স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণায় একে বলা হয় জাদু বড়ি বা ম্যাজিক পিল। এর সাহায্যে আমাদের মানসিক শক্তি বাড়ে, আত্মনির্ভরতা এবং সহানুভূতির মনোভাব দৃঢ় হয়, মারমুখিনতা কমে, স্বস্তি জাগে, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে, প্রায়শই অসুস্থ হয়ে যাওয়া, আনুষঙ্গিক ব্যথা-বেদনার উপশম হয়, বন্ধুত্ব ও গভীর সম্পর্কগুলো অটুট থাকে। আপাতভাবে আমাদের সবার মধ্যেই এই জাদু বড়ি রয়েছে, শুধু তাকে সক্রিয় করতে হবে। মানুষের মনের এই অবস্থাকে বলে হয় কৃতজ্ঞতা বোধ।
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের মতে কৃতজ্ঞতাবোধ হল, ''একপ্রকার ধন্যবাদজ্ঞাপক প্রশংসা, যা একজন মানুষ অনুভব করে জীবনের যা পেয়েছে তার প্রতি, যা মূর্ত বা বিমূর্ত- দুই হতে পারে।'' এই বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে গবেষকরা ব্যক্তিমানুষের মস্তিষ্ক তথা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কৃতজ্ঞতাবোধের অনুশীলনের প্রভাব সংক্রান্ত কতগুলো সুসংবদ্ধ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিক নাগাদ যখন আমি কৃতজ্ঞতাবোধ সংক্রান্ত ডায়রি লিখতে শুরু করেছিলাম তখন আমি এসব গবেষণার বিষয়ের প্রতি ততটা মনোযোগী বা কৌতূহলী ছিলাম না। আমি তখন শুধু কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপকে বিনা শক্তি প্রয়োগে মেনে নেওয়া ও গ্রহণ করার জন্য সচেতন থাকতে চাইতাম। সেই সঙ্গে এসব মুহূর্তগুলো নিয়ে চর্চা ও জীবনে তার প্রভাব নিয়ে লেখালেখি করা শুরু করেছিলাম।
আমি অনুভব করেছিলাম যে কৃতজ্ঞতা বিষয়ক চ্যালেঞ্জটি আমার নেওয়া প্রয়োজন, কারণ কিছু বছর ধরে আমার মনের মধ্যে তোলপাড় এবং কিছু সন্ধানের একটা বোধ ঘোরাফেরা করছিল। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সবরকম সুযোগ-সুবিধা, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ভালোবাসার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও নিজের জীবন নিয়ে আমার মনে না-পাওয়ার খিদে গড়ে উঠেছিল। আমার মনে সন্দেহ, উদ্বেগ, হতাশা, দুঃখ, ক্ষতি, বিভ্রান্তির মনোভাব দেখা দিচ্ছিল। কিন্তু নিজের জীবনটাকে যখন আমি কৃতজ্ঞতাবোধের আলো ও আশার দৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম, তখন আমার মনে হল যে আমার জীবনে একটা গুরুতর বদল এসেছে। এর ফলে আমার দৈনন্দিন জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্যগুলো প্রসারিত হয়েছে এবং সেগুলো আমাকে প্রতি মুহূর্তে উৎসাহ জোগাচ্ছে।
তাই ভাবা দরকার যে কীভাবে আমাদের জীবনে এই কৃতজ্ঞতাবোধ অনুভূত হতে পারে? এই বোধটা অনেকটা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে বসে ডুবন্ত সূর্যের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত আলোর মতো। আমার শরীরের কোন জায়গায় এর অস্তিত্ব অনুভূত হবে? কখনও কখনও সেই অনুভূতি আমরা চোখ (চোখের জলের মধ্যে দিয়ে) ও গলায়, কখনও বা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি - যা আমার মধ্যে প্রসারিত করে, ভাসিয়ে দেয় এবং আন্তরিকভাবে জড়িয়ে থাকে।
অনেক বছর আগে যখন আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় 'কৃতজ্ঞতাবোধ চ্যালেঞ্জ' প্রস্তাবটি স্বীকার করি তখন আমি মুত্র বিসর্জনের জায়গা, আমার শৈশবের আম গাছ, আমার মা, আমার শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার পরিবেশ, জীবনে বেঁচে থাকার কথা এবং আমার জীবনের কাছের মানুষজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলাম। বহু মানুষ আমার সেসব কৃতজ্ঞতামূলক পোস্টের সাথে মনের মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য আমার কৃতজ্ঞতা বোধ শতগুণে বেড়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে ওই কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের একটা পথ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু যেহেতু কৃতজ্ঞতাবোধের অন্তর্নিহিত অর্থ আরও গূঢ়, তাই বিষয়টা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা বাস্তবে অনেক বেশি কঠিন। দৈনন্দিন জীবনে এই বোধ-চর্চার চেষ্টা করাও আমাদের প্রতিনিয়ত চালিয়ে যেতে হয়।
সেই সময়ে ওই কাজের সঙ্গে আমার অন্তরের যোগ মজবুতভাবে গড়ে উঠেছিল, নিজের ভিতরের ও বাইরের দ্বন্দ্ব মিলেমিশে গিয়েছিল, নিজের অন্তরকে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলাম, নানা মৃতপ্রায় স্মৃতিগুলো ক্রমশ মুছে যাচ্ছিল, সেগুলো আমার ভয়কে জয় করেছিল, আমার মনের নেতিবাচক দিকগুলো ক্রমশ ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছিল এবং আমার হৃদয়ের প্রসরতা গভীরভাবে নিজের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছিল।
যখন আমি কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে ডায়রি লেখা শুরু করেছিলাম তখন আমি কাজ খুঁজছিলাম। কৃতজ্ঞতাবোধ চ্যালেঞ্জ শুরুর দশ দিনের মাথায় কাজ আসতে শুরু করে। পনেরো দিনের মাথায় আমি লিখেছিলাম- এখন কাজের ছড়াছড়ি। কিছু পরিবর্তন এবং ঘটনা ঘটছে। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার ও ডায়রি লেখার সময় পাচ্ছিলাম। আমার জীবনে আশ্চর্য সব উপহারের সম্ভার খুঁজে পাচ্ছিলাম, যেমন বারান্দায় ঝুলে থাকার গাছটির উপর দিয়ে সূর্যোদয় দেখা। অথবা যখন একজন সহকর্মীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ চলছিল তখন বৌদ্ধ গ্রন্থ 'How to Fight'-খুঁজে পাওয়া।
সম্পাদক নেহা এম জানিয়েছেন যে কৃতজ্ঞতা নিয়ে ডায়রি লেখার মধ্যে ‘মনোযোগের অভ্যাস’ তাঁর ভাল লাগে। তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভোলেননি। যেমন তিনি লিখেছিলেন- 'আমি সত্যিই খুব কৃতজ্ঞ...আজকাল আমি নিজের প্রতি যত্নবান হয়েছি।' ফ্রিল্যান্স লেখক এবং যোগ শিক্ষক পূর্ণিমা মাইসোর মনে করেন যে কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীর ভাবনাচিন্তার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনের সেরাটাই প্রকাশ পায়, এমনকী, চরম মানসিক চাপের সময়েও আমাদের মনোভাবে সেরাটাই প্রকাশ পায়। এবিষয়ে তিনি বলেছেন, তিনি খোলা মনে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন, কারণ এর মধ্য দিয়ে যখন কেউ তার জীবনে খারাপ সময়ের ভিতর দিয়ে যায় তখনও তার জীবনে ভালো কিছু হওয়ার বা করার আশা বেঁচে থাকে।
শুভা পার্থসারথি, যিনি অভিভাবক ও শিশুদের কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করেন। তাঁর মতে, কৃতজ্ঞতাবোধের অনুশীলন যখন নিত্যকর্ম হয়ে ওঠে তখন সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া জরুরি। ''আমার মনে আছে বাড়িতে বাবা কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায় তা আমাদের শেখাতে শুরু করেছিলেন। মাসখানেক পরে তা একপ্রকার প্রথা বা নিয়মে পরিণত হয়েছিল।''-এমনই জানিয়েছেন শুভা। মাঝেমধ্যে তাঁকে জানানো হয় যে কৃতজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গিয়ে তাদের মনে অপরাধ বোধ জাগে কারণ তারা নিজের মধ্যে এখনো কোনও আনন্দ অনুভব করতে পারছেন না। তিনি বলেছেন, ''এটা উপলব্ধি করতে সময় লাগে যে প্রতিটি অভিজ্ঞতা যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমনই রয়েছে।''
রেবতী রামানান একবার লক্ষ্য করেছিলেন যে প্রত্যহ মানুষের শুভ চিন্তা করা বৈজ্ঞানিকগতভাবে প্রমাণ করে যে তা মানুষের মস্তিষ্কের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক-একটা বিষয়, যার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা বোধ করেন, তা তিনি প্রতিদিন টুইট করে এখন জানান। তাঁর জীবন যখন নেতিবাচক মন্তব্য ও অহেতুক চিন্তাভাবনার ফলে ক্রমশ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল তখন তিনি সেই শুভ চিন্তার সুফল হাতেনাতে পেয়েছিলেন। প্রত্যেকদিন দুটি যমজ বাচ্চার যত্নের পাশাপাশি চাকরি করতে বাড়ির বাইরে বেরতে হয় তখন তাঁর ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু শুভ চিন্তার অনুশীলন তাঁকে সেই সমস্যার সমাধান করতে প্রতিনিয়ত সাহায্য করে। তিনি রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারেন। ''এই ঘটনা কৃতজ্ঞতা জানানোর থেকেও আরও বেশি কিছু; কৃতজ্ঞতার কারণ খুঁজে দেখা বেশী গুরুত্বপূর্ণ''- এমনই বলেছেন রেবতী। তাঁর মতে, ''কৃতজ্ঞতাবোধের মধ্যে দিয়ে মুহূর্তের পরিবর্তন ঘটে। আমার চারপাশের পরিবর্তন ঘটে না, আমার মধ্যে ঘটে।''
আমার মনে হয় কৃতজ্ঞতাবোধের অনুশীলন আমাদের জীবনবোধকে আরও গভীর ভাবে গ্রহণ করতে শেখায়, অন্তর থেকে আমাদের মধ্যে সংবেদনশীলতা প্রকট হয় এবং অন্তর্নিহিত শক্তি আমাদের জীবনের লক্ষ্য, দিশাকে সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করে। এটা আমাদের এমন একটা অন্তর্নিহিত দক্ষতা যার সাহায্যে জীবনকে প্রতি মুহূর্তে উপভোগ, স্পর্শ করার ইচ্ছে জাগে। কৃতজ্ঞতাবোধের অনুশীলন মানে নিজের মনের আলোয় নিজের জীবনকে দেখা। অর্থাৎ, এই অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আমাদের মন এতটাই প্রসারিত বা উদার হয়ে যায় যে তখন জীবনে চলার পথের কোনও কাজকেই আর কষ্টসাধ্য বলে মনে হয় না।