আমাদের মধ্যে ক'জন এমন কাজ করেছি? এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে একনাগাড়ে মাথা ব্যথা হচ্ছে বলে গুগ্ল ঘেঁটে মাথা ব্যথা নিয়ে কিছু জানার চেষ্টা করেছি; রাতে খাবার পরে বুকে ব্যথা অনুভব করছি আর তাই গুগ্লের সাহায্যে বুকে ব্যথা সংক্রান্ত তথ্য খুঁজে দেখার বা বিশেষ করে এটা হৃদ্যন্ত্র বিকল (হার্ট অ্যাটাক) হওয়ার লক্ষণ কিনা তা বোঝার বা জানার চেষ্টা করেছি?
নিজের রোগ নিজেই নির্ণয় বা চিহ্নিত করতে পারা অসুখ নির্ণয়ের একপ্রকার প্রক্রিয়া। অসুখ শারীরিক বা মানসিক- যাই হোক না কেন, পুরনো অভিজ্ঞতা অথবা পপুলার মিডিয়া যেমন- ইন্টারনেট কিংবা বই থেকে পাওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে এই প্রক্রিয়া চলে।
রোগের সম্ভাব্য লক্ষণগুলি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। গবেষণার মাধ্যমে উঠে আসা তথ্যগুলি আমাদের রোগের লক্ষণ সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করে। আর তাই আমরা তাড়াতাড়ি সমস্যার ভিতর ঢুকে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে সচেষ্ট হই। অনেকসময় আবার উল্টোটাও দেখা যায়। যেমন- একটা অসুখের এমনসব লক্ষণ দেখলাম, যে অসুখ হয়তো আমার হয়নি। আর এভাবেই আমাদের মনে রোগ সংক্রান্ত ভয় হতে শুরু করে।
অনেকসময় এটাও ভাবা সম্ভব যে, রাতে খাবার পরে বুকে ব্যথা হচ্ছে আর আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম যে আমাদের হার্ট অ্যাটাক করেছে। অথবা বর্ষাকালে মন খারাপ করলে আমরা ধরে নিই যে মানসিক অবসাদ আমাদের গ্রাস করেছে। যদি আপনি আপনার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করেন তাহলে আপনার উচিত একজন ভালো চিকিৎসকের সঙ্গে অবিলম্বে যোগাযোগ করা। মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার ক্ষেত্রেও এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
জ্বর, সর্দি বা কাশির মতো মানসিক রোগের লক্ষণগুলো তত স্বচ্ছ নয় বা খালি চোখে ধরা পড়ে না। লক্ষণগুলো ধাপে ধাপে সামনে আসে এবং সেগুলো এতটাই সূক্ষ্ম বিষয় যা একজন প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞই চিহ্নিত করতে পারেন। যেমন- কোনও মানুষের অল্প, মাঝারি বা গুরুতর মানসিক অবসাদ চিহ্নিত করার জন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোবিদ চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তার সঙ্গে রুগিকে খুঁটিয়ে পরীক্ষাও করেন। আর এসব করেন ডিএসএম-ভি (ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস্ পাবলিশড বাই দ্য আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন) এবং আইসিডি-১০ (ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অফ ডিসিস্ ইস্যুড বাই দ্য ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) এ লিপিবদ্ধ নির্দেশিকার উপর ভিত্তি করে।
নিজের মানসিক অসুস্থতা নিজে চিহ্নিত করলে তা সেই অসুখকে গুরুত্বহীন করে তোলে বা অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে। এই দু'টি বিষয়ই অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে।
যেমন- আপনি ভাবতেই পারেন যে, মানসিক অবসাদের সঙ্গে থাইরয়েডিজম্ বা ডায়াবেটিসের মতো শারীরিক সমস্যার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। অথবা মানসিক উদ্বেগের সমস্যাকে সামান্য মানসিক চাপ বলে ধরে নিয়ে আপনি কোনও বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে নাও করতে পারেন।
ওসিডি বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক অসুস্থতাকে তুচ্ছ করে দেখার ফলে তা একজন মানুষের ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ আপনি যেভাবে আপনার অসুখের গুরুত্ব বিচার করছেন তার সঙ্গে কিন্তু বাস্তবের মিল নাও থাকতে পারে; যতক্ষণ না তা চিকিৎসাশাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
যখন কেউ বা কারা তাদের নিজেদের ইচ্ছা মতো ওষুধ খেয়ে মানসিক অসুস্থতা নিজেরাই চিহ্নিত করার চেষ্টা করে তখন সেই আত্ম-চিকিৎসা আরেকটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। মাথাব্যথার মতো সমস্যায় সাধারণ বড়ি খেলেই তা সেরে যায় কিন্তু একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দেওয়া ওষুধ খেলে নানারকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাই ব্যক্তি বিশেষের সমস্যার উপর ভিত্তি করে এই ধরনের ওষুধ খুব সচেতন ভাবে রুগিকে দেওয়া একজন বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে জরুরি বিষয়। ওষুধ ছাড়া, অন্যান্য মনোরোগ সংক্রান্ত চিকিৎসা, যেমন- থেরাপির ক্ষেত্রেও একজন প্রশিক্ষিত মনোবিদের সাহায্য নেওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।
তাহলে কেন অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য লিখিত আকারে থাকে?
যে সব স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় আমরা প্রায়শই ভুগি সেই সব সমস্যার কথা ভালোভাবে জানতে এবং রোগের লক্ষণ জানার জন্য আমরা ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করি বা বই পড়ি। তবে এর সঙ্গে অবশ্যই দরকার একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া, যিনি একজন রুগিকে সঠিক এবং যথাযথ চিকিৎসা পরিষেবা দান করতে পারবেন।
মানসিক অসুস্থতার প্রশ্নে আমাদের মধ্যে জ্ঞানের অনেক অভাব রয়েছে। কোনও রোগের লক্ষণকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখার ক্ষেত্রে যেমন অনেক বিপদ রয়েছে, তেমন অসুখ হলে কখন একজন চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে সেই বিষয়ে সচেতন থাকাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক অসুস্থতাজনিত তথ্য সম্বলিত ওয়েবসাইটগুলো মানসিক অসুখের লক্ষণ জানা এবং বোঝার জন্য মানুষকে অনেকাংশে সাহায্য করে থাকে। তাছাড়া, এইসব ওয়েবসাইটগুলোতে চিকিৎসা ও চিকিৎসক সংক্রান্ত নানা তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে, যা মানুষকে সঠিক চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে।
এই প্রবন্ধটি লেখার ক্ষেত্রে ডাক্তার গরিমা শ্রীবাস্তবের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে। ডাক্তার শ্রীবাস্তব একজন দিল্লি-নিবাসী ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সাইন্সেস থেকে ইনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।