সাক্ষাৎকার: মানসিক চাপ কি মহিলাদের স্তনদানের অভিজ্ঞতার উপর কুপ্রভাব ফেলতে পারে?

সাক্ষাৎকার: মানসিক চাপ কি মহিলাদের স্তনদানের অভিজ্ঞতার উপর কুপ্রভাব ফেলতে পারে?

নতুন মাতৃত্ব একজন মহিলার জীবনে পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণের সূচনা করে। প্রত্যেক মহিলার জীবনেই গর্ভধারণকাল, মাতৃত্ব এবং স্তনদানের অভিজ্ঞতা আলাদা হয়। আজকের দিনে স্তনদান সম্পর্কে একজন নতুন মায়ের সচেতনতা বা জ্ঞান পর্যাপ্ত থাকে না। যদি মাতৃত্বের শুরুতেই এই অভিজ্ঞতা সুখের না হয় তাহলে এই পরিস্থিতি মানসিক চাপ এবং কখনও কখনও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

স্তনদান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে যোগসূত্র বোঝার জন্য হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শ্রীরঞ্জিতা জেউরকর কথা বলেছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ল্যাকটেশন কনসালট্যান্ট ডঃ তরু স্নেহ জিন্দাল-এর সঙ্গে।

ধিকাংশ মানুষ মনে করে যে বাচ্চাকে স্তনপান করানো মহিলাদের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া এবং প্রত্যেক মা বাচ্চাকে স্তনদান করে খুব তৃপ্তি পায়। এটা কি সত্যি?

একদিক থেকে এই প্রক্রিয়াটি মহিলাদের প্রবৃত্তিগত। অধিকাংশ মা তার বাচ্চাকে স্তনদান করে খুব তৃপ্ত হয় এবং বারবার সন্তানকে স্তনপান করাতে চায়। কিন্তু অধিকাংশ মা ল্যাকটেশনের জন্য পুরোপুরি অপ্রস্তুত থাকে। এবং শেষমেশ এই বিষয়টি মায়েদের কাছে খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। এর কারণ হল চিকিৎসার সাহায্য ও পরামর্শের অভাব এবং বাচ্চাকে স্তনপান করানোর ক্ষেত্রে সাহায্য না পাওয়া। বহু মা জানেই না যে কীভাবে বাচ্চাকে স্তনপান করাতে হয়। ফলে তাদের স্তনবৃন্তজনিত সমস্যা ও তা থেকে রক্তপাতের দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়। তাই এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা তৃপ্তি লাভ করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তাদের নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

স্তনদানের জন্য কি মায়েদের মানসিক চাপ জন্মায়?

প্রথমবার মা হতে যাচ্ছে এমন মহিলাদের ক্ষেত্রে বাচ্চাকে স্তনপান করানো মানসিক চাপের কাজ বলে মনে হতে পারে। কারণ এই বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত থাকে। এখন যৌথ পরিবারের বদলে একক পরিবারই বেশি দেখা যায়। তাই নতুন মা হওয়ার পরে একজন মহিলার পরিবারের কাছ থেকে যে সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে সেই সাহায্য তারা পায় না। স্বামীরাও অধিকাংশ সময়ে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না। তাই সেক্ষেত্রে স্ত্রীরা স্বামীদের সহায়তা লাভ থেকেও বঞ্চিত হয়।

আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলোতেও এই বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কর্মজগতে স্তনদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়। এক্ষেত্রে হয় তাদের বাচ্চাকে স্তনপান করানো বন্ধ রেখে কাজে যোগ দিতে হয় বা একেবারে কাজ বন্ধ করে দিয়ে বাচ্চাকে স্তনপান করানো বজায় রাখতে হয়। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে স্থায়ী রোজগারের অভাব এইসময়ে মায়েদের মনে মানসিক চাপের জন্ম দেয়।

কীভাবে স্তনদানের প্রভাব একজন মহিলার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পড়তে পারে?

