আমাদের মধ্যে অনেকেই যোগের শারীরিক উপকারিতার বিষয়ে জানেন – যোগাভ্যাস আমাদের শরীরকে শক্ত করে, নমনীয় করে, সহ্যশক্তি বাড়ায় ও সামগ্রিক কুশলতা বাড়ায়। এর ফলে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হয় যে যোগাভ্যাসও এক ধরণের ব্যায়াম। যদিও, যোগের দ্বারা শারীরিক দিক দিয়ে সুস্থ থাকাটা বিগত কিছু শতক ধরে গুরুত্ব পেলেও এর মূল লক্ষ্য হল মন বা মস্তিস্কের সুষম গঠন ও তাকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ধ্যান ও অন্যান্য মনোযোগ বাড়ানোর যোগাভ্যাস অনুশীলনে মনকে নিয়ন্ত্রিত করা যায়। “পতঞ্জলি বুঝিয়েছেন যে যোগ হল মনের ওষুধ আর যোগাভ্যাসের লক্ষ্য হল মনের ওপর প্রভাব বিস্তার। যোগের ফলে আমাদের শরীরিক স্বাস্থ্যের অনেক উপকারিতা দেখা গেলেও যোগাভ্যাস মস্তিস্কের পক্ষেও ভীষণ উপকারি। এর ফলে স্ট্রেস বা চাপ কমে, মনঃসংযোগের উন্নতি ঘটে, গ্রে ম্যাটার-এর সংখ্যা বাড়ে ও নতুন নিউরাল পাথ্ওয়ে তৈরী হয়; এছাড়াও, যোগাভ্যাস অবসাদ, স্কিৎজফ্রেনিয়ার মত স্নায়বিক অসামঞ্জস্য জনিত রোগেও খুবি উপযোগী,” বলেন ডাঃ শিবরাম ভরম্বল্লী, নিমহ্যান্সের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অতিরিক্ত অধ্যাপক।
যোগ কি আমার মস্তিস্কের উপকার করবে?
এটা সবাই জানেন যে, যোগের ফলে স্ট্রেস বা চাপ কমে, বয়স জনিত অবক্ষয়ও কম হয়। এর ফলে আপনার স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি পায় ও আপনার বিচারবুদ্ধিকে বাড়িয়ে তোলে। এতে মস্তিস্কে বা মাথায় রক্ত চলাচল বাড়ে যার ফলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমে, বিশেষতঃ যাঁদের ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ কোলেস্টরল আছে। যোগের ফলে আপনার হৃত্স্পন্দন কমে স্বাভাবিক হয়ে যায়, এছাড়া, এটা আপনাকে কঠিন অবস্থাতেও শান্ত ও যুক্তি-সংগত থাকতে সাহায্য করে। এর ফলে, দীর্ঘ সময় ধরে চলা কোন কাজের সময়েও আপনাকে আপনার লক্ষ্যে অবিচল থাকতে সহায়তা করে।
এর প্রভাব বুঝতে ঠিক কতটা সময় লাগে?
