কল্যাণ

পাখি দেখাঃ উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে এক অপ্রত্যাশিত সহযোগী

যা কৌতূহলবশত শুরু হয়েছিল কিন্তু আমার উদ্বেগকে উড়িয়ে নিয়ে গেল

ডাঃ শ্যামলা বৎসা

২০০৬ সালে আমার প্রথমবার প্যানিক অ্যাটাক (গুরুতর উদ্বিগ্নতা) হয়। পরের আট বছর সার্বিক উদ্বেগ বিকারের সাথে আমার লড়াই চলে। অনেকবার এমন হয়েছে যে একই দিনে একাধিক বার আমার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে। যখন ওই পর্যায়ের উদ্বিগ্নতা অনুভব করতাম না তখন এই চিন্তা লেগে থাকত যে পরের অ্যাটাক কখন হতে পারে। কগনিটিভ বিহেভেরিয়াল থেরাপি (সিবিটি) এবং ওষুধের সাহায্যে উদ্বেগ থেকে আমি কিছুটা রেহাই পেয়েছিলাম। মোটামুটি কাজ চালানো জীবন ছিল তখন আমার।

নানা ধরনের পন্থার সাহায্য নিতে হত আমাকে। স্নান করার সময় বাথরুমের দরজার ছিটকিনি বন্ধ করতাম না (যদি ওখানে কিছু হয়ে যায়!) ফোন না নিয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরতাম না। এমনকি নিচে চিঠি এসেছে কি না দেখতে গেলেও ফোন সঙ্গে নিয়ে যেতাম। পিপাসায় মরে যাওয়ার ভয়ে সঙ্গে সবসময় জলের বোতল থাকত। ইয়ারফোন আমার শরীরের অভিন্ন অংশ হয়ে উঠেছিল। শহরের কোলাহলে আমি এতটাই বিচলিত হয়ে পরতাম যে সেই সমস্ত শব্দের থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সঙ্গীতের সাহায্য নিতে হত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে শুধু এমন জায়গায় যেতাম যেখানে আশেপাশে হাসপাতাল রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন হওয়া আমি এক মুহূর্তের জন্যও বরদাস্ত করতে পারতাম না। লিফ্‌ট, এস্কেলেটর আর লোকে ঠাসা সার্বজনিক যানবাহন এড়িয়ে চলতাম। স্বাভাবিক জীবন আমার কাছে এক অলীক স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

২০১৪ সালে আমি ৪৫ ঘণ্টার একটি খুবই কষ্টকর ট্রেন যাত্রা করি, মধ্য প্রদেশের গোয়ালিয়রে থাকা আমার বোনের বাড়ি যাওয়ার জন্য। শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে সে একটি মনোরম আবাসিক ক্যাম্পাসে থাকত। সকালবেলা চারপাশে কাঠবেরালিদের খেলাধুলোর মাঝে লনে বসে গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আমরা পাখি দেখতাম। বিকেলবেলায় ময়ূর দেখার তাগিদে আমি সাইকেলে চড়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতাম।

ছুটির সপ্তাহখানেক মধ্যে কৌতূহল আমার উপর ভর করল। আমি অনেকটা করে সময় ইন্টারনেটে কাটাতে শুরু করলাম বাড়ির চারপাশে দেখতে পাওয়া পাখিদের সনাক্ত করার জন্য। তাদের নাম আমি মুখস্ত করতে শুরু করি এবং ওই অঞ্চলে যেই পাখিদের সচরাচর দেখতে পাওয়ার যায় তাদের একটি তালিকা বানাতে শুরু করলাম। বাকি ছুটির দিনগুলি তাদের খোঁজে কেটে গেল। তালিকায় ৪২-টি পাখির নাম ছিল। আমি ২২-টিকে দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু তারপরে যা ঘটলো সেটাই ছিল আমার আসল জয়।

আমি অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠলাম। ভোরে উঠতে শুরু করলাম। হেডফোন ছাড়াই বাইরে যেতে শুরু করলাম যাতে পাখির ডাক শুনে তাদের খুঁজে বের করতে পারি। এমন মনে হতে লাগল যেন আমি এক সুক্ষভাবে আঁকা আলপনার দিকে চেয়ে রয়েছি। যত বেশি সময় ধরে পাখিদের খোঁজ করছিলাম, তত বেশি শান্ত অনুভব করছিলাম।

ধ্যান আমি কোনোদিন করিনি। আগে যতবার চেষ্টা করেছি, দেখেছি যে আমার মন আরও চঞ্চল হয়ে উঠত এবং আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পরতাম। নিজের ভাবনাচিন্তার সাথে একা থাকা আমার কাছে বিভীষিকার সমান ছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে পাখিদের দেখতে দেখতে আমি প্রথমবার সেই সচেতনতা অনুভব করলাম যার বিষয়ে অন্যদের কথা বলতে শুনেছিঃ স্থির, অবিচল থাকা এবং আক্ষরিক অর্থে শান্তি অনুভব করা।

বাড়ি ফেরার পর আমি আরও বেশি করে পাখি দেখতে থাকি। আমার সকাল-বিকেল ছাদে কেটে যেত এবং পাখি দেখার তাগিদে আমি ঘুরে বেড়াতে থাকি। পাখিদের টানে আমি পাহাড়, উপত্যকা, সমুদ্র সৈকতে ঘোরাফেরা করতে শুরু করি এবং আমার উদ্বিগ্নতা যেন ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিল।  

ক্লান্তির ভয় থাকা সত্ত্বেও আমি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে, অন্ধকারের ভয় সত্ত্বেও ক্যাম্পিং করতে এবং উচ্চতার ভয় সত্ত্বেও পাহাড়ে চড়তে শুরু করি। সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে শহরের থেকে দূরে চলে যেতে আমার ভালো লাগত। আমার ওষুধের ডোজ ক্রমশ কমে আসছিল এবং প্রথম প্যানিক অ্যাটাকের আগের জীবনে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। লক্ষ্য করিনি কখন আমি ছিটকিনি বন্ধ করে স্নান করতে শুরু করেছিলাম। অটোর বদলে বাসে ঘোরাফেরা করছিলাম এবং শারীরিকভাবে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। নতুন নতুন উপলব্ধি আমাকে আকৃষ্ট করছিল এবং এমন ঝুঁকি নিতে আমার আর ভয় করছিল না যা আগে আমার কাছে আতঙ্কের কারণ ছিল। ২০১৬ সালে আমি প্রথমবার একা ঘুরতে যাই চারদিনের জন্য এবং সেই সময় আমার একবারও ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।

এখন আমি যখনই কোথাও যাই, নিজের বাইনোকুলার এবং পাখির গাইডবুক আমার সঙ্গে থাকে। একটা ছোট খাতায় নতুন পাখিদের নাম লিখে রাখি। খাতার প্রত্যেক পাতা সাক্ষী যে আমি স্বস্তির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে কতটা দূর আসতে পেরেছি।

শহুরে পাখিরা আমাকে শহরে মুগ্ধ করে রাখে – তা সে বেঙ্গালোরের মেট্রো থেকে দেখা বামুনি চিল হোক, বা বিকেল চারটের সময় ঝুঁটি শালিকদের অপ্রত্যাশিত কোলাহল। পাখিরা আমাকে সাহায্য করে বর্তমান সময়ে নিজেকে ধরে রাখতে।

সাধারণ কৌতূহল রূপে শুরু হওয়া পাখি দেখার মতো একটি ঘটনার থেকে যে আমি এই ধরনের সুফল লাভ করব – শক্তি, ধৈর্য, অনুশাসন এবং সাহস নিজের মধ্যে খুঁজে পাব – এটা আমি কোনোদিন কল্পনা করিনি।