পৃথিবীর বহু দেশের থেরাপিস্ট এবং কাউন্সেলররা তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে কয়েকটি নীতি বা নির্দেশিকা মেনে চলতে বাধ্য থাকেন। চিকিৎসক এবং রুগি দু'জনকেই এই বিধিবদ্ধ নীতিগুলো নানাভাবে সাহায্য করে। যেমন-
নিজেদের নির্দিষ্ট কাজের জন্য পরিষ্কারভাবে এই নির্দেশিকার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এটি দু'পক্ষের সম্পর্কের সীমারেখা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে।
দু'পক্ষের নিরাপত্তা (শারীরিক এবং মানসিক) নিশ্চিত করে।
ভারতে যদিও পেশাগত অনুশীলনের জন্য তেমনভাবে কোনও পরিচালনা পর্ষদ বা পরিচালকবর্গ অথবা অভিন্ন নীতি বা নিয়ম নেই। অর্থাৎ, যাঁরা থেরাপিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছেন, তাঁরা তাঁদের কাজ চলাকালীন কী নীতি মানবেন বা কী মানবেন না, সে বিষয়ে তাঁদের সঠিক ধারণা থাকে না।
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন কয়েকজন থেরাপিস্টের সঙ্গে থেরাপির কাজ চলার সময়ে তাঁদের কী ধরনের বিধিবিদ্ধ নীতি বা নির্দেশিকা মেনে চলতে হয়, তা নিয়ে কথা বলেছিল। এখানে সে বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে-
কী প্রত্যাশা রাখা জরুরি:
প্রথম পর্যায়ে রুগি হিসেবে আপনি কী প্রত্যাশা করছেন সে বিষয়ে একজন থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলর আপনার কাছ থেকে জানতে চাইবে। তাঁরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন আপনার চিকিৎসা বা মানসিক স্বাস্থ্যের ইতিহাস সম্পর্কিত কাগজপত্র আপনার সঙ্গে আছে কিনা, কারণ সেগুলো দেখেই তাঁরা আপনার সমস্যা বুঝবেন এবং সে বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামত আপনাকে জানাবেন।
প্রথম দিকের কয়েকটা পর্যায়ে একজন থেরাপিস্ট আপনার সঠিক অবস্থা সম্পর্কে আপনাকে বোঝাতে সাহায্য করবেন এবং থেরাপির আসল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবেন। এর ফলে কীভাবে চিকিৎসা হচ্ছে সে বিষয়ে দু'পক্ষই সচেতন থাকতে পারবে।
আপনার থেরাপিস্ট আপনার কাছে তাঁর কাজের বিশেষ দক্ষতার দিকটি স্পষ্ট করে বলবেন এবং সেই সঙ্গে আপনাকে সাহায্যের বিষয়ে তাঁর যে ক্ষেত্রে দক্ষতা বা ক্ষমতা নেই সে সম্পর্কেও তিনি আপনাকে জানাবেন। এক্ষেত্রে তিনি আপনাকে আরেকজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সুপারিশও করতে পারেন।
থেরাপি সাধারণত অ-নির্দেশিতভাবে হওয়া জরুরি। নির্দেশ দেওয়ার বদলে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। রুগি হিসেবে তাঁদের সিদ্ধান্তের উপরে আপনার নিজের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে যিনি আপনাকে সাহায্য করছেন তাঁর কাজের যে প্রতিফলন আপনার উপরে পড়ছে সে বিষয়েও স্বচ্ছতা থাকা একান্ত দরকার।
আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ আপনার অনুভূতিগত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবেন, তিনি সমানুভূতিসম্পন্ন হবেন এবং নিজের মতামত না দিয়ে রুগির সমস্যা শুনবেন।
থেরাপিস্টের সঙ্গে আপনার কথোপকথন সম্পূর্ণ গোপন থাকবে এবং থেরাপিস্ট আপনার পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধব ছাড়া অন্য কারোর সঙ্গে সেই আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কথাবার্তা বলবেন না। যদি একজন থেরাপিস্ট সমস্ত পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনা করে বুঝতে পারেন যে আপনার মধ্যে নিজের বা অন্য কারোর ক্ষতি করার সম্ভাবনা রয়েছে তখন আপনার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি আপনার পরিবারের লোক বা অন্য আরেকজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন।
সাধারণভাবে থেরাপির প্রথম দিকে এসব বিষয়গুলো নিয়েই একজন থেরাপিস্ট তাঁর রুগির সঙ্গে কথা বলেন।
সাধারণভাবে থেরাপির প্রথম দিকে এসব বিষয়গুলো নিয়েই একজন থেরাপিস্ট তাঁর রুগির সঙ্গে কথা বলেন।
মুম্বইয়ের আইকল (iCALL) সাইকোলজিকাল হেল্পলাইনের প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট তনুজা বাব্রের মতে- ''হেল্পলাইন হিসেবে আমরা শুধু প্রযুক্তির সাহায্য রুগির সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে সচেতন থাকি। আমরা টেলিফোনে রোগ নির্ধারণ, স্ক্রিনিং বা সুপারিশ করি না। আমাদের করণীয় হল রুগিকে এমন একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সুপারিশ করা যিনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। তখন আমরা চিকিৎসা বিষয়ক প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব পালন করি, যেমন- থেরাপিস্ট, বিশেষ বিভাগ, আইনি সাহায্য, এনজিও বা হাসপাতাল প্রভৃতির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি।
