একটা সংস্থায় কর্মরত কোনও কর্মচারী যদি মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে কাজে যোগ দেয় তাহলে তাকে সাহায্য করার জন্য ওই সংস্থা কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়, সে বিষয়ে বাস্তব পরিস্থিতি জানার জন্য হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রঞ্জিতা জেউরকার মানবসম্পদ বিভাগের দু'জন আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন (অনুরোধবশত তাঁদের নাম প্রকাশ করা গেল না)। প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা যা জানিয়েছেন তা তুলে ধরা হল।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য কাজের জায়গায় তাঁদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে কীভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়?
প্রথম আধিকারিকের উত্তর: অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রেই যে কোনওরকম মানসিক অসুস্থতা তা যত গুরুতরই হোক না কেন, তার সঙ্গে মোকাবিলার জন্য মানানসই কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ বিশেষ চোখে পড়ে না। তবে এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। সচেতনতা এবং প্রশিক্ষণ শুধু মানবসম্পদ বিভাগেরই দায়িত্ব নয়। বরং অন্যান্য বিভাগও এর সুবিধা নিতে পারে। কিছু সংস্থায় মানসিকভাবে অসুস্থ কর্মীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে এবং একজন কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আবার এমন অনেক সংস্থাও থাকে যারা এই সমস্যার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংবেদনশীল মনোভাব দেখায় না।
দ্বিতীয় আধিকারিকের উত্তর: সংস্থাগুলোর উদাসিনতার পিছনে সম্ভবত কোনও উদ্দেশ্য থাকে না। এক্ষেত্রে মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি নিজেই উদাসীন হতে পারেন অথবা কর্মক্ষেত্রে কর্মরত অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে নিজেকে অর্ন্তভুক্ত করার জন্য কোনও সক্রিয় উদ্যোগ নেন না। অন্য আরেক ধরনের বাধাও সামনে আসতে পারে- অনেক মানসিক অসুখ সম্পর্কে যেমন স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো সমস্যার ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতাই তেমনভাবে থাকে না। ফলে এই সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক সাহায্য পাওয়া যায় না। অন্যদিকে মানসিক সমস্যার চেয়ে শারীরিক অক্ষমতা মানুষের চোখে অনেক বেশি করে ধরা পড়ে। একটা সংস্থা এই সমস্যা দূর করতে উন্নত ব্যবস্থা ও সাহায্যের পরিস্থিতি গড়ে তুলতে পারে। কীভাবে একজন মানসিক রুগিকে সাহায্য করা যেতে পারে? বিষয়টা স্পষ্ট নয়। কারণ এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে অধিকাংশেরই সচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও সংবেদনশীলতার অভাব রয়েছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ নিজের সমস্যার কথা প্রকাশ্যে আনার বিষয়ে চিন্তিত থাকে। এ কারণে সাহায্যের বিষয়টা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
কর্মক্ষেত্রে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষকে বিশেষত কোন কোন ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়?
প্রথমজনের উত্তর: অনেক বাধার মধ্যে অন্যতম হল ভিন্ন ভিন্ন মনোভাবাপন্ন একদল মানুষের সঙ্গে কাজ করার সমস্যা। এজন্য মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির মধ্যে নিজের অনুভূতি ও অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা প্রকাশের ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়। সংস্থার ম্যানেজারের সঙ্গে বিশেষ করে সেই ম্যানেজার যদি নেতাগোছের কেউ হয় তাহলে বেশি সমস্যা দেখা যায়। আসলে এই ধরনের ম্যানেজাররা সংস্থা চালাতে গিয়ে খুব কঠিন, কঠোর নিয়মকানুন চালু করে এবং মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করে না। এছাড়াও সংস্থার ধরাবাঁধা কাজের বাইরে তারা কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দেয় না এবং তাদের অনেকটা বহিরাগত বলে মনে হয়।
দ্বিতীয়জনের উত্তর: যখন কেউ বলে যে সে শারীরিকভাবে অসুস্থ তখন তা আমাদের পক্ষে বড় একটা সমস্যার সৃষ্টি করে না। যখন সে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পরে আবার কাজে যোগ দেয়, তখন সে আশা করে যে সে আবার আগের মতো কাজ করতে পারবে। তবে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের পক্ষে এমন আশা করা সবসময়ে সম্ভব হয় না। এবং সেটাই তখন জীবনে অন্যতম বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
একজন মানসিক অসুখের শিকার ব্যক্তিকে যখন চাকরিদাতা চাকরিতে নিয়োগ করে তখন তাঁর সামনে কোন কোন বাধা থাকে?
