কল্যাণ

ফোটোগ্রাফি বা ছবি তোলা কি আপনাকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে?

ডঃ এডওয়ার্ড হফ্‌ম্যান

আপনি কি ক্যামেরা বা স্মার্টফোনে ছবি তুলতে ভালোবাসেন? যদি তাই হয় তাহলে আপনি একটা আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার মতো বিষয় জানেন কি যে ছবি তোলার গুরুত্ব যতখানি না মানুষের হবি বা শখের কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়, তার থেকে তা অনেক বেশি মূল্য পায় একজন মানুষের সুস্থতা বজায় রাখতে? সম্ভবত আত্মোপলব্ধির মাধ্যম হিসেবে কি ফোটোগ্রাফিকে অগ্রাধিকার দেওয়া চলে? 

এসব প্রশ্নগুলো ইদানীং ইতিবাচক মনস্তত্ত্বের আলোচনায় বারবার সামনে আসছে। এই বিষয়টি এখন হলিউডেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। 'দ্য সিক্রেট লাইফ অফ ওয়াল্টার মিট্টি' সিনেমায় শন ও' কোনেল, যিনি ছিলেন একজন রহস্য-রোমাঞ্চক আলোকচিত্র গ্রহণকারী সাংবাদিক বা ফোটো জার্নালিস্ট (সিনেমায় অভিনয় করেছেন শন পেন)। তাঁর সঙ্গে ছিলেন খুবই নিস্তেজ, অফিসমুখো একজন কর্মী ওয়াল্টার। বছরখানেক ই-মেইলের মাধ্যমে দু'জনের যোগাযোগের পর শেষমেশ হিমালয় পর্বতের চুড়োয় তাদের দু'জনের দেখা হয়। ওয়াল্টার, যিনি ছিলেন একজন দিবাস্বপ্ন দেখা মানুষ। সেই মানুষের মধ্যেই সিয়ানের বার্তা অনুসারে একপ্রকার আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং সে বরফের দেশের লেপার্ডের ছবি তোলে। সেই সঙ্গে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থেকে মনোরম মুহূর্তটিকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করেছিল সে।

এধরনের অর্থবহ ও জনপ্রিয় ছবি তোলার ধারণার পথপ্রদর্শক হলেন মাইনর হোয়াইট, যিনি ১৯৪০ সালে এই নিয়ে পড়াশোনা করে কিছু কৃতী মানুষের শৈল্পিক চিত্ররূপ এঁকেছেন। এই ছবিগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছেন অ্যালফ্রেড স্টিগলিটজ্‌, অ্যান্সেল অ্যাডামস্‌ এবং এডওয়ার্ড ওয়েস্টন। হোয়াইট মূলত স্টিগলিটজ্‌-এর 'সমানাধিকার' ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই ধারণায় একটা আলোকচিত্রকে মানুষের মানসিক অবস্থার দৃশ্যমান চিত্ররূপ বলে মনে করা হয়। পরবর্তীকালে এমআইটি-র শিক্ষক হিসেবে তিনি মানুষের জীবনে ফোটোগ্রাফির অর্থবহতা এবং গভীর তাৎপর্য ছাত্রদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। মাইনর হোয়াইটের পরামর্শ ছিল ততক্ষণ নিজেকে স্থির রাখতে হবে যতক্ষণ না নিজের উপস্থিতি কোনও বস্তুর মনোযোগ আকর্ষণ করছে। সেই সঙ্গে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, ''নিষ্পাপ চোখের একটা নিজস্ব গুণ রয়েছে। এর মানে হল সেই চোখ অনেকটা শিশুর চোখের সঙ্গে তুলনীয়। সেই চোখের চাহুনিতে থাকে একপ্রকার সপ্রতিভ ভাব এবং বিস্ময় প্রাপ্তি...''

ফোটোগ্রাফি সম্পর্কে গবেষণা তেমনভাবে না হলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে ফোটগ্রাফির ব্যবহার উত্তরোত্তর বাড়িয়ে চলেছেন। ২০০৮ সালে  নরওয়েতে ফোটোথেরাপি এবং থেরাপিউটিক ফোটোগ্রাফি সংক্রান্ত প্রথম আর্ন্তজাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন আর্ট থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট এবং সোশ্যাল ওয়ার্কাররা। এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জুডি উইসার। তাঁর বই 'Phototherapy Techniques'-এ দেখানো হয়েছে যে ফোটোগ্রাফির টেকনিক বা কৌশলগুলোকে কীভাবে ব্যক্তিগত ছবি তোলা, পারিবারিক ছবির অ্যালবাম এবং অন্যের দ্বারা তোলা ছবির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হয়। সেই সঙ্গে এই কৌশলের সাহায্যে আত্ম-প্রতিফলন এবং থেরাপিউটিক যোগাযোগের উন্নতি করাও সম্ভব হয়। গোড়ার দিকে বয়স্ক শিক্ষা ও কর্মশালার ক্ষেত্রে আর্ট থেরাপির শাখা বা অনুষঙ্গ হিসেবে ফোটোগ্রাফিকে মানুষের ভালো থাকার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার জনপ্রিয়তা গড়ে উঠেছিল। এইধরনের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল যে ফোটো বা ছবি কীভাবে মানুষের অর্ন্তনিহিত সত্ত্বা বা অর্ন্তদৃষ্টির দৃশ্যমানতাকে বাইরে প্রকাশ করতে পারে, মানুষের ইতিবাচক স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে, তার সৃষ্টিশীলতার উন্নতি ঘটাতে পারে এবং মানুষের পারস্পরিক বন্ধন শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

অর্থবহ ফোটোগ্রাফিকে ক্লাসরুমে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- প্রজেক্টের  মাধ্যমে বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়ার যে ব্যবস্থা রয়েছে তার সঙ্গে তাদের সুস্থতার ধারণা জড়িত থাকে। আয়ারল্যান্ডের ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক ডিআরএস সাওয়ার্স গ্যাবহাইন এবং জেন সিক্সস্মিথ ৮ থেকে ১২ বছরের বাচ্চাদের দিয়ে 'তাদের পছন্দমতো জিনিস'-এর ছবি তোলার আয়োজন করেছিলেন। পরে তারই রেশ ধরে আরও ভিন্ন ধরনের ছবি তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যেমন- 'সেই মানুষ, যাকে একজন সবচাইতে বেশি ভালোবাসি', 'খাদ্য ও পানীয়' এবং 'পশু বা  পোষ্য'। গবেষকদের মতে, ফোটোগ্রাফি প্রমাণ করেছে যে ভালো থাকা বা সুস্থতার ক্ষেত্রে সে একটি কার্যকরী মাধ্যম। ইংল্যান্ডের সিফিল্ড হাল্লাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডাক্তার অ্যানে কেলক গরিবদের মধ্যে ছবি তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন, নিউজিল্যান্ডের মাওরি ৮ থেকে ১০ বছর বয়সি বাচ্চাদের জীবনে ছবি তোলার গুরুত্ব নির্ধারণ করতে সাহায্য করেছিলেন। মনোবিদরা বয়সে বড় শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও ফোটোগ্রাফি ব্যবহার করার জন্য অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নেন।

সম্প্রতি কলেজে নির্দেশ দেওয়ার জন্য রচিত হ্যান্ডবুকে জেমস ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডিআরএস জেইম কার্টজ এবং রিভারসাইডের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সোনিয়া লাইবোমার্স্কি সুপারিশ করেছেন যে  প্রাত্যহিক জীবনে যা কিছু একজন ছাত্রকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয় সেইসব কিছুর ছবি একজন ছাত্রের তোলা উচিত। এরপর তাদের যৌথ আলোচনার মধ্য দিয়ে ফলাফল বিচার করা জরুরি।

বহুল ব্যবহৃত স্মার্টফোনের ক্যামেরা কি মানসিক সুস্থতা বাড়াতে সাহায্য করে? সাম্প্রতিককালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডক্টর ইয়ু চেন এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কলেজের ছাত্রদের একমাস ধরে প্রতিদিন নিম্নলিখিত তিনটি বিষয়ের উপরে এক-একটা দলকে ছবি তুলতে বলা হয়েছিল- নিজের  হাসিমুখের ছবি বা সেলফি, এমন কিছু জিনিসের ছবি যা তাদের আনন্দ দেয় বা এমন কিছু ছবি যা তারা বিশ্বাস করে যে অন্যদের আনন্দ দেবে এবং তখন সেই ছবি তাদের পাঠিয়ে দিতে হবে। তিনমাস পরে এই তিনটি দলের  অংশগ্রহণকারীদেরই মেজাজ-মর্জির তাৎপর্যপূর্ণভাবে উন্নতি ঘটেছিল। এছাড়া যারা তাদের তোলা ছবি অন্যদের পাঠিয়েছিল তারা এই ঘটনায় খুবই শান্ত ছিল এবং  উপকৃত হয়েছিল। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেনি। এই ফলের জন্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ মানসিক উদ্বেগ ও অবসাদের পিছনে মানুষের নিজের উপর অতিরিক্ত আলোকপাত করার প্রবণতা থাকে। হিউম্যানিস্টিক সাইকোলজির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্রাহাম মাসলো-র মত হল একজন ব্যক্তি এককভাবে এই পৃথিবীতে মানসিক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি সহ্য করে।