যোগাসনের একটা অধিবেশনও অনেক সময় মস্তিস্কের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। আপনার মানসিক কুশলতার উন্নতি প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা যায়, আপনি আগের থেকে অনেক ভালো অনুভব করতে থাকেন ও অনেক শান্ত হয়ে যান, যেকোন বিষয়ে আপনার নিজেকে অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসী লাগে, এবং চাপ বা স্ট্রেস্-এর অনুভূতিও অনেক কমে যায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আপনি বুঝতে পারেন যে আপনি খুব তারাতাড়ি যে কোনও বিষয় বুঝে নিতে পারছেন, স্মৃতিশক্তি, মনঃসংযোগ বেড়ে যাওয়ায় ও লক্ষ্যে অবিচল থাকার জন্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সপ্তাহে কমপক্ষে তিন দিন করে একটানা ছ মাস যোগাভ্যাস করলে খুব ভালো দীর্ঘমেয়াদী ফল পাওয়া যায়। মনঃসংযোগের লক্ষ্যে স্থির থাকার জন্য এবং সবথেকে বেশী যুক্তিযুক্ত বিচার বিবেচনা লাভের জন্য যোগাভ্যাস করার কথা ভাবতে পারেন।
মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কমায়
আমাদের নার্ভাস সিস্টেমের যে অংশটি আমাদের বিশ্রাম ও কাজের কলাকৌশল নিয়ন্ত্রণ করে, যোগ তার সামঞ্জস্য বজায় রেখে চাপ ও দুশ্চিন্তাকে কম করে।
সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে দু’টো ভাগ আছেঃ সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম ও প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম। প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেম আমাদের শরীর ও মন যখন কর্মক্ষম থাকে, বিপদের সময় ঠিক কি করা উচিত তা নিয়ন্ত্রণ করে। সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম আমাদের হৃত্স্পন্দন কমিয়ে আমাদের শান্ত করে ও বিশ্রামের জায়গাতে ফিরে যেতে সাহায্য করে। এই দুই সিস্টেমের কাজের সামঞ্জস্যে আমাদের শরীর স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রার চাপ ও অতিরিক্ত উত্তেজনা সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের কাজ বাড়িয়ে দেয় যার ফলে এই দুই সিস্টেমের মধ্যে অসামঞ্জস্য তৈরী হয়। নিয়মিত যোগাভ্যাস প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমের কাজ করা বাড়িয়ে দেয়, যা শ্বাসক্রিয়া, হৃত্স্পন্দন স্বাভাবিক করে তোলে এবং চাপ ও দুশ্চিন্তাকে কমিয়ে দেয়।
স্মৃতি শক্তি ও চিন্তা শক্তির উন্নতি ঘটে
আপনি কি জানেন যে, নিয়মিত যোগাভ্যাস আপনার মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার-এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়? ব্রেনের সবথেকে জটিল অংশ (হিপোক্যাম্পাস) যা স্মৃতি শক্তি ও বিচার বুদ্ধির জন্য দায়ী তা যত বয়স বাড়ে ততই ছোটো হতে থাকে; এই কারণেই আমরা ভুলে যেতে থাকি, অথবা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের বুদ্ধিমত্তাও কমতে থাকে।
ব্যাঙ্গালুরুর নানান বৃদ্ধাবাসে বসবাসকারীদের ছ’মাস যোগাভ্যাসের পর ব্রেন্রের ওপর যোগের প্রভাব জানার জন্য নিমহ্যান্স একটা সমীক্ষা চালায়। যেখানে গবেষকরা দেখেন যে, নিয়মিত যোগাভ্যাস বয়সের প্রভাবকে বিপরীতমুখী করে ও হিপোক্যাম্পাস-এর সাইজ বৃদ্ধি পায়। তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে, যাঁদের আগে থেকেই ডিমেনশিয়ার কারণে সামান্য বিচার-বুদ্ধির দুর্বলতা রয়েছে, তাঁদের জন্যও যোগাভ্যাস যথেষ্ট উপযোগী এবং এটা এই জিনিসের পুনর্বার হওয়াও রোধ করে।
মস্তস্ককে সুস্থ করে
মস্তিস্ক হল এমন একটা অঙ্গ যার নিজেকে সুস্থ করে তোলার একটা আশ্চর্য্য ক্ষমতা রয়েছে। একজন ব্যক্তি, যিনি, ব্রেন বা মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছেন, সাময়িকভাবে কিছু সময়ের জন্য কিছু কিছু কাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন যেহেতু সেই সময় মস্তিস্কে আঘাতপ্রাপ্ত অংশকে সারিয়ে তোলে বা সেই কাজ গুলো অন্য অংশে সরিয়ে দেয়।
ব্রেন ডিরাইভড্ নিউরোট্রপিক ফ্যাক্টর (বি ডি এন্ এফ্)-এর দ্বারা ব্রেনের স্থিতিস্থাপকতা (প্ল্যাস্টিসিটি) বা নিজেকে সারিয়ে তলার ক্ষমতাকে মাপা হয়। একজন মানুষের বি ডি এন্ এফ্ যত বেশী, তাঁর মস্তিস্কের নিজেকে সারিয়ে তোলার ক্ষমতাও তত বেশী।
যিনি অবসাদ বা বাইপোলার ডিস্অর্ডারে ভুগছেন তাঁদের বি ডি এন্ এফ্ খুব কম হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে কর্টিসল্ বা স্ট্রেস্ হরমোনের পরিমাণটা অনেক বেড়ে যায়। যখন, ওষুধের দ্বারা তাঁদের অবসাদের চিকিৎসা করা হয়, ডিপ্রেশন্ হয়তোবা ভালো হয় এবং বি ডি এন্ এফ্ ও বেড়ে যায়। কিন্তু যদি তাঁরা একবার ওষুধ বন্ধ করেন, তাঁর ক্ষেত্রে ঐ রোগের ফিরে আশার সম্ভাবনা থেকে যায় যেহেতু স্ট্রেস্ ও কর্টিসল্ এর লেভেল অনেক বেশী থাকে।
নিমহ্যান্স ইনটিগ্রেটেড সেণ্টার ফর্ যোগার একটা গবেষণাতে দেখা গেছে যে, অবসাদের রগীকে ওষুধ ছাড়া যদি শুধু যোগাভ্যাস করানো হয় তাহলে তাঁদের বি ডি এন্ এফ্ স্বাভাবিক হয় ও কর্টিসল্-এর মাত্রা কমে আসে। এ থেকে বোঝা যায় যে, স্ট্রেস্ কমে যাবার ফলে এই একই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
না-বাচক আবেগকে কমায়
দিনে পাঁচ মিনিট “ওম্” মন্ত্র জপ করলে তা মস্তিস্কের যে অংশগুলো না-বাচক আবেগ যেমন, স্ট্রেস্, রাগ, হিংসা বা ঘৃণা, এগুলোর জন্য দায়ী সেই অংশে রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়।
নিমহ্যান্স আয়োজিত কার্যকরী এম্ আর্ আই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে একজন মানুষ যিনি যোগাভ্যাস করেন না তাঁকে “ওম্” জপ করতে বলা হয় পাঁচ মিনিটের জন্য, ও পরে, সাধারণ অবস্থাতে আরও পাঁচ মিনিট জপ করতে বলা হয়। স্ক্যানে দেখা যায় যে মস্তিস্কের অন্যান্য অংশের থেকে যে অংশ আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে রক্ত প্রবাহ কম। এর থেকে বোঝা যায় যে, বিভিন্ন ধরণের মন্ত্র যা যোগ বা ধ্যানের দ্বারা মনকে সংযত করার জন্য দেওয়া হয়, তা নিয়মিত অভ্যাস করলে না-বাচক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মুখ দেখে মনের ভাবকে বোঝার ক্ষমতার উন্নতি
স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে যোগের ফলে তাঁদের মুখ দেখে মনের ভাব বোঝার ক্ষমতা বেড়ে গেছে। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীদের মুখ দেখে মানুষের মনের ভাবকে বুঝতে অসুবিধা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা হয়তো বা নিরপেক্ষ বা নিশ্চিত মুখের ভাবকে রাগ বা ভয় বলে ভুল করতে পারেন।
নিমহ্যান্স আয়োজিত এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে যোগাভ্যাস স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীদের এই অক্ষমতা থেকে বেরিয়ে আস্তে সাহায্য করে। এক দল স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীদের অভিজ্ঞ অভিনেতাদের দিয়ে কিছু আবেগের অভিনয়ের স্থির ছবি ও ভিডিও দেখান হয়। প্রতিযোগীরা অভিনীত আবেগকে বুঝতে অসুবিধায় পরছিলেন। কিন্তু, সপ্তাহে তিন বার করে কমপক্ষে তিন মাস যোগাভ্যাসের পর তাঁদের এই ক্ষমতার যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। এটা সম্ভব হয় ওপরে লেখা ব্রেনের মধ্যে রক্ত প্রবাহের পরিবর্তনের জন্য, এবং এর ফলে রক্তে অক্সিটোসিন হরমোন (সংযোগকারী হরমোন), যা মা ও সন্তানের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করে, তার পরিমাণ বেড়ে যায়। এটা সামাজিক ব্যবহার উন্নত করে, একের অন্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।