মানসিক রোগ নিরাময়ে আয়ুর্বেদ কতদূর কার্যকরী?

মানসিক রোগ নিরাময়ে আয়ুর্বেদ কতদূর কার্যকরী?

স্ট্র্যাপঃ পরিপূরক ওষুধ হিসেবে আচরণগত রোগ সারাবার জন্যে ফলপ্রসূ।

বাইশ বছরের মেয়ে সুধা কলা বিভাগের বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে কিন্তু সে বরাবর উদ্বিগ্নতায় ভুগতো। আগে যা সামান্য উদ্বেগ ছিল, সময়ের সাথে সাথে তা বেড়ে সমস্যার আকার ধারণ করেছিল। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া আর মাথা ঘোরানো মতো উপসর্গ দেখা দেওয়ায় সে একজন জেনারেল ফিজিসিয়ানের কাছে যায় যিনি সব উপসর্গের কথা শুনে সুধাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবোধানে ওষুধ খেয়ে সুধা অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিল। রোগের উপসর্গ থেকে মুক্তি পাওয়া সত্ত্বেও ওর মন ঠিক শান্তি পাচ্ছিল না, এত ওসুধ নিয়মিত খেতে হচ্ছিল বলে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করার ফলে তিনি ওকে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন যাতে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খাওয়া সে কিছুটা কম করতে পারে।

ভারতবর্ষে বাস করা বেশীর ভাগ মানুষের কাছে আয়ুর্বেদ এক প্রাচীন চিকিৎসাপদ্ধতি রূপে পরিচিত, কিন্তু সম্প্রীতি কালে মানসিক রোগ চিকিৎসায় রোগীর ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য আয়ুর্বেদ অ্যালোপ্যাথি ওষুধের পরিপুরক হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে । যদিও আয়ুর্বেদকে এখন অন্য ওষুধের সাথে পরিপুরক রূপে ব্যবহার করা হচ্ছে কিন্তু ভালো করে আয়ুর্বেদ নিয়ে পড়াশুনা করে আমরা জেনেছি যে মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রচুর তথ্য আয়ুর্বেদে আগে থেকেই রয়েছে।

আয়ুর্বেদের মতে একজন মানুষের ভালো স্বাস্থ্য নির্ভর করে তাঁর শারীরিক আর মানসতত্ত্বের সমতার উপর (সমদোশঃ); সব ধরনের শারীরিক উর্জার সমতার উপর (সমগ্নিস্চ); শরীরের সব অঙ্গের টিস্যুর সক্রিয়তার উপর (সমধাতু); পাশাপাশি মল-মুত্র ত্যাগের সঠিক প্রক্রিয়া বজায় থাকার ওপর(মলক্রিয়া); সুখী আত্মা (প্রসন্নাত্মা), সুখী আর সক্রিয় মন (প্রসন্নমনঃ) এবং আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়র (সমইন্দ্রিয়) সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যক্ষমতার ওপর।

খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে অ্যালোপ্যাথি খুব তাড়াতাড়ি উপসর্গগুলো কে নির্মূল করে দিতে পারে, অন্যদিকে আয়ুর্বেদের মতে যে কোনো উপসর্গ (শারীরিক বা মানসিক) ওপরে বিবরণ দেওয়া কারণগুলির জন্যই হয়। আয়ুর্বেদাচার্যদের মতে সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি হল সার্বিকভাবে সমস্যার কারন বুঝে রোগ নিরাময়ের উপায় নির্ধারণ করা। এই কারনেই অনেক মানসিক রোগ চিকিৎসকের বিশ্বাস যে আয়ুর্বেদ পুরোপুরিভাবে মানসিক রোগ নিরাময়ে সক্ষম না হলেও পরিপুরক ওষুধ হিসেবে কার্যকরী এবং এতে রোগীকে সুফল পেতে দেখা গিয়েছে।  

আয়ুর্বেদ – আয়ু (বয়েস) + বেদ (বিজ্ঞান), এই দুটো মিলিয়ে জীবনের বিজ্ঞান। এমন এক ধরনের বিজ্ঞান যা শরীর, মন আর আত্মাকে সামগ্রিকভাবে সুস্বাস্থ্যের পরিমাপ হিসেবে গ্রাজ্য করে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন হওয়ার ফলে আয়ুর্বেদ নতুন করে আবার জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এতদিন আমরা শুধু জানতাম যে আয়ুর্বেদ শরীরের রোগ সারায়, কিন্তু মানসিক রোগ সারাতে আয়ুর্বেদের ভুমিকা এখন প্রচলিত সত্য।

আয়ুর্বেদ এবং মানসিক স্বাস্থ্য

নিমহ্যান্স-এর এডভান্সড সেন্টার ফর আয়ুর্বেদা ইন মেন্টাল হেল্‌থের, এসিস্টেন্ট ডিরেক্টার, ডাঃ ডি সুধাকার-এর মতে, “আয়ুর্বেদ অ্যালোপ্যাথি ওষুধের পরিপুরক হিসেবে বিভিন্ন মানসিক রোগ যেমন  উদ্বেগ, ডিপ্রেশন,ওসিডি সারাতে বিশেষভাবে উপকারি। গবেষণা করে দেখা গিয়েছে যে আয়ুর্বেদিক ওষুধের সেবন ক্রমশ অ্যালোপ্যাথির ওষুধের ওপর রোগীর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিতে সক্ষম,”। উনি এটাও বলেছেন যে সময়ের সাথে সাথে আয়ুর্বেদিক ওষুধ সেবন করার ফলে অনেক রোগী সম্পূর্ণভাবে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিতে পেরেছেন।

আয়ুর্বেদের সাহায্যে রোগীর মধ্যে সার্বিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব যা অ্যালোপ্যাথির উপসর্গ নিরাময় পদ্ধতিতে সম্ভব হয়না। আয়ুর্বদ শুধু ভেষজ ওষুধ সেবনের কথা বলে না, ওষুধের সাথে সাথে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করা, নিয়মিত যোগব্যায়াম করার ওপরও জোর দেওয়া হয়। শুধুমাত্র শারীরিক ও মানসিক রোগ সারাবার জন্য নয়, আয়ুর্বেদ মানুষের জীবনে একটা পরিপূর্ণ পরিবর্তন আনে যাতে ভবিষ্যতেও ব্যক্তি রোগ মুক্ত থাকতে পারেন।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাপদ্ধতিতে সুস্বাস্থ্যের পরিভাষায় মানসিক স্বাস্থ্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আয়ুর্বেদে আমাদের শরীর, মন, আত্মা এবং ইন্দ্রিয়র মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ  সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আয়ুর্বেদে এই ভাবে ব্যাখা করা হয়েছে -

  • একজন মানুষের সামগ্রিক গঠন তার শরীর, মন, আত্মা এবং ইন্দ্রিয়র সম্মেলন। এর মধ্যে মানসিক বোধ (জ্ঞানন্দ্রিয়) ও শারীরিক বোধ (কর্মেন্দ্রিয়) রয়েছে। এই সবের সঠিক কার্যকারিতা মিলিয়ে একজন ব্যক্তির সুস্বাস্থ্য নির্ধারণ করা হয়।

  • মন বা মানসের তিনটি ভাগ –সত্তা, রাজস ও তমস। এদেরকে গুন ও বলা হয় যা শারীরিক চরিত্র বা তত্ত্ব নির্ধারণ করে। সত্ত গুন তিনটি ভাগের ওপর নির্ভরশীল - আত্মনিয়ন্ত্রন, জ্ঞান, ঠিক বা ভুলের বিবেচনা করার ক্ষমতা। রাজস গুন নির্ধারণ করে মানুষের চলমান ক্ষমতা, ক্রোধ, ঈর্ষা, শাসনক্ষমতা, কামনা আর দ্বন্দ। তমস জাতিয় ব্যক্তিরা একটু বোকা, আলস প্রকৃতির, ঝিমিয়ে থাকা বা ঘুমকাতর হয়ে থাকেন। রাজস এবং তমস কে মনোদশা বলা হয়। এই তিনটি গুণ, সত্ত, রাজস এবং তমস-এর মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব মানসিক সমস্যার কারন হয় যাকে মনোবিকার বলা হয়।

শরীর প্রকৃতির তিনটি জৈব-মানসিক তত্ত্ব সমুহ - বট(বায়ু), পিত্ত্ (অগ্নি), কফ (ধরিত্রী) –র মিশ্রন। এই তিনটি তত্ত্ব সমুহকে ত্রিদশা বলা হয়। বিগত দশ বছর ধরে আয়ুর্বেদ নিয়ে গবেষণারত ডাঃ রঘুরাম, এম ডি (আয়ুর্বেদ) বেঙ্গালুরু-তে আয়ুর্বেদের সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক। তাঁর মতে ত্রিদশাগুলো আসলে চারিত্রিক ভাবে নেতিবাচক বা দোষ-ও বলা যেতে পারে কিন্তু এইগুলো শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে প্রয়োজনীয়। এই তিনটের মধ্যে যেকোনো একটা দোষে অসামাঞ্জস্য দেখা দিলে শরীরের কোন অঙ্গে বা সামগ্রিক ভাবে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। শরীর খারাপ হলে মানুষের মনেও তার প্রভাব পড়ে। সেই জন্যে আয়ুর্বেদে শরীর এবং মন দুটোরই চিকিৎসা করা হয়।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা গবেষণার মাধ্যমে আয়ুর্বেদের উপকারিতা বা বিভিন্ন ধরনের মানসিক বিকার যেমন উদ্বেগ বা ডিপ্রেশনের ওপর বিশিষ্ট ওষুধের প্রভাব বিশ্লেষণ করে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা লক্ষ্য করেছেন।

“আয়ুর্বেদ শারীরিক রোগ নিরাময়ে তো আগের থেকেই কার্যকরী, কিন্তু মানসিক রোগের চিকিৎসায় এর উপকারিতার প্রমাণ সাম্প্রতিককালে পাওয়া গিয়েছে,” বলেছেন ডাঃ সুধাকার।

তথ্যসূত্র:

  • ড্রাফ্‌ট অফ রেফারেন্স ডকুমেন্ট অন “আয়ুশ ইন মেন্টাল হেলথ”, ডাঃ সুধাকার, ডাঃ স্রিনিভাস সাহু, ডাঃ বি সি এস রাও, ফর এডভান্সড সেন্টার ফর আয়ুর্বেদ ইন মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসাইন্সেস, নিমহ্যান্স, বেঙ্গালুরু।

  • ডাঃ রাঘুরাম এম ডি (আয়ুর্বেদ), আয়ুর্বেদিক রিউমাটলজি, কন্সাল্টেন্ট আয়ুর্বেদিক ফিজিসিয়ান, বেঙ্গালুরু।

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org