কল্যাণ

আত্ম-সহানুভূতি বলতে কী বোঝায়?

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

সেই পরিস্থিতির কথা একবার চিন্তা করা দরকার, যখন একজন নিজের বিষয়ে ভাবতে বসে বিমর্ষ বা বিষণ্ণতা বোধ করে। এইরকম ঘটনা একজনের জীবনে কখন ঘটেছিল, মনে পড়ে? সেটা কি এক সপ্তাহ আগে, নাকি গতকাল অথবা আজ ঘটেছে? নিজেকে নিয়ে কী এত ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল? বেশিরভাগ সময়েই আমরা আত্মসমালোচনায় মগ্ন থাকি। তা সে বাড়ি বা কাজের জায়গায় নিখুঁত থাকাই হোক, অথবা মানসিকভাবে অসুস্থ কোনও বন্ধু কিংবা আত্মীয়ের পরিচর্যাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন— উভয় ক্ষেত্রেই আমরা নিজেদের কাজের বা আচরণের ভুল-ত্রুটিগুলি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে থাকি। যখন আমরা নিজেদের বিচার বা সমালোচনা করি, তখন তার ফলাফল কী হয়? আত্মসমালোচনা কি নিজের উন্নতিসাধন বা পরিবর্তনে সাহায্য করে?

এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয় যে, যখন আমরা নিজেদের উন্নতির কথা ভাবি বা  ভালো চাই, তখন আমরা নিজেদের কাজকর্মের সমালোচনা করে থাকি। কিন্তু এই প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘমেয়াদি এবং আমাদের চিন্তাভাবনা ও আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাহলে তা থেকে মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নিজের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে আমরা কতখানি আত্মসমালোচক হব, সে দিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। যখন আমরা আমাদের নানা ভুল-ত্রুটি, ব্যর্থতা, অক্ষমতা নিয়ে ক্রমাগত সমালোচনা এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে শুরু করি, তখন তা আত্ম-সহানুভূতি বা আত্ম-অনুকম্পা হিসেবে বিবেচিত হয়।

আত্ম-সহানুভূতি বা আত্ম-অনুকম্পা কিংবা আত্ম-করুণা বলতে ঠিক কী বোঝায়?

যখন আমরা দেখি যে আমাদের চারপাশে বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা চেনা পরিচিত কেউ কোনও একটি সমস্যার মধ্যে রয়েছে, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি জাগে। আমরা তখন এমন কিছু করতে চাই যা আমাদের কাছের মানুষকে সমস্যা থেকে রেহাই দিয়ে ভালো রাখতে সাহায্য করে। ঠিক একইরকমভাবে যখন কারও নিজের প্রতি সহানুভূতি বা করুণা দেখা দেয়, তখন তা আত্ম-সহানুভূতি বা আত্ম-করুণা বলে চিহ্নিত হয়। এই ধরনের অনুভূতি আমাদের ভদ্র, শান্ত, দয়ালু এবং নিজের জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আরও বেশি যত্নশীল এবং গতিশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আর এভাবেই আমাদের জীবনে উত্তরোত্তর উন্নতি এবং বিকাশ ঘটে।

আত্ম-সহানুভূতি জাগ্রত হওয়ার ফলে আমাদের মধ্যে তিনটি গুণের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়—

  • মনোযোগী বা সচেতন হওয়া — সুনির্দিষ্ট চিন্তা, অনুভূতি, কৌতূহল এবং মনের উদারতা যে কোনও পরিস্থিতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে নিজের প্রতি অতিরিক্ত মূল্যায়ন করা ঠিক নয় এবং প্রতিনিয়ত নিজের চিন্তা-ভাবনা ও অনুভূতির কাটাছেঁড়া না করাই বাঞ্ছনীয়।

  • মনুষ্যত্ব বা মানবতার জাগরণ — মানুষ হিসেবে দার্শনিক চিন্তার উন্মেষ ঘটা একান্ত কাম্য। এর সঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে, মানুষ মাত্রই নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এবং কোনও মানুষেরই নিজেকে একেবারে নির্ভুল বা নিখুঁত মনে করা উচিত নয়। আর এহেন মনোভাবই একজনকে তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, অক্ষমতাকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিতে সাহায্য করে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম কারও ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়।

  • আত্ম-দয়ালু মনোভাবের প্রকাশ — মানুষ সব সমস্যা বা বিপদ থেকে মুক্তি পায় তার ধৈর্য এবং সহ্যশক্তি দ্বারা। ধৈর্যহীনতার ফলেই মানুষ অসফল হয় — সে কথা প্রত্যেক মানুষেরই মনে রাখা জরুরি।

আত্ম-সহানুভূতিশীল মনোভাবের উপযোগিতা

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আত্ম-সহানুভূতিসম্পন্ন আচরণের বহু উপযোগিতা রয়েছে। যেমন, ইতিবাচক অনুভূতির প্রকাশ, জীবনে সন্তুষ্টিবিধান, প্রজ্ঞার বিকাশ, ইতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে, কৌতূহল জেগে ওঠে, লক্ষ্য স্থির করার শিক্ষা, সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনের ইচ্ছা, দায়িত্ববোধের বিকাশ এবং ভাবাবেগের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি হয়। অন্যদিকে, নিজের প্রতি সহানুভূতি বা অনুকম্পার অভাব হলে আত্মসমালোচনা, মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, নস্ট্যালজিয়ায় ভোগা, শাসন বা দমন  করার চেষ্টা এবং নিখুঁত হওয়ার জন্য সদা সতর্ক থাকার প্রবণতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়।

নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে গেলে কী কী করা প্রয়োজন?

  • আত্মসমালোচনামূলক মনোভাবের পরিবর্তে যুক্তি-বুদ্ধির ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। যে কোনও পরিস্থিতি বিচারের ক্ষেত্রে কার্যকারণ সম্বন্ধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা দরকার।

  • আত্ম-সহানুভূতিমূলক বইপত্র বা লেখালিখি পড়া উচিত। এটি আত্ম-সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা বা অনুভূতিকে প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেবে বা সাহায্য করবে।

  • নিজের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। এটি কাউকে ভালো থাকতে সহায়তা করবে।

  • নিজের ব্যর্থতা, অক্ষমতা, অপদার্থতা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অনেক সময়েই খেদ, ক্ষোভ প্রভৃতি দেখা যায়। নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠার মাধ্যমে এহেন খেদোক্তিমূলক মনোভাব পরিত্যাগ করার একধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল।

  • নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে নিজেরই নিজেকে চিঠি লেখার অভ্যাস করা জরুরি। এক্ষণে কল্পনা করে নিতে হবে যে, একজন বন্ধু অন্য আরেক বন্ধু বা ব্যক্তিকে কীভাবে তার মনের সহানুভূতি ব্যক্ত করছে, সেই ছবিটিকে।

এই প্রবন্ধটি নিমহানস সেন্টার ফর ওয়েলবিইং-এর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালার উপর ভিত্তি করে লেখা।