বাচ্চাকে স্তনপানের করানোর সময়ে মায়েদের শরীর থেকে যে অক্সিটোসিন নির্গত হয়, তাতে মায়েরা স্বস্তি অনুভব করে। এটা তাদের চাপমুক্ত করতে এবং সন্তানের সঙ্গে বন্ধন, মায়া, মমতা, গড়ে তুলতে সাহায্য করে। স্তনদান না করলে মায়েরা এই  অনুভূতিগুলোর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। এর পাশাপাশি বারবার বোতল ফোটানো আর ফর্মুলা দুধ বানানো একটা বড় ধকল। কিছু মা মনে করেন যে বাচ্চাকে বোতলের দুধ খাওয়ানো অনেক বেশী ক্লান্তিকর কাজ। অন্যদিকে বাচ্চাকে স্তনপান না করানোর জন্যও মায়েদের মধ্যে একপ্রকার অপরাধ বোধ জাগে। সেই সঙ্গে বাচ্চাকে স্তনদানের মতো প্রাকৃতিক একটা প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে না পারার জন্য তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়।

যেসব মহিলাদের স্তনদানের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয় সেসব ক্ষেত্রে কী ঘটে? কীভাবে তাদের মনে এই ঘটনার প্রভাব পড়ে?

আমি এমন অনেক মাকে দেখেছি যারা বাচ্চাকে যথাযথভাবে স্তনপান না করানোর জন্য মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিল। সেই সময়ে পর্যাপ্ত সাহায্য না পাওয়ার ফলে ওই ঘটনা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলেছিল।

এমন অনেক মা আছে যারা ঠিক করে যে তারা তাদের সন্তানকে স্তনপান করাবে না। এই ঘটনায় তাদের চারপাশে থাকা মানুষজনের প্রতিক্রিয়া কীভাবে ওই মায়েরা মোকাবিলা করে?

স্তনপান না করানোর পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। বোতলের দুধ খাওয়ানোর সুবিধা থেকে নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং স্বাধীনতার চাহিদা, প্রত্যেকের কারণ আলাদা হতে পারে। কিন্তু যেসব মায়েরা তাদের বাচ্চাকে স্তনপান করাতে ইচ্ছুক থাকে না তারা সমাজের চোখে খুব হেয় বলে প্রতিপন্ন হয়। এর ফলে স্তনদানকারী মায়েদের থেকে তারা নিজেদের খাটো করে দেখে, হীনম্মন্যতায় ভোগে। আর এই থেকেই তাদের মধ্যে অপরাধ বোধ ও আত্মনির্ভরতা বা আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়। এই ঘটনা কোনওভাবেই নতুন মা ও তার সদ্যোজাত সন্তানের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ও সঠিক লালনপালনে সাহায্য করে না। কারণ মায়েদের জন্য কখনোই মানসিক চাপ ভালো নয়। প্রাথমিক পর্বে মানসিক চাপের ফলে মাতৃদুগ্ধের নিঃসরণ কমে যায়। মস্তিষ্ক থেকে নির্গত অক্সিটোসিনের সঙ্গে মানসিক চাপের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। নতুন মায়েরা যাতে তাদের পছন্দ-অপছন্দের ভালো-মন্দ নিয়ে সচেতন থাকে সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি ও আশ্বাস থাকা জরুরি। সেই সঙ্গে তারা তাদের বাচ্চাকে স্তনপান করানোর ক্ষেত্রে যা-ই সিদ্ধান্ত নিক না কেন, তার প্রতি আমাদের সম্মান দেখানো প্রয়োজন।

বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য কিছু মায়ের বুকের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না- তখন তা কী ধরনের সমস্যার জন্ম দেয়?