প্রথমজনের উত্তর: মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা যুক্তিযুক্ত সে সম্পর্কে অধিকাংশ চাকরিদাতারই না থাকে সচেতনতা এবং না জন্মায় আত্মবিশ্বাস। যার জন্য সংস্থার নিয়মকানুন অনেক শিথিল করা প্রয়োজন, তার ক্ষেত্রে সহানুভুতির অভাবও দেখা যায়। প্রায়শই মনে করা হয় যে একমাত্র মানবসম্পদ বিভাগের পক্ষেই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের জন্য সব দায়িত্ব পালন করা জরুরি; তাই অন্যান্য বিভাগের কর্মীদের এই বিষয়ে তেমন ওয়াকিবহাল থাকার দরকার নেই বলে বিশ্বাস করা হয়।
দ্বিতীয়জনের উত্তর: যখন কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ থাকে তখন সে ঠিকঠাক কাজকর্ম করতে সক্ষম হয় না। এর প্রভাব একটা কোম্পানির সামগ্রিক কাজকর্মের উপর পড়ে। একটা সংস্থার দলগত দক্ষতা এবং প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির পরিচর্যার জন্য কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব? যদি দলের সদস্যদের সম্পর্কের সমীকরণের মধ্যে বদল ঘটে যায় তাহলে সেই পরিস্থিতি কীভাবে সামলানো জরুরি? একজন ব্যক্তিমানুষের প্রতি কীরকম ভূমিকা পালন করা উচিত? প্রাথমিকভাবে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষকে কোম্পানির উচিত সবদিক থেকেই সাহায্য করা। কয়েকমাস পরে কোম্পানির নিজের ক্ষতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত। বিশেষ করে যদি তখন মানসিকভাবে অসুস্থ কর্মী ঠিকভাবে কাজ করতে না পারে বা প্রয়োজন হলে তাকে সাময়িক বিশ্রাম দেওয়া উচিত। অসুখের কারণে কোনও কর্মীর কর্মক্ষমতায় পরিবর্তন আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে একটা সংস্থা বা চাকরিদাতার কী করণীয় থাকে? তার জন্য কতটা শিথিল হওয়া প্রয়োজন? পরিবর্তিত চাহিদার যোগান দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা কি রয়েছে সংস্থার? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব বিষয় একটা সংস্থার ভালোমন্দের উপর কী প্রভাব ফেলছে সেদিকে সচেতন হওয়া একজন নিয়োগকর্তার পক্ষে একান্তই প্রয়োজনীয়...
কাজের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চাকরিদাতা ও কর্মচারী দুজনের ক্ষেত্রেই কী কী সুযোগ থাকা প্রয়োজন?
প্রথমজনের উত্তর: স্বাধীনকর্মী (ফ্রিলান্সিং) এবং বিশেষজ্ঞ বাধাধরা কর্মীর (কনসাল্টিং) ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইদানীং চাকরিদাতারা কোথায়, কখন কী কাজ হচ্ছে সে বিষয়ে অনেকবেশি শিথিল মনোভাবাপন্ন। পুরো সময়ের কর্মীরা তাদের কাজের ফলাফল দিয়ে কর্মদাতাদের বিশ্বাস অর্জন করে। নিয়োগকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে বিভিন্নরকম কাজের ব্যবস্থা করার সুযোগও রয়েছে।
অন্য আরেক ধরনের সুযোগ হল পরীক্ষামূলকভাবে কাজের চেষ্টা করা। একে ইর্ন্টানশিপ বা স্বেচ্ছাকর্ম হিসেবেও অভিহিত করা যায়। অথবা যে কর্মীকে কাজে নেওয়া হচ্ছে সে যোগ্য কিনা তা বিচার করার জন্য স্বল্প সময়ের চুক্তিতেও কাজে নিয়োগের সুযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয়জনের উত্তর: কর্মচারীদের কাছে সহজ কাজ বাছার সুযোগ রয়েছে। যেমন- স্বাধীনভাবে কাজ করা বা কম চাপের কাজ করা। অথবা এমন সংস্থায় কাজে যোগ দেওয়া যায় যার বাজারে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। যে কর্মক্ষেত্রে কাজের বৈচিত্র থাকে সেখানে কাজ করা অনেক সহজ হয়। এগুলো ছাড়াও অন্য আরেক ধরনের উপায় হল ম্যানেজার বা মানবস্পম্পদ কর্মীদের কাছে নিজের সমস্যার কথা খোলাখুলি বলা। একজন অসুস্থ মানুষ যে কতটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এর জন্য তার যে সাহায্যের দরকার সে বিষয়ে মানবসম্পদ বিভাগকে জানাতে হবে। এক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের সাহায্য দরকার তা নির্দিষ্ট করে বলা জরুরি। নিজের সমস্যার কথা কতখানি বললে তা গ্রহণযোগ্য হবে সে বিষয়ে নিজের বিবেচনা থাকা প্রয়োজন। এবং সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে। নিজের সুবিধা-অসুবিধার বিষয় এমনভাবে বলতে হবে যাতে অন্যরা তা বুঝতে পারে।
মানসিকভাবে অসুস্থদের জন্য বিশেষ সাহায্য পাওয়া যায় এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সংস্থা বা সংগঠনের কথা জানা আছে কি?
প্রথমজনের উত্তর: আমার মতে মানসিকভাবে অসুস্থদের জন্য অলাভজনক সংস্থাগুলোই বেশি গ্রহণযোগ্য। এখানে আমি আরেকটা কথাও বলতে চাই যে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার জন্য এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর এখনও সচেতনতা বৃদ্ধি ও কাজের পরিবেশ গড়ে তোলা দরকার। কিছু সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রয়েছে যারা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি বন্ধুমনোভাবাপন্ন। এক্ষেত্রে কিছু বড় সফট্ওয়্যার সংস্থাও রয়েছে, যেখানে সুস্থ কাজের পরিবেশ আছে।
কীভাবে একটা সংস্থার নিয়োগকর্তা ও কর্মচারীরা একযোগে মিলেমিশে কাজ করতে পারে?
প্রথমজনের উত্তর: আমার মনে হয় এক্ষেত্রে পারাস্পরিক বিশ্বাস অর্জন করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি আগেও যেমন একবার বলেছি তেমন আবারও বলছি যে এক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে কাজের প্রচেষ্টা করা একান্ত প্রয়োজনীয়।
যদি কেউ সদ্য মানসিক অসুস্থতা সারিয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায় তাহলে তার কী করণীয়? এক্ষেত্রে নিজের সম্পর্কে কতটা তথ্য সে প্রকাশ করতে পারবে?
প্রথমজনের উত্তর: এমন কিছু কর্মসংস্কৃতি রয়েছে যা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি নমনীয়। তাই সবসময়ে কাজের জায়গার কর্মসংস্কৃতি সম্পর্কে বেশি করে খবরাখবর নেওয়া দরকার, যে ম্যানেজারের অধীনে কাজ করতে হবে তার চরিত্র এবং যে ধরনের দলগত প্রচেষ্টার অংশ হতে হবে সে সম্পর্কে অনেক তথ্য জোগাড় করা জরুরি।
সাধারণত, এমন সমস্যার কথা বলে নেওয়া ভালো যা কর্মক্ষেত্রে নিজের কাজের উপর বা পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু প্রভাব ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা কাজের পদ্ধতিতে শিথিলতা এনে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে। এটা পারস্পরিক বিশ্বাস অর্জনের একটা পন্থা।
অন্যদিকে, আরেকটা প্রশ্ন হল কখন নিজের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করা জরুরি? ইন্টারভিউ-এর প্রথমে নাকি একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন একজন চাকরি পাওয়ার বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত হবে তখন? আমার মতে, মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের প্রথম বা দ্বিতীয় পর্যায়ে সংস্থার ম্যানেজার বা মানবসম্পদ বিভাগের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা ভালো।
একটা সংস্থায় মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য কী ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার?
প্রথমজনের উত্তর: যদি আমরা কোনও প্রতিষ্ঠানে মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গড়ে তুলি তাহলে তার সফলতার জন্য খুব সাজানোগোছানো উপায় অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি করে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এজন্য অক্ষমতা বিষয়ে, বিশেষ করে মানসিক অসুস্থতাজনিত অক্ষমতার বিষয়ে আলোচনা করা জরুরি। একটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাউন্সেলর বা থেরাপিস্ট নিয়োগ করে মানসিক অসুস্থতার বিষয়ে কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো উচিত।
দ্বিতীয়জনের উওর: অধিকাংশ কর্পোরেট সংস্থাই আজকাল নিজেদের লাভ ও টাকার কথাই ভাবে। তাই তাদের কাছে অন্যান্য বিষয়গুলো নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হয়। ব্যবস্থায় নতুন পরিবর্তন আনার জন্য আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই অক্ষমতার বিষয়ে কথা বলার সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।