একজন সঠিক থেরাপিস্টকে খুঁজে পাওয়া হল একটি আরামদায়ক ও টেঁকসই জুতো খুঁজে পাওয়ার মতন। জীবনের পথে আমরা যত এগোই, তত আমাদের মনে, ঠিক পায়ের মতোই, ছোট-বড় নানান রকম আঘাত লাগে। কথায় বলে যে পায়ে আঘাত লাগলে সারতে সময় লাগে সবচেয়ে বেশি। কারণ আমরা পা সবসময়েই ব্যবহার করি। আমাদের মনের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। আমাদের মন আমরা সবসময় এবং একটানা ব্যবহার করি। আমরা ঘুমিয়ে থাকলেও আমাদের মন ও মস্তিষ্ক আংশিক ভাবে সজাগ থাকে। কাজেই মনের চিকিৎসায় সময় লাগে এবং থেরাপিতে রাতারাতি কোনও সুফল দেখা যায়না। সামান্য উন্নতির জন্যেও অনেক সময় অনেকগুলো সেশনের দরকার পড়ে। অতএব সেই সময়টার জন্য একজন সঠিক থেরাপিস্টকে খুঁজে পাওয়া অপরিহার্য্য।
একজন থেরাপিস্ট আমাদেরকে সেই জায়গাটা দেন যেখানে নিরাপদে, নিঃসংকোচে, মন খুলে নিজের কষ্টগুলো বলা যায়। ভাল থেরাপিস্ট দূরদর্শী, বুদ্ধিমান, সহানুভূতিশীল ও উৎসাহী হন। একটা বাজে জুতো যেমন পায়ের চোট অনেকটা বাড়িয়ে দেয়, সেইরকম একজন ভুল থেরাপিস্টের মাধ্যমেও হিতে বিপরীত হতে পারে। আপনি থেরাপিস্ট নির্বাচনের পূর্বে নিম্নলিখিত কথাগুলি মাথায় রাখতে পারেন।
একজন দক্ষ থেরাপিস্ট বাছুন, সুবিধাজনক নয়।
খরচ এবং সুবিধা নিশ্চয়ই মাথায় রাখবেন, কিন্তু তাই বলে প্রয়োজনীয়তাকেও উপেক্ষা করলে চলবে না। মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়া খুবই জরুরি, কারণ মানসিক অসুস্থতা আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মেও প্রভাব ফেলে।
নিজের বাড়ির কাছাকাছি এবং নিজেই সময় অনুযায়ী থেরাপিস্ট বেছে নেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু এইগুলোই একমাত্র মাপকাঠি নয়। মানুষের জীবনে পড়াশুনো বা চাকরির চাপ থাকবেই, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে থেরাপি শুধুমাত্র অবসর সময়ের জন্য নয়। আপনাকে হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও নিজের যত্ন নেওয়ার সময় বের করে নিতে হবে। থেরাপিতে আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন, কাজেই গুগল করে প্রথম যে নামটা পেলেন সেটা বেছে নেওয়া বা পরিচিত কারোর পরামর্শে বিনা খোঁজখবরে কোনও থেরাপিস্টের কাছে চলে যাওয়াটা হয়তো সহজ, কিন্তু শ্রেয় নয়। সময় বার করে একটু মনোযোগ সহকারে থেরাপিস্ট নির্বাচন করতে পারলে আখেরে আপনারই লাভ। আমাদের দেশে দক্ষ থেরাপিস্টের অভাব রয়েছে। সেই জন্য আপনি চাইলে অনলাইনে কাউন্সেলিং করিয়ে দেখতে পারেন, যাতে আপনার ঠিকানা আপনার চিকিৎসায় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
সঠিক মনচিকিৎসার ক্ষেত্রে খরচ বেশি হলেও আগামী দিনে এর লাভ সুদুরপ্রসারী। এটিকে আপনি বাজে খরচের খাতায় না দেখে বরং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে পারেন। থেরাপিস্টের ফি সাধারনত তাঁর অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। ফি বেশি হলেই যে তিনি ভাল হবেন তার যেমন কোনও মানে নেই, তেমনই কম খরচের একজন অনভিজ্ঞ থেরাপিস্ট আপনার লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি করতে সক্ষম।
সার্বজনিক রূপে ভাল থেরাপিস্ট বলে কিছু নেই; নিজের জন্য সঠিক কাউকে বেছে নিন।
একই জুতো যদি দু’জনে পরে, তাদের স্বাচ্ছন্দ্য বোধের অভিজ্ঞতা আলাদা-আলাদা হবে। আমাদের পায়ের মাপ, পছন্দ, আঘাতের স্থান - সবই আলাদা হয়। হয়ত অনেকগুলো জুতো পায়ে গলিয়ে দেখার পর একটা আমাদের পছন্দ হয়। সেই রকমই, নিজের জন্য থেরাপিস্ট নির্বাচনের আগে কয়েকজনের সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। তাহলে হয়ত আপনি ঠিক কি চাইছেন সেটা বুঝে যাবেন। অধিকাংশ থেরাপিস্টের ওয়েবসাইটেই তাঁদের কাজের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বলা থাকে। আপনার উচিৎ যে একটু সময় বের করে এইগুলি দেখে নেওয়া। এবার পরের প্রসঙ্গে আসছি।
নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের উপরে ভরসা রাখুন
থেরাপিস্টের সাথে প্রথম সাক্ষাতের আগে বা পরে আপনার কেমন অনুভূতি হচ্ছে সেটা দেখুন। তাঁর সাথে কি সহজেই কথা বলা যায়? তাঁর সাথে মুখোমুখি/ইমেলে কথা বলার আগে/সময়/পরে আপনার কী মনে হচ্ছিল? উনি কি আপনাকে সমালোচনার চোখে দেখছিলেন? আপনার যেটা মনে হবে সেটাকে বিশ্বাস করুন। পাশাপাশি এটাও মনে রাখবেন যে থেরাপি কিন্তু রাতারাতি আপনাকে সারিয়ে তুলবে না। কাজেই প্রথম কয়েকটা সেশনের পরেই আপনি নিজের মধ্যে বিশাল কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন না। কিন্তু প্রথম কয়েকটা সেশনের পরেও যদি আপনার মনে হয় যে আপনি তাঁর সাথে ঠিক করে কথা বলতে পারছেন না বা তাঁকে সবকিছু খুলে বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন না, তাহলে হয়ত তিনি আপনার জন্যে সঠিক নন। সেক্ষেত্রে তাঁকে সমস্যাটা খুলে বললে এর কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। মনে রাখবেন যে আপনার থেরাপিস্টকে সবকিছু ঠিকমত জানালে তবেই আপনাদের মধ্যে এক সুষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠবে, এবং তাঁর কাজের ধরন সম্পর্কেও আপনার সঠিক ধারণা তৈরি হবে।
তাঁর তাত্ত্বিক বোধকে উপলব্ধি করুন
তাত্ত্বিক বোধ হল একজন থেরাপিস্টের কাজের পদ্ধতি যার মাধ্যমে তিনি আপনার মানসিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করবেন। কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি সংক্রান্ত মূলত দু'টি চিন্তাধারা রয়েছে – সমাধান ভিত্তিক এবং উপলব্ধি ভিত্তিক। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ধরা যাক কেউ যদি ধূমপান ছাড়তে চান, তাহলে তাঁকে একজন থেরাপিস্ট বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করতে পারেন। যে থেরাপিস্টের কাজের পন্থা সমাধান ভিত্তিক, যেমন একজন সিবিটি প্র্যাকটিশনার, তিনি হয়ত সেই ব্যক্তির মানসিকতা পাল্টানোর চেষ্টা করবেন, তাঁর পরিবেশ ও সঙ্গীদের ব্যাপারে বুঝতে চাইবেন বা তাঁর মধ্যে সিগারেট নিয়ে বিতৃষ্ণা তৈরি করতে চাইবেন (অ্যাভার্সন থেরাপি)। অর্থাৎ এই পদ্ধতিটি সমস্যা এবং তার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে সরাসরি কাজ করে।
একজন উপলব্ধি ভিত্তিক থেরাপিস্ট হয়ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সিগারেট খাওয়ার পেছনে গভীর মানসিকতাটি বুঝতে চাইবেন। এর জন্য তাঁকে সেই ব্যক্তির অবদমিত এবং অবচেতন ইচ্ছা ও মানসিকতাকে বুঝতে হয়। সেই জন্য তাঁকে ব্যক্তির ইন্ট্রাসাইকিক ডাইনামিক্স ও মানসিকতার ব্যাপক বিশ্লেষণ করতে হয় এবং তার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্পর্কের টানাপোড়েন বা স্মৃতির যন্ত্রণাকে বুঝতে হয়, যাতে তার নেশার কারণ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এটা অনেকটা আতস কাঁচ দিয়ে আমাদের মনের ভেতরটা দেখে এলোমেলো চিন্তার মাঝখানে একটা ধরন খুঁজে পাওয়ার মতন, যাতে সেই ব্যক্তিকে ধ্বংসের পথে হাঁটার থেকে বাঁচানো যায়।
যোগ্যতা, যোগ্যতা, যোগ্যতা
দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রে কোনও নিয়ন্ত্রণ আধিকারিক না থাকার কারণে আমাদের দেশে বহু অযোগ্য ব্যক্তিই নিজেকে কাউন্সেলর বলে দাবি করেন। কাজেই কোনও কাউন্সেলরের কাছে যাওয়ার আগে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করুন। অন্ততপক্ষে তাঁর কোনও স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে স্নাতকউত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রী থাকা উচিৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম থাকলে সেখানের ছাত্ররাও কৃতি হয়। প্রয়োজন হলে দেখুন যে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আদৌ এই বিষয়টি পড়ানো হয় কি না। অনলাইন ডিগ্রির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থেরাপিস্টের উপরে ভরসা না করাই ভাল কারণ তাঁর হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নাও থাকতে পারে। সেই রকম পরিস্থতিতে, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে উনি চিকিৎসা করতে পারেন না। ভারতে অনেক প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কাউন্সেলিংয়ের ‘সার্টিফিকেট’ বা ‘ডিপ্লোমা’ পাওয়া যায়। কিন্তু মনে রাখবেন সেগুলো কোনও মতেই ডিগ্রির সমান নয়। একই রকম ভাবে বহু মনোবিদ সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি করতে পারেন না।
নীতি
থেরাপিস্টদের কাজে নীতিই হল আসল কথা। ক্লায়েন্টের বলা কথাবার্তার গোপনীয়তা বজায় রাখা তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যা বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া কখনই প্রকাশ করা উচিৎ না (ব্যক্তি আত্মহত্যাপ্রবণ হলে, কারও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, আইনি জটিলতা ইত্যাদি)। প্রয়োজন না হলে একজন ভাল থেরাপিস্ট কখনই আপনার পরিবারের সদস্যদের কাছে, আপনার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বা তাঁর পরিচিত কোনও অপেশাদার ব্যক্তির কাছে আপনার সেশনের অন্তরঙ্গ বিবরণ নিয়ে আলোচনা করবেন না। একজন ভাল থেরাপিস্ট তাঁর ক্লায়েন্টকে কখনও সন্দেহের চোখে দেখেন না, উৎসাহ দেন, এবং ক্লায়েন্টকে আগের মতন হয়ে ওঠার শক্তি যোগান। আপনার উচিৎ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির, যেমন এ.পি.এ (আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) বা বি.এ.সি.পি (ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর কাউন্সেলিং অ্যান্ড সাইকোথেরাপি), নীতি নিয়মাবলী জেনে রাখা, যাতে আপনি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারেন।
থেরাপি মানে বন্ধুত্ব না
ভাল থেরাপি মানে বন্ধুত্ব না - এটা শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানো বা তাঁর কথা মন দিয়ে শোনা না। কারণ এতে পরামর্শ দেওয়া বা মতামত দেওয়ার জায়গা নেই। অনেক সময় থেরাপি আমাদের সামনে আয়নার মতন কাজ করে, যার ফলে আপনার ভাল নাও লাগতে পারে। বন্ধুরা আপনাকে চেনেন বলে অনেক সময়ই এই রকমটা করতে পারেন না। অন্যদিকে থেরাপিস্ট মন দিয়ে সহানুভূতির সাথে আপনার কথা শোনার পাশাপাশি জটিল মনস্তত্বও মাথায় রাখেন, এবং আপনার চিন্তার ধরন বোঝার চেষ্টা করেন। তাঁর কাজই হল আপনার জন্যে একটা নিরাপদ জায়গা তৈরি করে দেওয়া যেখানে আপনি নিঃসংকোচে আপনার মানসিক কষ্টকে প্রকাশ করতে পারেন। ভাল থেরাপি মানে হল যেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেকে সরিয়ে তোলেন, থেরাপিস্ট শুধু সাহায্য করেন মাত্র।
রিয়া গান্ধী এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়, স্কটল্যান্ড থেকে প্রশিক্ষিত একজন সাইকোথেরাপিস্ট এবং গবেষক। উনি মুম্বইয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন এবং সাইকোডাইনামিক আর ব্যক্তি-কেন্দ্রিক তাত্ত্বিক ওরিয়েন্টেশন নিয়ে কাজ করেন।