মানসিক স্বাস্থ্যকে বোঝা

মানসিক রোগ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

আমরা রেস্তোরাঁর দরজার দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসের কারণে আমি ও আমার বন্ধুরা মৃদু কম্পনে অভ্যস্ত। কিন্তু এইবার জিনিসটা একদম আলাদা ছিল। আজকে দুপুরে আমার পায়ের নিচে যে ভাবে মাটি কেঁপেছে, তেমনটা আগে কখনও হয়নি। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম সমস্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে লোকজন নিরাপদ দূরত্বে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সাংঘাতিক কাঁপুনি অনেকক্ষণ চলল। যখন থামল (পরে জেনেছিলাম প্রায় ৬০ সেকেন্ড মতো চলেছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল আরও বেশি), ততক্ষণে রাস্তায় লোকে লোকারণ্য।

সৌভাগ্যবশত, ক্ষতির পরিমাণ বেশি ছিলনা। কিছু পুরানো বাড়ির দেওয়ালে সামান্য ফাটল ধরেছিল। রাস্তার মাঝে বসে যখন আফটারশকের অপেক্ষা করছিলাম তখন ভয়টা কেটে গিয়ে একটু নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছিল। আমরা নিরাপদ। ঘন্টাখানেক পরে, ফোনে সবার কুশল সংবাদ জেনে, আমরা ঠিক করলাম শহরের আদি অঞ্চলে একবার গিয়ে দেখব। শুনেছিলাম যে ওদিকে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু যা দেখলাম তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।

যে সুন্দর শহরটিকে আমরা চিনতাম, তা ধূলায় মিশে গেছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে লোকজন দিশেহারা হয়ে নিজের প্রিয়জনদের খুঁজছেন। নিজেকে কি রকম অপরাধী মনে হতে লাগল। আমরাও তাঁদের সাথে হাত লাগালাম। সরু রাস্তাগুলিতে হাঁটতে হাঁটতে আমার লজ্জা করছিল। আমরা একবারও এঁদের কথা ভাবলাম না? মন থেকে সব আনন্দ চলে গেল, আবার ফিরে এল সেই আতঙ্ক জড়ানো বিষাদ।

সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। আমার বাবা-মা আমায় দেখে খুশি হলেও আমি চুপচাপ ছিলাম। তাঁরা বুঝলেন যে আমায় একটু একা থাকতে দেওয়া দরকার। সেদিন রাতে আমার ঘুম হল না।

তিনটে মাস কেটে গেছে সেই ভূমিকম্পের পর। এখনও সেই শহর স্বাভাবিক হয়নি। লোকে এখনো তাঁবুতে দিন কাটাচ্ছে, কারণ তাঁরা পাকাবাড়িতে আর থাকতে চান না। কপাল ভাল যে শহরের সমস্ত সুযোগ সুবিধা ফিরে এসেছে, খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব নেই, বিদ্যুৎ ও কলের জল ঠিকমত আসছে। ওই শহরের কাছেই থাকে আমার এক বন্ধু আকাশ। ভূমিকম্পের সময় ও বাড়িতেই ছিল, এবং স্বচক্ষে পুরো ঘটনাটা দেখেছে। ওঁর মা বলল যে ও প্রতি রাতেই জেগে থাকে। মাঝেই মাঝেই ঘুমের মধ্যে ওঁর মনে হয় বাড়িটা দুলছে। সারাদিন খাওয়া দাওয়া করে না এবং একলা দরজা আটকে বসে থাকে। আকাশের বাবা বললেন যে ও খুব ভেঙে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেবে। আকাশের মা এর নিজেকে অসহায় লাগছিল। আমরা প্রায়ই তারপর আকাশের বাড়িতে যেতাম। সে খুবই মনমরা হয়ে পড়েছিল, আমরা ওকে খুশি রাখার চেষ্টা করতাম... 

আমাদের পাঠকদের বাস্তব পরিস্থিতি বোঝাতে আমরা এই কাল্পনিক কাহিনীটি বর্ননা করলাম।

হ্যাঁ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাওয়ার পরে মনোসামাজিক সহায়তা সত্যিই প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভুক্তভোগী সবারই সাহায্য প্রয়োজন। শুধু ব্যাক্তি বিশেষে নির্ভর করে সাহায্যের ধরন পাল্টাতে পারে। এইরকম ঘটনার দরুন বা তার পরে এখন ব্যক্তি বিভিন্ন রকম আবেগের মধ্যে দিয়ে যেতে পারেন যা হয়ত তিনি কিছুদিনের মধ্যেই সামলে নেবেন। বিভিন্ন রকম আবেগ বলতে,

  • মানসিক আঘাত

  • আতঙ্ক

  • গ্লানি

  • ক্ষোভ

  • সতর্ক তৎপরতা

  • দুর্ঘটনার স্মৃতি বারবার মনে ভেসে ওঠা

  • দুঃখ এবং হতাশা

এই আবেগগুলি বিপর্যয় মোকাবিলা করার পরে সবার মনেই আসে। সময়ের সাথে অনেকেই এগুলি কাটিয়ে ওঠেন। কিন্তু, অনেকেই তা পারেন না এবং বিভিন্ন মানসিক সমস্যা যেমন ডিপ্রেশন, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), নিদ্রা বিকার এবং মাদকাসক্তিতে ভোগেন।

ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতাকে সামনে রাখলে পরে মনোসামাজিক সহায়তা আরও প্রয়োজন। হয়ত তাঁরা মরতে মরতে বেঁচে গেছেন, হয়ত তাঁরা নিজের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, বাড়িঘর হারিয়েছেন। তাঁর উপরে রয়েছে খাদ্য ও জলবাহিত বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের সম্ভাবনা। সবার এই সমস্ত ধাক্কা সামলে ওঠার মত মানসিক শক্তি নাও থাকতে পারে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সাথে সাথেই সবার মানসিক বিপর্যয় নাও হতে পারে। অনেক সময় পরে ওই ব্যক্তি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন। কাজেই ধৈর্য ও সহানুভূতির সাথে সেই ব্যক্তির সাথে মিশুন। কয়েক মাস পরেও যদি এক ব্যক্তি মানসিক ভাবে না সামলে ওঠেন, তবে তাঁর অবিলম্বে চিকিৎসা প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরেই, ব্যক্তির নিম্নলিখিত বিষয়ে সাহায্য লাগতে পারে:

  • হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের খুঁজে বের করতে সাহায্য করুন।

  • ব্যক্তির সাথে কথা বলুন, বিভীষিকার কথা মুখ খুলে বলতে পারলে তাঁর একটু হাল্কা লাগবে।

  • তাঁদের পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে সাহায্য করুন।

আপনার কোনও পরিচিত বন্ধু বা আত্মীয় যদি সাম্প্রতিক কালে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ যোগ করে থাকেন তাহলে আপনি:

  • ধৈর্য সহকারে তাঁর পাশে দাঁড়ান। তাঁদের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করুন।

  • সেই দিনের ব্যাপারে আলোচনা করুন, কিন্তু তাঁকে জোর করবেন না। তাঁদের মনের কষ্ট খুলে বলতে পারলে ভাল লাগবে।

  • এই সময় নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া স্বাভাবিক।

  • যদি তাঁরা বহুদিন পরেও মানসিক চাপ না কাটাতে পারেন, তবে তাঁদের একজন মনোবিদ্যার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিন।