আমি মন দিয়ে ছোট ছোট ব্যাপারগুলো দেখছি। ক্রেয়ন দিয়ে আঁকা একটা কিউট ছবি, সম্ভবত একটি পাঁচ বছরের বাচ্চার আঁকা; দেওয়ালে একটা জায়গায় একটু রং চটকে গিয়েছে; একটা মগের গায়ে লেখা 'ইউ আর স্পেশাল'। বাবা রে। ঢং! মগে পেনের চেয়ে সংখ্যায় মার্কার বেশি কেন? দাঁড়ান, ওই মার্কারের সঙ্গে কি ওর নোখের রঙের মিল রয়েছে? না, ওর ঠোঁটে বা নোখে কোথাও রং নেই। নাকি গায়ের রঙের সাথে মিলে যাওয়া ন্যুড শেড? ও কি শুধু লিপ গ্লস লাগিয়েছে? ওর ঠোঁট দুটো এখন নড়ছে আর ও বলছে- “আমি বুঝতে পারছি যে তুমি হয়তো ভাবোনি যে এই কথাটা শুনবে।” “পো...?”
আমার নাম শোনার পর আমি আবার তার মুখের দিকে দেখতে শুরু করলাম। আমার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ডঃ এ, তিরিশের কোঠায় এবং খুব সুন্দর দেখতে। তার মুখে যে গভীর সমবেদনার ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে আমি জানি সেটা সে মন দিয়ে উপলব্ধি করছে। গুরুতর অবসাদের সমস্যা ধরা পড়ার পর, গত একবছরের কিছু বেশি সময় ধরে, তার কাছে আমি আসছি। একজন পরিশ্রমী ছাত্রীর মতো, যে পড়াশোনায় কৃতি হতে চায়, আমি আমার অসুখের সঙ্গে মোকাবিলা করে চলেছি। ঠিক যেই ভাবে গর্ভাবস্থার সময় আমি কাজের পাশাপাশি অন্য সব কিছু করেছি, যেমন- নির্দিষ্ট যোগব্যায়াম করা, আয়রনের ওষুধ এবং খাবারদাবার খাওয়া, হাঁটাহাঁটি করা প্রভৃতি। নিজের সমস্যার সাথে মোকাবিলা করার জন্য আমি অন্যান্য নতুন মায়েদের সঙ্গে গ্রুপ থেরাপিতে অংশ নিয়েছি এবং একাকী কগনিটিভ বিহেভায়রল থেরাপির ক্লাস করেছি। এছাড়া আমার অবসাদ-বিরোধী ওষুধের মাত্রাও বাড়ানো হয়েছিল। এইসবের মধ্যে আমার মেয়ের এক বছর বয়স হয়ে গেল।
আমার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কথা শুনে আমি রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমি কবে সুস্থ হব? মানে, কতদিনে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবো?” সে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে আমি যে উত্তরটা পেলাম সেটা আমার বুক ফেটে গেল, “পো, তোমার সমস্যার গুরুত্ব বুঝে তোমার কেসটা আমরা একটু আলাদাভাবেই দেখছি। এক্ষেত্রে তোমাকে রোগমুক্ত করে তোলার বদলে আমরা চেষ্টা করছি তোমার সমস্যাটাকে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে।”
এক মুহূর্ত থেমে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে আপনি বলছেন যে আমি কখনোই সুস্থ হতে পারব না?!”
ডঃ এ তড়িঘড়ি বললেন, “একেবারেই আমি একথা বলছি না। নানা ভাবে আমরা সবাই চেষ্টা করছি যাতে তুমি সুস্থ হয়ে উঠতে পার। এবং সেটা তুমি নিজেও দেখেছ।”
ওই কথা শুনে আমি চুপ করে থাকলাম।
“পো, আমি যা বলার চেষ্টা করছি তা হল ডঃ এম (বিভাগীয় প্রধান) আর আমি তোমার কেস নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। তোমার সমস্যাটা অত্যন্ত গভীর এবং গুরুতর। তাই আমাদের মনে হচ্ছে যে তোমাকে হয়তো সারাজীবন ধরে অবসাদের মোকাবিলা করতে হতে পারে।”
কথাটা শুনে চোখ ঝাপসা হয়ে গেল, কানে কোনও কথাই ঢুকল না।
আমি যা শুনব বলে আশা করেছিলাম এটা তা নয়। ওই পরিস্থিতিটা আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল। আমি ভেবেছিলাম অবসাদ হল অনেকদিন ধরে চলা বিরক্তিকর ফ্লু-এর মতো- যখন এটা চেপে বসে তখন জীবন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে এবং ছেড়ে যেতে চায়না। কিন্তু কালেক্রমে সমস্যাটি দূর হয়ে যায়। আমার কোনও ধারণাই ছিল না যে এটা সারাজীবন ধরে চলতে পারে। জোঁকে ধরার মতো। শিকলে বাঁধা পড়ার মতো। আজীবনের কারাবাস।
“আপনি কখন জানতে পেরেছিলেন যে এটা সারাজীবন চলবে?” কখনও কখনও সন্দিহান রুগি এবং সন্দেহপ্রবণ গোয়েন্দার মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকে না।
“আমরা একদম শুরু থেকেই মনোযোগ সহকারে তোমার সমস্যাটির প্রতি লক্ষ রেখেছিলাম। সময়ের সাথে আমরা এই পূর্বাভাস পেয়েছি।”
“আচ্ছা।”
ডঃ এ-র সঙ্গে আমার বাদবাকি কথাবার্তার মূল বিষয় এটাই ছিল যে সারাজীবন অবসাদের সমস্যায় ভোগা মানে ফ্লু হলে বারবার হাঁচি হওয়ার মতো নয়। আসলে যথাযথ জীবনযাপন, ওষুধপত্র এবং অন্যান্য কৌশলের মাধ্যমে গভীর অবসাদকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এই ভাবে আমি দিন, মাস কাটতে পারব। বুঝতেই পারব না যে এই সমস্যা রয়েছে।
নিজের প্রতি করুণা অনুভব করা মোটেই কাম্য নয়। কিন্তু আমি তাই করলাম। হ্যাঁ, আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি, “কেন আমার সঙ্গেই এমন হল?”
