মেন্টালাইজেশন বেসড ট্রিটমেন্ট (এমবিটি) এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যার সাহায্যে বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (বিপিডি)-এর চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন দু'জন ব্রিটিশ সাইকোডায়নামিক থেরাপিস্ট - পিটার ফোনেগি এবং অ্যান্টনি বেটম্যান। এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রধান উদ্দেশ্য হল যেসব মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাদের মানসিক স্থিতি পুনরায় ফিরিয়ে আনা।
কীভাবে মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ জন্মায়?
ছোটবেলায় আমরা আমাদের বাবা-মা বা পরিচর্যাকারীদের কাছাকাছি থাকতে চাই। যখন আমরা বিচলিত বোধ করি তখন আমরা হাসি, কাঁদি বা গা ঘেঁষে থাকতে চাই - সংযোগ স্থাপনের জন্য এমন আচরণের উপর ভরসা করি যাতে ওরা আমাদের আশ্বস্ত করেন। এইধরনের আচরণে আমাদের বাবা-মা বা অভিভবাকদের প্রতিক্রিয়ার প্রভাবের মধ্যে দিয়ে আমাদের নিরাপত্তার বোধের জন্ম হয় ও তার বিকাশ ঘটে।
সহজ কথায় বলা যায় যে, স্বস্তিদায়ক প্রতিক্রিয়া আমাদের মনে একটা কাঠামো সৃষ্টি করে যার সাহায্যে আমরা আমাদের আবেগ ও আচরণগুলোকে নিজে থেকে প্রশমিত এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এটি আমাদের মনে এমন একটি আদর্শ সম্পর্কের ধারণা গড়ে তোলে, যার সাহায্যে আমরা পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হই।
কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে যখন অভিভাবকদের আচরণ বা তাদের প্রতিক্রিয়া সন্তানদের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত হয় না তখন সন্তানদের মনে একপ্রকার নিরাপত্তাহীনতার বোধ জেগে ওঠে। এর ফলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে না হলেও, বাচ্চারা তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং প্রাপ্তবয়সে তাদের অন্যান্য সম্পর্ক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর একটা প্রধান কারণ হল তারা মেন্টালাইজ করতে পারে না।
মেন্টালাইজেশন বলতে কী বোঝায়?
এটি এমন একটি ক্ষমতা যার সাহায্যে শুধুমাত্র নিজেদের বা অন্যান্যদের আচরণের উপর জোর না দিয়ে আমরা পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের সঠিক চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলোকে নির্ধারণ করতে পারি। এর সাহায্যে আমরা স্পষ্টভাবে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ-এর বিভিন্ন ঘটনার উপর প্রতিফলন করতে পারি এবং প্রত্যেকটি পরিস্থিতিকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। মেন্টালাইজেশন-এর সাহায্যে আমরা কোনও কাজ করার আগে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে পারি এবং পারস্পরিক যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্কগুলোর উন্নতি ঘটাতে পারি।
মেন্টালাইজেশন বেসড ট্রিটমেন্ট বলতে কী বোঝায়?
এমবিটি একধরনের টক থেরাপি, যার মাধ্যমে ক্লায়েন্টকে তার নিজের জীবনের নানা ঘটনার বর্ণনা করতে এবং তার চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলোর সত্যতা যাচাই করতে উৎসাহ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এর সাহায্যে একজন ক্লায়েন্টের মনোগত নয় এমন কিছু ভাবনা, যেমন- চূড়ান্ত নেতিবাচক চিন্তা করা বা কোনও একটি বিষয়কে খুব অগভীর বা নিতান্ত সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করা (যেমন- ''আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তাই তারা আমায় সবসময় অবহেলা করে'')- প্রভৃতি সমস্যাগুলোকেও থেরাপিস্ট চিহ্নিত করতে পারেন। এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন থেরাপিস্টের প্রধান লক্ষ্য হল ক্লায়েন্টকে কোনও একটা ঘটনা বা পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত বা আঙ্গিক থেকে দেখতে শেখানো। এভাবেই তারা একটা ঘটনা বা বিষয়কে মনোগত করতে এবং নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
যেমন, থেরাপিস্টকে ক্লায়েন্ট তার সমস্যার কথা বলতে গিয়ে জানাতে পারে যে যখন বন্ধুরা তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চায় না তখন তার মনে যেন তাকে পরিত্যাগ করে দেওয়া হয়েছে। এটা শুনে থেরাপিস্ট প্রথমে ক্লায়েন্টের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিকে চিহ্নিত করতে তাকে সাহায্য করে এবং তারপর বন্ধুদের ফোনে উত্তর না দেওয়ার কারণটা খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। এভাবে থেরাপিস্টের সাহায্যের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি তার মনোগত নয় এমন পরিস্থিতি বুঝতে পারে, নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং নিজেকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
যত বেশি এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে তত বেশি নিজেদের চিন্তাভাবনাগুলোর মনঃস্থ করা ক্লায়েন্টের নিজস্ব স্বভাবে অঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে আর এই কৌশল তারা থেরাপির বাইরে নিজেদের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে পারবে। এর ফলে তারা আরও ভালোভাবে নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, রাগে ফেটে পড়ার প্রবণতা কমবে এবং নিজেদের আচার-আচরণের উন্নতি ঘটাতেও সক্ষম হবে।
কারা এমবিটি-র চিকিৎসায় উপকৃত হয়?
