মানসিক স্বাস্থ্যকে বোঝা

ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি: এই থেরাপি বলতে কী বোঝায় এবং কীভাবে অন্যান্য থেরাপি থেকে এটি আলাদা?

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

১৯৬১ সালে একটি ১৭ বছর বয়সি মেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটে একটা মানসিক রোগের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। তার মধ্যে নিজেকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া এবং নিজের চরম ক্ষতি করার সমস্যা দেখা দিয়েছিল। হাসপাতালের   পক্ষ থেকে তাকে হাসপাতালের অন্যান্য রুগিদের মধ্যে অন্যতম বিপদসংকুল ও চিন্তা করার মতো একজন রুগি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। হাসপাতালে সে বেশিরভাগ সময় কাটাতো গুরুতর সমস্যায় আক্রান্ত রুগিদের জন্য নির্ধারিত নির্জন বা একলা থাকার ঘরে, যা রুগিদের কাছে নরকের সমান ছিল।

সেই অল্পবয়সি মেয়েটিই ছিল ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপির (ডিবিটি) পথপ্রদর্শক ড: মার্সা লিনেহান। ২০১১ সালে ড: লিনেহান নিজের জীবনের কথা  প্রথমবারের জন্য সর্বসমক্ষে বলেছিলেন। আ নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌-এ প্রকাশিত একটা প্রবন্ধে তাঁর মানসিক অসুস্থতাজনিত জীবনসংগ্রাম এবং তা অতিক্রম করার কাহিনি তুলে ধরা হয়েছিল। যথাযথ রোগ নির্ধারণ এবং সঠিক চিকিৎসার অভাব যে তাঁকে এই ধরনের একটা থেরাপি আবিষ্কার করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল সেকথাও ওই প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়েছিল।

ড: লিনেহান নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর ক্ষেত্রে বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার  (বিপিডি) নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং তখন সেটিই বেশি প্রচলিত ছিল। বর্তমানে ব্যক্তিত্ববিকারজনিত সমস্যার মধ্যে এই ডিসঅর্ডারটিই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।  যাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা ড: লেনিহানের মতো জটিল আকার ধারণ করে এবং অব্যবস্থা গড়ে ওঠে তখন ডিবিটি-র সাহায্যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

ডিবিটি বলতে কী বোঝায়?

ডিবিটি একপ্রকার টক থেরাপি, যা প্রচলিত বিহেভিয়ার থেরাপিগুলোর থেকে একটু  পরিবর্তিত। এর প্রধান লক্ষ্য হল যাদের নিজেদের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হয় তাদের এমনভাবে চিকিৎসা করা হয় যাতে তারা জীবনের মূল্য বুঝতে পারে এবং সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারে। এই থেরাপি মানুষকে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহ জোগায়। এর সাহায্যে এমনসব কৌশল রপ্ত করানো হয় যার ফলে রুগি তাদের সমস্যার মোকাবিলা করতে কার্যকর হয়। ডিবিটি রুগির সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে কাজ করে।

বিভিন্ন মানসিক অসুখের চিকিৎসায় ডিবিটি-র প্রয়োগ-

প্রাথমিকভাবে বিপিডি-র চিকিৎসায় ডিবিটি-র ব্যবহার করা হত। ১৯৯১ সালে ড: লেনিহান এবং তাঁর সহযোগী চিকিৎসক দল মহিলাদের বিপিডি-র সমস্যার চিকিৎসা এবং প্যারাসুইসাইডাল কল্পনা (আত্মহত্যার কল্পনা করলেও মরে যাওয়ার লক্ষ্য থাকে না)-র উপর একটা সমীক্ষা করেছিলেন। সেখানে দেখা গিয়েছিল এই থেরাপির সাহায্যে চিকিৎসা করলে মানুষের নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে এবং এই থেরাপির কার্যকারিতা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে।

অনেক সময়ে অন্যান্য চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এই থেরাপির ব্যবহার ফলপ্রসূ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- খাদ্যাভ্যাসজনিত সমস্যা, রাগ বা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ, কিছু ক্ষেত্রে অ্যাটেনশন-ডেফিশিট বা হাইপারঅ্যাক্টিভিটির সমস্যা (এডিএইচডি), অবসাদ এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) প্রভৃতি। এসব ক্ষেত্রে ডিবিটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন হয়, যেমন- বিভিন্ন সামাজিক দক্ষতার কৌশল বাড়ানো (যেমন- চারিত্রিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি), মনোযোগ বৃদ্ধির কৌশল, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, মনের সন্তুষ্টি বাড়ানো এবং হঠকারী কাজ না করা ( যেমন- খাই-খাই ভাব ও নেশাজাত দ্রব্যের ব্যবহারের সমস্যা দূর করা) প্রভৃতি।