হয়তো আমি প্রচুর চকোলেট খেয়েছি বা খাইনি। আমার প্রিয়বন্ধুর কাছে এই নিয়ে একনাগাড়ে ঘ্যানঘ্যান করেছি। সেই সময় আমার কথা না শুনে সে তার নিজের কাজ করতে পারে, কিন্তু ও আমার পাশে থেকেছে, আমার আক্রোশ নিজে উপলব্ধি করেছে। ভগবান ওর ভালো করুন।
আমার অবস্থাটাকে মন থেকে মেনে নিতে যতক্ষণ পারিনি ততক্ষণ আমি এসব করেছি। অবসাদের বিষয়ে আমি নিজের মনকে বুঝিয়েছি এই বলে যে এটা অনেকটা ডায়াবেটিসের মতো। এই সমস্যা হোক তা কেউ চায় না। আমার জীবনে এই সমস্যাটা দেখা দিয়েছে এবং এটা চলবে, কিন্তু আমার জীবন থেমে থাকবে না। আমাদের চারপাশে কত মানুষ তো ডায়াবেটিস নিয়েই বেঁচে থাকে। অন্যদের মতো করেই জীবনযাপন করে। আমিও তাদের মতো করেই এগিয়ে যাব। তারা যেমন কোনওরকম লজ্জা না করে ইনসুলিন নেয়, ঠিক একইভাবে অবসাদের ওষুধ খাওয়া নিয়ে আমি লজ্জা বোধ করব না। আর হ্যাঁ, আমি আমার শরীরের প্রতি আরও যত্ন নেব। ডায়াবেটিসের ফলে আরও অনেক সমস্যা হতে পারে, যেমন- হার্টের সমস্যা, রক্তচাপ বাড়া প্রভৃতি। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অবসাদের সমস্যাটাও অনেকটা একইরকম। অবসাদের ফলে উদ্বেগ, বাইপোলার ডিসঅর্ডার এবং আরও অন্যান্য মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। এজন্য নিজেদের সচেতন হওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে কেমন আছি তা নিয়ে ডাক্তার বা অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
আমি কৃতজ্ঞ যে এমন স্বামী পেয়েছি। তার ভালোবাসা ও সহযোগিতা সবসময়ে আমার সঙ্গে রয়েছে। এবং আমার কলেজের প্রিয়বন্ধুর শুভেচ্ছাও আছে আমার জীবনে। এই দু'জন মানুষ আমার জীবনের দুটি স্তম্ভ। যখনই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে তখনই ওরা আমার কথা শুনে। তাতে তারা কোনও একঘেয়েমি বোধ করে না।
সচেতনতা বাড়ানোর ক্রিয়া আমায় অনেক সাহায্য করেছে। যোগব্যায়ামও সাহায্য করে - তবে যেদিন আমার করতে ইচ্ছে করে, সেদিন। নিজের যত্ন নেওয়া সত্যিই একটা কাজের কাজ। আর অন্যান্য কাজ যেমন- নিজের প্রিয় লাল লিপস্টিক পরে মুদির দোকানে যাওয়া। আসলে সব থেকে জরুরী হল আমি কেমন আছি সেটা স্বীকার করা। তাই যদি আমি নিজে খারাপ থাকি তাহলে সেই খারাপ থাকাটাকেই আমায় মেনে নিতে হবে, অধৈর্য হয়ে সমস্যাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলে চলবে না। আর সমস্যা বজায় রয়েছে দেখে হতাশ হলে চলবে না। মনে বাসা বেঁধে থাকা খারাপ চিন্তাগুলিকে আমি প্রায়ই নেড়েচেড়ে দেখি, যা আমাকে অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর তারপর নিজেকে বলি যে এইগুলো থাকা সত্ত্বেও আমি আছি। এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছি।
আমি জানি না সমাজের চোখে আমি কী – উত্তরজীবী না যোদ্ধা। বা অন্য কিছু – যেই নাম ধরে সমাজ আজীবন রোগের সাথে মোকাবিলা করা মানুষদের ডাকে। আমার জীবনের কিছু দিন একেবারে অন্ধকারে কাটে, বা দিকশূন্য হয়ে যায়। কিন্তু তেমন দিনের সংখ্যা কম। কখনো আয়নার সামনে দাঁড়ালে একজন ক্লান্ত, অবসন্ন মহিলাকে দেখতে পাই, প্রসবের পরেও যার একটা একগুঁয়ে ভুঁড়ি রয়েছে এবং চোখের চারপাশে কালো ছোপ পড়েছে। অন্যদিন আমি হয়তো নিজেকে বলি যে এইসব দাগ, চিহ্ন নিয়ে আমিই হলাম পো দ্য পান্ডা।
এই কাহিনীর লেখিকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।