মানসিক স্বাস্থ্যকে বোঝা

মানসিক রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি

মানসিক রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

মানসিক রোগের বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো কী?

প্রথমেই ডাক্তাররা ভালভাবে রোগীকে পরীক্ষা করেন। সেই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে যে কোন চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হবে। সামান্য উপসর্গের ক্ষেত্রে অল্প দিনের জন্য চিকিৎসা হলেই যথেষ্ট। কিন্তু গুরুতর ক্ষেত্রে মনোবিদ, মানসিক রোগের চিকিৎসক, এবং সেচ্ছাসেবীরা একত্রে মিলে চিকিৎসায় সাহায্য করে। নিচে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতির বিবরণ দেওয়া হল।

বি.দ্র: - যে কোনো চিকিৎসার ক্ষেত্রেই রোগীর সুস্থ হবার ইচ্ছার ওপর তাঁর শীঘ্র আরোগ্যলাভ নির্ভর করে। মানসিক বিপর্যস্ততার কারণে মস্তিষ্কে বিভিন্ন রাসায়নিকের ঘাটতি হয়। সেই ঘাটতির দরুন মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। কাজেই সমবেদনা ও মানসিক সহায়তা এইক্ষেত্রে খুবই মূল্যবান।

ওষুধপত্র

ওষুধের সাহায্যে দ্রুত আরোগ্যলাভ ও উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওষুধের সাহায্যেই প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয়। যদিও ওষুধের প্রভাব নির্ভর করে রোগীর অসুখের মাত্রা এবং শারীরিক পরিস্থিতির ওপর।

সাধারণত যেই সমস্ত ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে তা হল:

  • অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট: ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটির ক্ষেত্রে এই ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। এর থেকে কোনোরকম নেশা হয় না।

  • অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি মেডিকেশন: একে ট্র্যাংকুইলাইজার ও বলা হয়ে থাকে। অ্যাংজাইটি ডিস্‌অর্ডারের ক্ষেত্রে এই ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। মূলত, উত্তেজনা কমাতে এবং ইনসমনিয়ার বা নিদ্রা বিকারের সাথে লড়তে সাহায্য করে।

  • মুড-স্টেবিলাইজিং মেডিকেশন: মুড ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে এই ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটারের নিয়ন্ত্রণে এটি সাহায্য করে। বাইপোলার ডিস‌অর্ডারে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এটি উত্তেজনা ও অবসাদ, দুটিই নিয়ন্ত্রণে রাখে। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসাতেও এটি কাজে লেগে থাকে।

  • অ্যান্টি-সাইকোটিক মেডিকেশন: একে নিউরোলেপটিক্সও বলা হয়। মুড সুইং, মানসিক বিভ্রম বা কল্পনা ও অবাস্তব চিন্তা ভাবনার মত উপসর্গের চিকিৎসায় এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

থেরাপি

মানসিক সাস্থের উন্নতির উদ্দেশ্যে ওষুধের পাশাপাশি এক বা একাধিক থেরাপির পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। পুরোটাই নির্ভর করছে রোগীর মানসিক ও শারীরিক সাস্থের ওপর।

সাইকোথেরাপি: এই পদ্ধতি অনুসারে একজন রোগ বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রোগীর অবাস্তব ও ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করে ইতিবাচক ও যুক্তিসম্মত চিন্তা আনতে সাহায্য করেন।

চিকিৎসক রোগীকে তাঁর সমস্যা খুলে বলতে সাহায্য করেন। নিজের সমস্যা নিজে বুঝতে পারলে বাকি চিকিৎসা খুব সহজ হয়ে যায়।  

সিবিটি বা কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি: কগ্নিটিভ এবং বিহেভিওরাল থেরাপির যুগল। এই পদ্ধতিতে রোগীর চিন্তাভাবনা ও চালচলনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়।

সিবিটির সাহায্যে রোগী নিজের সমস্যা নিজে বুঝে তা সমাধানের চেষ্টা করতে পারেন। চিকিৎসক এবং রোগী উভয়কেই এখানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়। চিকিৎসক এখানে রোগীকে তাঁর নিজের অসংলগ্ন চিন্তা ভাবনাকে চিনতে সাহায্য করেন। সেইজন্য চিকিৎসক রোগীকে দৈনিক কিছু কাজ যেমন ডাইরি লেখা বা নিজের অস্বভাআবিক চিন্তা ভাবনার কারণ লক্ষ করা এবং সুন্দর ইতিবাচক ঘটনা গুলি রেকর্ড করে রাখতে বলেন।

ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, ইটিং ডিস‌অর্ডার ও বাইপোলারের চিকিৎসায় সিবিটির প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ইন্টারপার্সোনাল থেরাপি বা আইপিটি: রোগীকে কথা বলতে সাহায্য করা। স্বাভাবিক কথাবার্তা ও চালচলন ব্যাহত হতে থাকলে ওষুধপত্রের পাশাপাশি আইপিটির প্রয়োগ করা যেতে পারে। রোগী যদি সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নেন তবেই দ্রুত আরোগ্যলাভ সম্ভব।

ফ্যামিলি থেরাপি: রোগী এবং তাঁর পরিবার উভয়ের মধ্যেকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে এই প্রক্রিয়া ব্যাবহার করা হয়। রোগীর সুস্থতার জন্যে তা জরুরি।

চিকিৎসক ভাল করে বিচার করে দেখেন যে ঠিক কি কারণে পারিবারিক অশান্তি হচ্ছে যা রোগীর সাস্থের অবনতির কারণ। সেইমত তারপর সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হয়।

চিকিৎসক প্রথমেই রোগীর পরিবারের লোকজনকে রোগ সম্বন্ধে বোঝান। রোগের কারণে তৈরি হওয়া বিপদজনক হিংস্র আচরণ সামাল দেওয়া এবং নিজের প্রিয়জনের পাশে দাঁড়ানোর গুরুত্ব বোঝানো হয়। প্রিয়জনের সহায়তা ও রোগীর ইচ্ছা ছাড়া সুস্থতা পাওয়া অসম্ভব। দীর্ঘদিন ধরে যারা মনোরোগীর সাথে বাস করছেন, তাঁদের জন্য এই থেরাপি খুবই প্রয়োজনীয়।

মনে রাখবেন: এই থেরাপি গুলির সঠিক ব্যবহার রোগীকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। ক্ষেত্র বিশেষে ওষুধ ও থেরাপি একই সাথে চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কোনও ক্ষেত্রে শুধু ওষুধ বা শুধু থেরাপির প্রয়োজন হয়ে থাকে।

মস্তিষ্কে উদ্দীপনা চিকিৎসা বা ব্রেন স্টিমুলেশন ট্রিটমেন্ট

ওষুধ পত্র বা থেরাপিতে কাজ না হলে চিকিৎসকের একটি দল আলোচনা ও বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অনেক সময় এই চিকিৎসাপদ্ধতির আশ্রয় নেন।

মনে রাখবেন: রোগী এবং তাঁর পরিবারের লোকদেরকে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে বুঝতে হবে, এবং তাঁরা সম্মতি দিলে পরেই চিকিৎসা শুরু করা হবে।

  • ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি - ইসিটি: মস্তিষ্কে নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে বৈদ্যুতিন শক দেওয়া।

  • ট্রান্সক্রেনিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন - টিএমএস: চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা মস্তিষ্কের নার্ভ সেলকে উদ্দীপিত করা।

আমি কী করে জানব যে এই পদ্ধতিটি আমার জন্যে সঠিক?

মনোবিদরা আপনার চিকিৎসার ইতিহাস, উপসর্গ বিশ্লেষণ, পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা করে এবং আরও বিভিন্ন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেই রোগ সম্বন্ধে কোনরকম সিদ্ধান্তে আসেন। তারপরে তিনি ঠিক করেন যে কোন চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। রোগী এবং তাঁর পরবারের লোকজনের কাছ থেকে কোন কিছুই লোকানো হয় না।

যোগব্যায়ামকে কী চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ধরা যায়?

গত এক দশকে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে যোগব্যায়াম একটি বাড়তি চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে কাজে লাগে। আরও জানতে ডাঃ শিবরাম ভারামবাল্লির সাক্ষাৎকারটি পড়ুন।

ওষুধপত্রের কিরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে?

সবরকম অষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। কেউ কেউ সেগুলো টের পান না ফলে কোনও অসুবিধা হয় না। মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যাবহৃত ওষুধের সাথে একটি পার্শপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে ইনফরমেশন শিট দেওয়া থাকে। সেগুলোর সাথে যুঝে ওঠার নিয়ম জানতে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উদাহরণ এখানে দেওয়া হল:

  • ঘুম ঘুম ভাব ও জড়তা

  • মোটা হয়ে যাওয়া

  • ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা

  • রক্তচাপ কমে যাওয়া

  • নেতিবাচক প্রভাব যেমন মনোযোগ ও উৎসাহের অভাব

নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি মাথায় রাখুন:

  • সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার থেকে ওষুধের লাভ অনেক বেশি। চিকিৎসকের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময় অনুযায়ী ওষুধ খান।

  • নিয়মিত ওষুধ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমে যেতে পারে।

  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না কমলে চিকিৎসককে জানান। উনি আপনাকে সাহায্য করবেন।

  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করবেন না।