প্রধাণত বিপিডি-র সমস্যায় এমবিটি পদ্ধতির ব্যবহার বেশি হলেও, অন্যান্য ব্যক্তিত্ব বিকারের সমস্যা, খাদ্যজনিত সমস্যা, বারবার অবসাদগ্রস্ত হওয়া, নিজের ক্ষতি করার মনোভাব এবং আসক্তিজনিত সমস্যার ক্ষেত্রেও এই চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। যাদের মানসিক আঘাত খুব জটিল আকার নেয় তাদের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতির সাহায্যে চিকিৎসা করলে উপকার পাওয়া যায়। এর দ্বারা তাদের মনে জন্মানো অশান্তি বা টালমাটাল অবস্থা, যা বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা-ও এড়ানো সম্ভব হয়।
সিবিটি বা ডিবিটি-র থেকে এমবিটি-কে কীভাবে আলাদা করা যায়?
মানুষের আবেগানুভূতি ও আচরণের মধ্যেকার যোগসূত্র বোঝার বা জানার সঙ্গে এই থেরাপিগুলো একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত। কগনিটিভ বিহেভায়রল থেরাপি (সিবিটি) এবং ডায়ালেক্টিকাল বিহেভায়র থেরাপি (ডিবিটি) মানুষের আচরণের বদলকে নির্দেশ করে; এর সাহায্যে একজন থেরাপিস্ট রুগির পরিবর্তিত আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন।
প্রকৃতিগতভাবে এমবিটি মানুষের মানসিক প্রক্রিয়ার পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে আরও উচ্চতর ও গভীর অনুসন্ধান চালায়। এই পদ্ধতির সাহায্যে রুগিরা একবার তাদের সমস্যাগুলো খুব শান্তভাবে বিচার-বিবেচনা করতে পারলে পরিবর্তিত আচরণের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য তাদের উৎসাহ দেওয়া যায়।
ভারতে কি এমবিটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়?
এমবিটি ভারতে অপেক্ষাকৃত নতুন থেরাপি। এখনও পর্যন্ত এটি নবজাতকের পর্যায়ে রয়েছে। পরিষেবাগত দিক থেকে একমাত্র ব্যাঙ্গালোরে গ্রুপ বা দলগত থেরাপির মাধ্যমে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়।
বছরে সাপ্তাহিকভাবে দলগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেকটি সেশন বা পর্যায়ে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও তাঁর সহযোগী একজন থেরাপিস্ট উপস্থিত থাকেন এবং ৭৫ মিনিট ধরে এক-একটা সেশন চলে। ছ'মাস সেশন চলার পরে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা পর্যায়গুলির মূল্যায়ন করেন এবং বছরের শেষ দিকে সদস্যদের উন্নতিগুলো খতিয়ে দেখা হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে দলের অংশগ্রহণকারী হিসেবে রুগির পরিবারের সদস্যরাও থাকে। ফলে তারা এই গোটা প্রক্রিয়ার উন্নতিটিকে ভালোভাবে বুঝতে পারে।
কেন গ্রুপ থেরাপি করা হয়?
সাধারণত, এমবিটি-তে দলগত ও ব্যক্তিগত দু'রকম থেরাপিই সাহায্যদায় হয়। কিন্তু ভারতে যেহেতু এই বিষয়ে প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই সেই কারণে ব্যক্তিগত থেরাপির পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।
এছাড়া দলগত বা গ্রুপ থেরাপির অনেক সুবিধা রয়েছে। এর সাহায্যে একইরকম সমস্যায় ভোগা রুগিরা তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনা করতে পারে। থেরাপিস্ট ও দলের সদস্যদের জন্য এই থেরাপির মূল উদ্দেশ্য হল তারা একে-অপরের সঙ্গে মানসিকভাবে একটা যোগসূত্র গড়ে তুলতে পারে। দেখা গিয়েছে যে পারস্পরিক কথোপকথনের সময় তারা তাদের মনোগত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু গ্রুপ থেরাপি তাদের নিজেদের বুঝতে পারা এবং একে-অপরকে সাহায্য করার জন্য খুবই নিরাপদ একটা জায়গা। সেই সঙ্গে নিজেদের চিন্তাশীলতার ক্ষমতাকেও তারা বাড়াতে পারে।
এমবিটি ব্যক্তিগত থেরাপির বদলে করা হয় না। গ্রুপ থেরাপির সাহায্যে যেখানে মানসিকভাবে রুগিরা পরস্পরের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারে, সেখানে ব্যক্তিগত থেরাপিতে রুগিরা তাদের নিজস্ব মানসিক আঘাত এবং অতিরিক্ত সংবেদনশীল সমস্যাগুলো থেরাপিস্টের কাছে খোলাখুলি বলতে পারে। কারণ এইধরনের সমস্যাগুলো দলগতভাবে আলোচনা করা প্রায়শই সম্ভব হয় না।
এই প্রবন্ধটি লিখতে সাহায্য করেছেন বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এবং মেন্টালাইজেশন-বেসড্ ট্রিটমেন্টের বিশেষজ্ঞ ডঃ অশ্লেষা বাগাডিয়া।