কর্মক্ষেত্র

একটি সুস্থ কর্মক্ষেত্র বলতে কী বোঝায়?

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

আপনি হয়তো চিন্তা করছেন একটা সুস্থ কর্মক্ষেত্র ঠিক কেমন হতে পারে। দেখবেন তখন আপনার মনে অনেক চিন্তাভাবনা দেখা দিচ্ছে, যেমন- কর্মক্ষেত্রটি কি স্বাস্থ্যকর হবে, সেখানে কি কাজ করে আনন্দ পাওয়া যাবে, কর্মক্ষেত্রে কাজ করাটা কি সহজ ও স্বস্তিদায়ক হবে? অফিস কর্তৃপক্ষ কি কর্মচারীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে যত্মবান থাকবে? তারা কি কর্মচারীদের উপরে তাদের ক্ষমতার অতিরিক্ত  কাজের চাপ দেবে? কর্মচারী হিসেবে আপনি কি খুব স্বচ্ছন্দভাবে আপনার অফিসে যাতায়াত করতে পারছেন? কর্মক্ষেত্রের আবহাওয়া বা পরিবেশটি ঠিক কেমন হলে  ভালো হয়?

যেখানে নিজেদের কাজের জায়গাটিকে নিয়ে প্রত্যেক কর্মচারীদের মনে এসব সন্দেহ দানা বাঁধে সেখানে একটা স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার জন্য কর্মচারী ও কর্তৃপক্ষ- দু'জনেরই দায়িত্ব রয়েছে। তাই সুস্থ কর্মক্ষেত্রের স্বপ্নকে বাস্তব করার জন্য কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারী- দু'জনেরই অবদান থাকে।

পার্থক্য বা প্রভেদের গ্রহনযোগ্যতা

ভারতে এমপ্লয়ি অ্যাসিসট্যান্স প্রোগ্রাম (ইএপি)-এর অংশীদার চেস্টনাট গ্লোবাল পার্টনারস্‌ (সিজিপি) নামক সংস্থার প্রোগ্রাম ডিরেক্টর লিনিট নাযারেথ জীবনে এরকম বহু কর্মক্ষেত্রে কাজ করেছেন। কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি কতগুলো বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যেমন- কর্মজীবনের ভারসাম্য, বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি এবং কর্মচারীদের মানসিক ও অনুভূতিগত স্বাস্থ্য ও  শারীরিক সুস্থতা। লিনিটের মতে, ''যে কোনও কর্মক্ষেত্রের কর্মচারীদের একটা বড় ভূমিকা হল প্রভেদ বা পার্থক্যকে গ্রহণ করা বা স্বীকার করা; এই পার্থক্য পেশাগত, ভূমিকাগত বা ব্যক্তিত্বজনিত- সবরকমই হতে পারে। এসব পার্থক্যক স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে কর্মক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্যতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা সম্ভব।''

একটি কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের কাজের সুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষ নানারকম অদল-বদল করতে পারে এবং নতুন নিয়ম-নীতিও অন্তর্ভক্ত করতে পারে। যেমন-

  • শারীরিক, মানসিক বা অনুভূতিগত সমস্যার কারণে যখন কর্মচারীরা অফিসে এসে কাজ করতে পারবে না তখন তার যাতে বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করতে পারে সেক্ষেত্রে নিয়মকানুনের মধ্যে নমনীয়তা
    থাকা জরুরি।

  • যেসব কর্মরত মানুষ আসক্তির সমস্যা কাটিয় উঠেছে তাদের কাজের সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা একান্ত দরকার।

  • কর্মচারীদের মধ্যে অসচেতনমূলক পক্ষপাতিত্ব কমানোর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

  • চিন্তাভাবনা এবং ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনতে উৎসাহ দেওয়া।

  • একটি কর্মক্ষেত্রে কর্মরত সমস্ত কর্মচারীর সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।

কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তি যত বেশি হবে পার্থক্যগত গ্রহণযোগ্যতার হারও তত বাড়বে।

নেতৃত্বদানে উৎসাহ দেওয়া

কর্মক্ষেত্রের সব স্তরে একজন সুযোগ্য নেতার উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এর ফলে কর্মচারীরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হয়। একজন ম্যানেজারের উচিত নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে তাঁর দলের সদস্যদের সাহায্য করা। বিশেষ করে যেসব কর্মচারী মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার মোকাবিলা করছেন তাঁদেরকে খুব ভালোভাবে বোঝা প্রয়োজন। যেমন- এধরনের কর্মচারীদের সাহায্য করার জন্য একজন মানুষের উপস্থিতি ও উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করা দরকার, যার সাহায্যে মানসিক স্বাস্থের সমস্যায় আক্রান্তরা নিজেদের কাজ নিজেরা করতে পারবেন।

সুস্থতা এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা

যদি কর্মচারীরা দেখেন যে কর্মক্ষেত্রে তাদের সুস্থতা এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত রয়েছে তাহলে তারা খুশি হয়ে আবার পরেরদিন কাজে যাবেন ও কাজ ছেড়ে দেওয়ার  তাড়াও তাদের থাকবে না। কাজের ধরনের উপর কর্মচারীদের খুশি নির্ভর করে।  এছাড়া তাদের কাজের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী কৌশল স্থির করা, সঠিক কর্মনীতি মেনে চলা এবং শারীরিক স্বাচ্ছন্দ বোধের ব্যবস্থা করা অর্থাৎ যথাযথ বসার এবং হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা করা যাতে কর্মচারীরা স্বস্তিতে কাজ করতে পারে।

কাজের জায়গায় যাতে প্রতিটি কর্মচারী আলাদা-আলাদা জায়গায় বসে স্বস্তিতে কাজ করতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। এই ব্যবস্থাটি বিশেষ করে শারীরিক সমস্যা রয়েছে বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অথবা মানসিক সমস্যা রয়েছে এমন কর্মীদের জন্য বেশি করে প্রযোজ্য। এই প্রসঙ্গে লিনিট বলেছেন যে এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কর্মচারীদের কাছে এটা বোঝার সুযোগ থাকে যে সংস্থার কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি যত্নবান এবং এর ফলে তারাও চেষ্টা করবে তাদের ২০০ শতাংশ সেরা কাজটি দিয়ে ওই সংস্থার উন্নতি ঘটাতে।

কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের নিরাপত্তা বজায় থাকা একান্ত দরকার এবং প্রত্যেক কর্মচারী যাতে নিরাপদ থাকে সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা একান্ত জরুরি। এছাড়া এমন নিয়ম-নীতি গড়ে তোলা প্রয়োজন যা সবার পক্ষেই মানিয়ে নিতে সুবিধা হয় এবং সবাই যাতে সুস্থ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে সক্ষম হয়। যেমন- কর্ম-জীবনের ভারসাম্যের নীতি প্রচলন করা, প্রয়োজনে বাড়ি থেকে যাতে অফিসের কাজ করা যায় তার ব্যবস্থা করা, যন্ত্রপাতি ও কাজের উপকরণ সংক্রান্ত সঠিক নিয়মকানুন তৈরি করা, হেনস্থার ও যৌন-হেনস্থার বিরুদ্ধে সঠিক নীতি
নির্ধারণ করা।

একটি সংস্থায় কর্মচারীদের প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন

যাতে নানাধরনের মানুষ একসঙ্গে একটি সংস্থায় বিনা ভয়ে, বিনা কলঙ্কে, বিনা হেনস্থায় বা অন্যের দ্বারা আক্রমণের শিকার না হয়ে মিলেমিশে কাজ করতে পারে সেজন্য কর্মক্ষেত্রে তাদের প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি জরুরি। এই ব্যবস্থাটি মানসিকভাবে অসুস্থ, শারীরিকভাবে অসুস্থ, শারীরিক প্রতিবন্ধক, এলজিবিটি সম্প্রদায়, মহিলা, বিভিন্ন ধর্ম, জাতির মানুষ, আসক্তির হাত থেকে মুক্ত হওয়া একজন মানুষ প্রমুখের জন্য প্রযোজ্য। প্রয়োজনীয় সহায়তাদানের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা, সমানুভূতি এবং সংবেদনশীলতা এক্ষেত্রে একান্ত আবশ্যিক।

লিনিট বলেছেন, ''যদি আজ আমরা বিচিত্রকামী সম্প্রদায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করি এবং সমস্ত পরিবর্তনকামী, যার সঙ্গে এলজিবিটি সংক্রান্ত আইনকানুন জড়িত রয়েছে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি, তখন আপনাকে সেইসব  অন্যরকম মানুষের বিষয়ে জানতে হবে যাদের যৌন অভিমুখ ভিন্ন ধরনের। বাস্তবে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রটিও ঠিক এরকমই।''

একটি সংস্থায় কর্মরত সেইসব মানুষ যারা কাজ করতে পারে কিন্তু যাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের প্রতিও সংস্থার খোলামেলা চিন্তাভাবনা করা জরুরি। এছাড়া মানসিকভাবে অসুস্থদের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তবে প্রথমে তাদের একজন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে কাজের পরিবেশটিকে স্বাস্থ্যকর করে তোলাটা একান্ত আবশ্যক।

যোগাযোগের পথ পরিষ্কার ও খোলা রাখা জরুরি

কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেক কর্মচারীকে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্পষ্টভাবে  নির্দেশ দেওয়া প্রয়োজন; কর্মচারীরা যাতে নিজের দায়িত্ব একেবারে সঠিকভাবে পালন করতে পারে সেজন্য তাদের উৎসাহ দিতে হবে। একে অপরের প্রতি সংবেদনশীতা এবং সমানুভূতি তাদেরকে মানসিকভাবে খুশি করতে পারে। যদি সংস্থার ম্যানেজার দেখেন যে কোনও কর্মচারী সমস্যা বা দুর্দশার মধ্যে রয়েছে তাহলে তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ একজন ম্যানেজারের থাকা উচিত। এর ফলে অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যেও মানসিক অবক্ষয়ের হার কমবে, পারস্পরিক যোগাযোগের পরিমাণ বাড়বে, তারা খুশি থাকবে ও কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। আর এভাবেই একটি সুস্থ কর্মক্ষেত্রও গড়ে উঠবে।

এছাড়াও একটি স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল কর্মরতদের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহ দেওয়া এবং তাদের ভালো কাজের
প্রশংসা করা।

এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য সাহায্য করেছেন সিজিপি ইন্ডিয়ার প্রোগ্রাম ডিরেক্টর লিনিট নাযারেথ। তিনি এমন অনেক ক্লায়েন্টকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন যেখানে কর্ম-জীবনের ভারসাম্য, বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কর্মচারীদের শারীরিক, মানসিক এবং অনুভূতিগত স্বাস্থ্যের সুস্থতার বিষয়েও ওইসব অনুষ্ঠানে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।