আজকের দিনে হাসপাতালের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী প্রসবের একদম পরে-পরেই বাচ্চা ও মাকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কখনও বাচ্চার জন্মের ঠিক পরেই মাকে তার বাচ্চাকে স্পর্শ করার অনুমতি দেওয়া হয় না এবং নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া সাধনের জন্য বাচ্চাকে মায়ের থেকে দূরে রাখা হয়। এর ফলে বাচ্চার স্বাভাবিক প্রবণতা – মায়ের স্তন খুঁজে আপনা থেকে চোষা, যাকে “ব্রেস্টক্রল” (breastcrawl) বলা হয় – হয়ে উঠে না। এই ঘটনাটি বাচ্চার জন্মের পর এক ঘণ্টার মধ্যেই ঘটা উচিত। তবে মাঝে মাঝে তা ঘটতে দেরি হয়। যেসব মায়েদের সিজার করা হয় তাদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটতে আরও দেরি হতে পারে। তবে বাচ্চার জন্ম কীভাবে হয়েছে তা এখানে ততটা বিবেচনাধীন বিষয় নয়। সমস্যাটা শুরু হয় বাচ্চার জন্মের পর স্তনদান করার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটার মধ্য দিয়ে। এবং প্রক্রিয়ার শুরু যদি সুখের না হয়, তাহলে মায়েদের মনে একপ্রকার বিষণ্ণতা ও হতাশা জেগে ওঠে।

আমার মতে, স্তনদানের ক্ষেত্রে হাসপাতালের নিয়মনীতিকে আরও সহজ-সরল হয়ে উঠতে হবে। তাহলেই মানসিক চাপের পরিমাণ অনেক কমানো সম্ভব হবে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে 'স্তনদান প্রক্রিয়া'-র বিকাশ ঘটানো জরুরি। আর তাই জন্মের পরে মা-বাচ্চার বিচ্ছেদ কম করা প্রয়োজন এবং তারা যাতে কাছাকাছি থাকতে পারে ও মা যাতে বাচ্চাকে স্বচ্ছন্দভাবে স্তনদান করতে পারে সেদিকে উৎসাহ দেওয়া জরুরি।

স্তনদানকারী মাকে সাহায্য করার জন্য, বিশেষ করে তার মানসিক সুস্থতার জন্য পরিবারের সদস্য ও স্বামীর কী করণীয় থাকে?

সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে একজন নতুন মা পুরোপুরি দিশাহারা হয়ে ওঠে। যদি  সে এইসময়ে ঘর-গৃহস্থালির কাজ, রান্নাবান্না বা বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর কাজে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য না পায় তাহলে নতুন মায়েরা বড়সড় সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। হঠাৎ করে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়া আর ঘুম কমে যাওয়ার পাশাপাশি যদি তারা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ঠিকঠাক সাহায্য না পায় তাহলে তাদের উপর চাপ ক্রমশ বেড়ে চলে। পরিবারের সাহায্য না পেলে মায়েরা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে বোতলের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে পারে।

মহিলাদের জীবনে এইসময়ে তাদের স্বামীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজে পরিবারগুলো একটা বাচ্চা জন্মানোর প্রাথমিক পর্বে তার বাবাকে পরিচর্যার কাজ থেকে দূরে রাখতে চায়। কারণ পরিবারের সদস্যরা ভাবে যে বাবারা এই কাজে একদমই যোগ্য নয়। তাই নতুন মাকে তারা কোনওভাবেই সহায়তা করতে সক্ষম হবে না। সে কারণে একজন নতুন মা তার জীবনের সবচাইতে কঠিন সময়ে বাচ্চার বাবার অর্থাৎ নিজের কাছের মানুষ বা স্বামীর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাই যদি বাচ্চার বাবারা এই বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে পরিচর্যার কাজে নিজেদের যুক্ত করে তাহলে মায়ের ক্ষেত্রে বাচ্চাকে স্তনদান করার কাজটা আরও সহজ ও সফল হয়।

ফেসবুকে স্তনপানের উপর ল্যাকটেশন ম্যাটার্‌স পেজটির সঞ্চালনা করেন তরু জিন্দাল। হোয়াটস্‌অ্যাপেও তিনি স্তনদানকারী মায়েদের জন্য সাপোর্ট গ্রুপ গড়ে তুলেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য নীচের ঠিকানায় যোগাযোগ করা যাবে- tarujindal@yahoo.co.uk.                 

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org