্বেগ, হীনমন্যতা, নিদ্রা বিকার, প্রিয়জনকে হারানোর শোক, বার্ধক্যজনিত সমস্যা।
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি করালে কী লাভ?
এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে চিকিৎসক কথা বলার মাধ্যমে ব্যক্তিকে জ্ঞ্যান, আচরণ, ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখান। এর ফলে তাঁরা জীবনে যাবতীয় সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত ভাবে নিতে শেখেন।
সিবিটি'র কিছু সুফল:
ব্যক্তি মন খুলে সমস্ত কথা জানাতে পারেন।
সিবিটি অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গেও চালিয়ে যাওয়া যায়।
ব্যক্তির সক্রিয় যোগদানের ফলে চিকিৎসা থেমে যাওয়ার ভয় থাকে না।
ব্যক্তির মানসিকতার উপরে নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতিতে সহজেই অদল-বদল করা যায়।
সিবিটি’তে কি ধরনের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করা হয়?
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি একটি সক্রিয় এবং লক্ষ্য নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি যাতে ব্যক্তি নিম্নলিখিত জিনিসগুলিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন:
নিজের ভাবাবেগ বুঝে সুস্থ এবং অসুস্থ মানসিকতাকে আলাদা করতে শেখা।
অসংলগ্ন চিন্তার ফলে মানসিক যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায় তা বোঝা
অসুস্থ চিন্তাকে কাটিয়ে সুস্থ এবং গঠনমূলক চিন্তা আনার পদ্ধতি শেখা
ছোটখাট সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে শেখা।
যে সমস্ত বিশ্বাসের কারণে যাবতীয় সমস্যার উৎপত্তি তাকে কাটিয়ে ওঠা।
সিবিটি কিভাবে কাজ করে?
সিবিটি’র মূল উদ্দেশ্যই হল অসংলগ্ন চিন্তাকে সরিয়ে সংলগ্ন চিন্তাকে আনা।
চিকিৎসক প্রথমে ব্যক্তির মানসিকতা, বিশ্বাস, এবং অস্বাভাভিক চিন্তাগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন; যা থেকে তাঁর মনে নিজের এবং চারপাশ সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা জন্মাচ্ছে। তারপর সেগুলির কারণ বোঝার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ একজন হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যে কিভাবে তিনি শুধু নেতিবাচক দিকটাই বারংবার দেখছেন, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে ভাবছেন, নিজের দোষ দেখছেন, ইত্যাদি।
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি একটি স্বল্প সময়ের চিকিৎসা পদ্ধতি যার মধ্যে নিম্নলিখিত কৌশলগুলি পড়ে:
প্রথমেই থেরাপিস্ট রোগীকে পরীক্ষা করে তাঁর চিকিৎসার ইতিহাস ও পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেন। এর দরুন তিনি রোগীর সমস্যার ব্যাপারেও বিস্তারিত ভাবে জেনে নেন
এর পরে চিকিৎসক রোগীকে সিবিটি সম্পর্কে সব কিছু বুঝিয়ে বলেন। কি কি ক্রিয়াকলাপে তাঁকে যুক্ত করা যেতে পারে এবং তাতে রোগীর কিভাবে লাভ হবে তা বলা হয়।
এরপরে চিকিৎসক রোগীকে সিবিটি'র মেয়াদ, পরের সেশনের সময়, রোগীর ভূমিকা ইত্যাদি বুঝিয়ে বলেন।
তারপরে চিকিৎসক রোগীকে তাঁর উপসর্গের ব্যাপারে বুঝিয়ে বলেন (উদাহরণ: অ্যাংজাইটির সাথে হার্ট অ্যাটাকের পার্থক্য, রোগের উপসর্গ সম্পর্কে বোঝা)
চিকিৎসক সিবিটি চলাকালীন রোগীর লক্ষ্যগুলিকে ঠিক করে নেবেন।
সব মিটে যাওয়ার পরে চিকিৎসক রোগীর নেতিবাচক চিন্তার মূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন।
চিকিৎসক ও রোগী দুজনে একত্রে চিন্তাভাবনা করে সমস্যার সমাধান বের করার চেষ্টা করবেন। ব্যক্তি সমাধানের রাস্তাগুলি একবার পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি ব্যক্তি অত্যন্ত রাগী হন, তাহলে প্রথমে তাঁর রাগের কারণ জানতে হবে। কী রকম পরিস্থিতিতে তিনি রেগে যান। তারপরে তাঁকে ঠাণ্ডা মাথা যুক্তি সঙ্গত উপায়ে শান্ত থাকতে শেখানো হবে।
চিকিৎসাকালীন কার্যকলাপ
থেরাপি চলাকালীন ব্যক্তিকে নিজের নেতিবাচক মনোভাব চিনতে শেখানো হয়।
তাঁদের চিন্তাধারায় বদল এনে, গঠনমূলক এবং যুক্তিবাদী হতে শেখানো হয়।
মানসিক উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখানো হয়।
নেতিবাচক কোনও চিন্তা এলে ব্যক্তিকে সেই ব্যাপারে একটি ডাইরিতে লিখে রাখতে বলা হয়।
তাঁদেরকে বাড়িতে বিভিন্ন চালচলন ও কাজ অভ্যাস করতে দেওয়া হয়।
চিকিৎসক নিয়মিত রোগীর পরীক্ষা করে তাঁর মানসিক উন্নতি সম্পর্কে সুনিশ্চিত হন।
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি কারা করতে পারেন
একজন অভিজ্ঞ থেরাপিস্ট যেমন সাইকোলজিস্ট, সাইকায়াট্রিস্ট, বা একজন সমাজসেবী যিনি কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তিনি এই চিকিৎসা করতে পারেন; কিন্তু তাঁকে কোড অফ এথিকস মেনে চলতে হবে।
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি কতদিন ধরে চলে
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি একটি স্বল্পমেয়াদী চিকিৎসা পদ্ধতি। সমস্যার উপরে নির্ভর করে এই চিকিৎসা পদ্ধতি ৫-২০ সপ্তাহ চলতে পারে। ব্যক্তির চিকিৎসায় যতটা সক্রিয়তা দেখাবেন তত জলদি তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।