কগনিটিভ বিহেভেরিয়াল থেরাপি (সিবিটি), অ্যাকশন প্ল্যান (বা ঘরোয়া পরিকল্পনা) প্রভৃতি ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপির অঙ্গ। এক্ষেত্রে রুগিকে কিছু কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে দেওয়া হয় এবং এই পন্থা তাদের অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করে। সমাজে মানুষে-মানুষে পারস্পরিক সম্পর্কগত সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রেও ডিবিটি-র সাহায্য নেওয়া হয়; এটি রুগি এবং থেরাপিস্ট দু'জনের ক্ষেত্রে  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চিকিৎসাবিদ্যাগতভাবে এর সাহায্যে দু'জনের মধ্যে একটি সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা চিকিৎসা প্রক্রিয়ার উন্নতিতে সাহায্য করে।

ডিবিটি এবং সিবিটি-র মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

এই দু'ধরনের টক থেরাপির মধ্যে প্রাথমিকভাবে লক্ষ্যগত এবং কিছু ক্ষেত্রে মূল উপাদানগত পার্থক্য রয়েছে।

সিবিটি-র সাহায্যে রুগির চিন্তাভাবনা ও আচরণের অস্বাভাবিকতার উন্নতি ঘটানো সম্ভব। অন্যদিকে, ডিবিটি-র সাহায্যে অতিরিক্ত বদল হয়, যেমন- অসুখের সঙ্গে যুক্ত সবরকমের অনুভূতিগুলোর সমস্যার সমাধান করা যায়। ডিবিটি-র বিশেষজ্ঞরা একজন রুগির সমস্যাকে স্বীকৃতি, গ্রহণ এবং সঠিকভাবে বুঝতে পারেন, তাঁরা নিজেদের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতির সাহায্যে রুগির সমস্যা নানাভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। যেকোনও একটি পরিস্থিতির গ্রহণযোগ্যতা ও বদলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই ডিবিটি-র প্রধান উদ্দেশ্য থাকে।

সিবিটি এবং ডিবিটি দুটোই রুগির চিকিৎসার একটা কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সিবিটি-র মধ্যে থাকে নানারকমের উদ্বেগগত সমস্যা এবং উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের কৌশল। অন্যদিকে, ডিবিটি-র অন্যতম উপাদান হল বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে সচেতনভাবে চিকিৎসা করা এবং রুগির অনুভূতি, চিন্তাভাবনা ও সংবেদনশীলতাকে স্বীকৃতি দেওয়া ও গ্রহণ করা , যা সাধারণত সিবিটি-র বিশেষজ্ঞরা করেন না।

ডিবিটি-র চিকিৎসায় বিশেষভাবে কী ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়?

প্রাথমিকভাবে ডিবিটি-র চিকিৎসায় প্রথমে ব্যক্তিগত থেরাপি করা হয়, তারপর গ্রুপ স্কিল প্রশিক্ষণ এবং এই দুটি পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়ে স্কিল কোচিং বা দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিকিৎসক রুগির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই পর্যায়গুলি যখন চলে তখন তাদের মধ্যে কিছু সীমারেখা স্থির করা হয় এবং রুগিদের দৈনন্দিন জীবনে নির্দিষ্ট কিছু বাধা অতিক্রম করার দক্ষতা শেখানো হয়। এছাড়া থেরাপিস্ট রুগিদের নিজেদের সমস্যার সমাধান করার জন্যও অনুপ্রাণিত করতে থাকেন।

স্কিল কোচিং-এ রুগিদের বিভিন্ন দক্ষতা শেখানো হয় যাতে তাদের মধ্যে নিজেদের আবেগানুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের নিজেদের অবস্থার উন্নতি হয়। এই দক্ষতার মধ্যে থাকে রুগিদের মনোযোগ বাড়ানোর কৌশলও। এর সাহায্যে তারা নিজেদের আবেগের প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে এবং সেগুলোর মধ্যে যেটা তাদের ক্ষতি করতে পারে সেগুলোও তারা চিহ্নিত করতে পারে, স্বাধীনভাবে তারা তাদের সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে এবং মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে (তারা থেরাপিস্টকে অনুরোধ করতে পারে বা যা তাদের পছন্দ হয় না তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে)। এই পর্যায়টি নিয়মিতভাবে চলে এবং রুগিদের দক্ষতার অভাবগুলোকে দূর করার জন্য নিয়মিত অনুশীলন করানো হয়।

রুগিরা যদি দেখেন যে তাদের মধ্যে কোনও সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং তাড়াতাড়ি স্কিল কোচিং-এর দরকার তখন তারা থেরাপিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। যখন রুগিরা চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের পরে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন তখন সেখানে কিছু সীমারেখা বজায় রাখা হয়।

এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য নিমহ্যান্স-এর ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ড: পৌলমী সুধীরের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

সূত্র: