কিছু মানুষ কেন তাদের মানসিক আতঙ্ক নিজে থেকে কাটিয়ে উঠে জীবনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়? আবার অন্যদিকে কেন কিছু মানুষ তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া যে কোনও দুর্ঘটনার পরে মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়ে, ঘটনা ঘটার বহু বছর পরেও মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে? কীভাবে কিছু মানুষ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা করতে এবং অন্যদের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, আবার কেউ কেউ কেন জীবনের হতাশা, দুঃখ বা আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতেই পারে না?
যারা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করে তারা সাধারণত মানসিকভাবে স্থিতিস্থাপক হয়। কিন্তু মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বলতে ঠিক কী বোঝায়?
স্থিতিস্থাপকতার অর্থ হল -
আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে মানসিক স্থিতিস্থাপকতা হল সেই প্রক্রিয়া যার সাহায্যে মানুষ প্রতিকূলতা, আতঙ্ক, দুঃখ, ভয় এবং গুরুতর মানসিক চাপ যেমন- পারিবারিক ও সম্পর্কজনিত সমস্যা, শারীরিক জটিলতা বা কর্মক্ষেত্রের সমস্যা এবং অর্থনৈতিক চাপ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। কীভাবে মানুষ বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করে, নিজের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে জীবনের দুঃসময় কাটিয়ে ওঠে তা বোঝাতে স্থিতিস্থাপকতা শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
শিশুদের ক্ষেত্রেও মানসিক স্থিতিস্থাপকতার ধারণাটি প্রযোজ্য। এর সাহায্যেই তারা শৈশবে ঘটা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা ভুলে পড়াশোনার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠে। এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি-
প্রত্যেকেরই মানসিক স্থিতিস্থাপকতাজনিত দক্ষতা থাকা জরুরি: আমাদের প্রত্যেকেরই মানসিক চাপ ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার নিজস্ব পন্থা থাকে। তবে মানুষের এই ক্ষমতা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। আমাদের সবার মধ্যেই চাপ মোকাবিলার জন্য আলাদা-আলাদা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর মানসিক স্থিতিস্থাপকতাজনিত দক্ষতা নির্ভর করে-
বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করা এবং তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত করা
অন্যের সামনে নিজেকে প্রকাশ করা ও নিজের চাওয়া-পাওয়া ভাগ করে নেওয়া
সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজে বের করা এবং সেইমতো কাজ করা
নিজের অনুভূতি বা আবেগ, চিন্তাভাবনা এবং আচরণ সম্পর্কে সচেতন থাকা
আমাদের নিজেদের মনে জন্মানো নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যেমন - আমার সঙ্গে কী ঘটছে? আমার কী চাই? আমি কি করতে পারি? কার কাছে আমি সাহায্য চাইতে পারি? প্রভৃতি।
বাহ্যিক উপাদানও মানসিক স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে - স্থিতিস্থাপকতা শুধু মানুষের অর্ন্তনিহিত গুণ নয়, যার সাহায্যে সে প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। কয়েকটি বাহ্যিক উপাদানও মানসিক স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে থাকে। সেগুলো হল -
পরিবারের সদস্য, বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনের যত্ন ও সহযোগিতা
মানুষের সঙ্গে ভালোবাসা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলা, কোনও একজন মানুষকে জীবনের আদর্শ হিসেব গণ্য করা এবং উৎসাহ ও আশ্বাস পাওয়া
সমাজ বা গোষ্ঠীর সহযোগিতা অর্জন। যেমন - দেশের সরকারের পক্ষ থেকে যদি শিশুদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যায় তাহলে বৃহত্তর অর্থে শিশুদের মানসিক স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
স্থিতিস্থাপকতার বিকাশের জন্য দরকার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ-দুই উপাদানই -
স্থিতিস্থাপকতা এমন একটা প্রক্রিয়া যেখানে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক - দুই উপাদানেরই যোগাযোগ জরুরি। মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বা প্রাণোচ্ছ্বলতার বিকাশ নির্ভর করে বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষের অর্ন্তনিহিত দক্ষতা, পারিপার্শ্বিক সাহায্য ও ইতিবাচক অভিজ্ঞতার উপর।
অনুমান করার ক্ষমতা স্থিতিস্থাপকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য - কীভাবে আমরা কোনও বিশেষ পরিস্থিতি বা ঘটনার বিষয়ে আগে থেকে অনুমান করতে পারি। এর জন্য থাকা প্রয়োজন মানুষের ইতিবাচক মানসিকতা এবং নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতার প্রতি আত্মবিশ্বাস।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বা হতাশা কাটানোর ক্ষমতাজনিত দক্ষতার বদল ঘটে - গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে বড়দের তুলনায় বাচ্চাদের মধ্যে মানসিক প্রাণোচ্ছ্বলতা বা স্থিতিস্থাপকতা বেশি থাকে। এর প্রাথমিক কারণ হল বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চাপ মোকাবিলার জন্য আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি কম যেতে শুরু করে। যদিও কোন পরিস্থিতিতে একজন মানুষের (বড় বা ছোট) মধ্যে মানসিক স্থিতিস্থাপকতা কেমন থাকবে তা আগে থেকে কখনোই আন্দাজ করা যায় না। আসলে পরিস্থিতির ধরন, গভীরতা এবং প্রতিকূলতার বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে মানুষ তার প্রতিক্রিয়া জানায়। আর সেই প্রতিক্রিয়া একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতেই পারে।
কিছু মানুষ মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বা প্রাণোচ্ছ্বলতা নিয়েই জন্মায়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই ক্রমান্বয়ে মানসিক স্থিতিস্থাপকতার বিকাশ ঘটে -
জন্মগত মানসিক স্থিতিস্থাপকতার কতগুলো বিশেষ ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন - কিছু বাচ্চার মধ্যে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বেশি থাকে। তবে এই ক্ষমতা সবার মধ্যে থাকে না। কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, মানসিকভাবে স্থিতিস্থাপকতার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য অনুশীলন করা জরুরি, মানুষের নিজের সামাজিক ও অন্যান্য প্রেক্ষাপটের উপর স্থিতিস্থাপকতা নির্ভরশীল এবং কী ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি আমাদের হতে হচ্ছে তার উপর মানসিক প্রাণোচ্ছ্বলতা নির্ভর করে। (এই বিষয়ে 'কীভাবে মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বা প্রাণোচ্ছ্বলতা গড়ে তোলা যায়' শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়তে হবে)
এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য নিমহানসের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার পূর্ণিমা ভোলার সাহায্য নেওয়া হয়েছে।