থেরাপিস্টরা একজন রুগিকে কীভাবে সাহায্য করেন:
প্রথম দিকের কয়েকটা আলোচনার সময়ে সমাধানের রাস্তা বা চিকিৎসার সময়সূচি ঠিক করেন একজন থেরাপিস্ট। পুরো পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং সম্ভাব্য ফলাফল পাওয়ার জন্য কিছুটা সময়ও হাতে নেন তাঁরা।
তাঁরা রুগিকে তাঁদের মূল্যবান পরামর্শ বা সমাধানের রাস্তা দেখান বা তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা রুগিকে বলেন।
রুগির অনুভূতি, পরিচিতি, অভিজ্ঞতা বা তার পছন্দকে দোষারোপ, সমালোচনা বা লজ্জা দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা-ও পর্যবেক্ষণ করতে হয় একজন থেরাপিস্টকে।
রুগির সঙ্গে থেরাপিস্টের কথোপকথনের পুরো বিষয়টা রুগির মতামত না নিয়ে তার পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভাগ করে নেন একজন থেরাপিস্ট।
ব্যাঙ্গালোরের ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ডঃ দিব্যা কান্নান জানিয়েছেন যে-
আমি এই বিষয়টা একেবারেই মানতে পারি না: আমি এমন কোনও তথ্য রুগির সামনে প্রকাশ করি না যার জন্য আমি একটা সঠিক যুক্তি দিতে পারব না (প্রথম পর্বে আমি রুগির কাছে চিকিৎসাজনিত কাগজপত্রের কথা জানতে চাই যাতে আমি রুগির সঠিক রোগ নির্ধারণ করতে পারি বা রুগির চিকিৎসার বিভিন্ন পর্যায় চলাকালীন আমি তার জন্য কী করতে পারব না তা যেন বলতে পারি)। তাই আমার মনে হয় চিকিৎসাজনিত ছুটির পরে প্রত্যেকটি মানুষেরই তার নিজের কর্মজগতে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একজন থেরাপিস্ট যখন কঠোরভাবে না বলে তখন তাঁরা নিজের নীতিগত দায়িত্ববোধ রক্ষা করার জন্যই বলে। আমার মতে রিপোর্টের মূল্যই এক্ষেত্রে একমাত্র প্রধান, যার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে একজন থেরাপিস্ট আসলে কীভাবে রুগির চিকিৎসা করছেন।
ব্যাঙ্গালোরের দি টকিং ক্যাম্পাস-এর সাইকোলজিস্ট সেহেরাজাদি সিওভানের মতে-
থেরাপিস্ট হিসেবে যখন আমার কাছে একজন অনলাইনের মাধ্যমে কাউন্সেলিং করার কথা বলে তখন তাৎক্ষণিক যত্নের জন্য সমস্যার সমাধান হিসেবে আমি কী করতে পারি বা কী করতে পারি না, তা পরিষ্কারভাবে তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। কয়েকটি বিশেষ সমস্যা যেমন- প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়া যা মূলত সোমাটিক প্রকৃতির (মানুষের দেহের উপর যার প্রভাব পড়ে) এবং স্নায়বিক সমস্যা যার সঙ্গে মানসিক দিকটিও যুক্ত থাকে, এমন রুগিদের ক্ষেত্রে যথাযথ ওষুধের সঙ্গে অন্যান্য সহযোগী চিকিৎসারও যখন প্রয়োজন পড়ে তখন আমি সেই সব রুগিদের স্পষ্টভাবে বলি যে অনলাইনের মাধ্যমে সেই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আমার নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোকে আমি স্বীকার করি ও প্রয়োজনমতো অন্য আরেকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য রুগিকে সুপারিশ করে থাকি।
যদি আপনি বা আপনারা থেরাপির সাহায্য নিতে চান তাহলে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কথা অবশ্যই আপনাদের মনে রাখতে হবে এবং থেরাপিস্ট অন্য কোনওভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারেন কিনা সেই বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে কথা বলুন।
সেই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও অবশ্যই মনে রাখা জরুরি যে আপনাকে যে থেরাপিস্ট সাহায্য করছেন তাঁর কাজ আপনার পছন্দ হচ্ছে কিনা। এখানে কিছু প্রশ্ন থাকে, যেমন- কয়েকটা পর্যায়ের পর থেরাপিস্টের কাজ আপনার জন্য কি নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে (এক্ষেত্রে প্রথম প্রথম থেরাপিস্টের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে একটু সময় লাগে)? থেরাপিস্ট কি খোলামনে আপনার কথা শুনছেন?
থেরাপি চলাকালীন যে কোনও সময়ে যদি আপনার মধ্যে কোনও অস্বস্তিকর বোধ জাগে তাহলে তিনি কী করছেন এবং কেন করছেন- সেই প্রশ্ন করার সম্পূর্ণ অধিকার রুগি হিসেবে আপনার রয়েছে। যদি এই অস্বস্তি একনাগাড়ে চলতে থাকে তাহলে একসময়ে আপনাকেই বিচার করে দেখতে হবে যে ওই থেরাপিস্ট আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাটিকে বুঝতে পেরেছেন কিনা এবং তা সমাধানের জন্য ঠিকঠাক চিকিৎসা করছেন কিনা।