স্মার্টফোনে ছবি তোলা একাধারে সহজ এবং উত্তেজনাময়। এই বিষয়ে কিছু সতর্কবাণীও রয়েছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন ফেয়ারফিল্ড  বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডাক্তার লিন্ডা হেঙ্কেল। তিনি দেখিয়েছেন যে কমবয়সি ছেলে-মেয়ে যারা মিউজিয়ামে গিয়ে গয়নাগাটি, শিল্প, স্থাপত্য, মাটির দ্রব্যের ছবি তোলে তাদের স্মৃতিশক্তি প্রথমদিনের চাইতে দ্বিতীয়দিনে অনেক দুর্বল হয়ে যায়। তখন তারা তাদের তোলা ছবিকে শুধু আন্দাজের উপর বিচার করার চেষ্টা করে। আশ্চর্যজনকভাবে এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে যেসব ছাত্ররা সরাসরি ছবি না তুলে ছবির কোনও একটা অংশকে বড় করে দেখেছিল তাদের মনে সমগ্র ছবিটা অনেক স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল।

এই ঘটনার ব্যাখ্যা কী হতে পারে? ডাক্তার হেঙ্কেল-এর মতে সহজভাবে একটা বস্তুর বা দৃশ্যের ছবি তুলতে হবে। সেটা আদৌ সুন্দর হল কিনা তা না ভাবলেও চলবে। সেই মূহুর্তে ওই কাজের উপর আমাদের মনোযোগের অন্য কোনও বিকল্প নেই। এই গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে যে আজকের ডিজিটাল ফোটোগ্রাফি সনাতন প্রিন্টিং ফোটোগ্রাফির চাইতে অনেক বেশি অগ্রবর্তী। তাই সেই ছবিগুলোকে একটা স্ক্র্যাপবুকে আটকে তা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলে দেখা জরুরি। হেঙ্কেল-এর কথায়, ''যদি মনে রাখার জন্য আমরা ক্যামেরার উপর ভরসা রাখি তাহলে আমরা অতিরিক্ত পদক্ষেপ করে আবার ছবিগুলোকে ভালো করে দেখার সুযোগ পাব।''

আমাদের করণীয়

প্রথমে একটি নির্দিষ্ট বিষয় বাছতে হবে। যেমন- পশুপাখি, মানুষ বা শিল্প-স্থাপত্য এবং সেগুলোর ছবি খুব যথাযথ ও সুন্দরভাবে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে সচেতন হতে গেলে নীচের পরামর্শগুলো মেনে চলা জরুরি -

১. চোখ ও মনের সঙ্গে মানানসই রঙ বাছতে হবে। তাই এমন রঙিন দৃশ্য বাছতে হবে যাতে তার সংস্পর্শে যাওয়া যায়।

২. ছবির টেক্সচার এমন হওয়া উচিত যা আলোর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। কল্পনা করতে হবে যা মানুষ চোখে দেখছে তা যেন ছোঁওয়া যায়।

৩. যখন মানুষের ছবি তোলা হবে তখন বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের দিয়ে শুরু করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তাদের ভালো ছবি তোলার জন্য তাদের দিক থেকে বারবার বাধা আসতে পারে। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা দরকার। তাহলেই ছবিতে সেই মূহূর্তে তাদের যথাযথ উপস্থিতি ধরা পড়তে পারে।

প্রবন্ধটি লিখেছেন ডঃ এডওয়ার্ড হফম্যান। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক। প্রাইভেটে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি অনুশীলন করার জন্য তাঁর ছাড়পত্র রয়েছে। মনস্তত্ত্ব বা সাইকোলজি এবং সেই সংক্রান্ত ২৫টির বেশি বই তিনি লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন। সম্প্রতি ডাক্তার উইলিয়ম কম্পটনের সহযোগী লেখক হিসেবে হফম্যান 'Positive Psychology: The Science of Happiness and Flourishing' নামক বইটি লিখেছেন। এছাড়া পজিটিভ সাইকোলজি এবং হিউম্যানিস্টিক সাইকোলজি নিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় সম্পাদনার কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য এই ঠিকানা ব্যবহার করা যেতে পারে- columns@whiteswanfoundation.org