প্রতিবাদের সময় আপনার এবং আমার মানসিক স্বাস্থ্য

প্রতিবাদের সময় আপনার এবং আমার মানসিক স্বাস্থ্য

আমি অভিজ্ঞ প্রতিবাদী নই। আমি নির্জনতাপ্রিয় মানুষ - কোনও দলের সঙ্গেই মেলামেশা করিনা এবং সামাজিক মাধ্যমগুলিতে খুব সামান্য উপস্থিতি রাখি। একজন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে আমার রোজকার কাজের প্রভাব এবং বর্তমান সমাজে আমার আশেপাশের যেসব ঘটনার আমি সাক্ষী সেই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা সারাক্ষণ করে চলি। এর ফলে আমি সবসময় আতঙ্কে থাকি যে অবিশ্বাস বা হতাশা আমাকে যেকোনো মুহূর্তে গ্রাস করে ফেলবে।  

কাজেই, দিল্লীর একটি ঠাণ্ডা, মেঘলা দিনে অস্বাস্থ্যকর এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স (হওয়ায় বস্তুকণার মাত্রা) কে অগ্রাহ্য করে প্রতিবাদ করার জন্য রাস্তায় নামার আগে সাহসের প্রয়োজন পড়েছিল। আমি সেখানে এই সরকারের আদর্শ এবং নীতির বিরুদ্ধে মতবিরোধ প্রকাশ করতে গিয়েছিলাম যেই সরকারকে আমি ভোট দিইনি।  

লাঠি চার্জ আর কাঁদুনে গ্যাস ছোঁড়ার সম্ভাবনার আতঙ্ক মাথায় নিয়ে পুলিশের অনুমতি ছাড়া এই ধরণের কাজ করতে সাহস তো লাগেই। কিন্তু প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে যাওয়া আমার বরাবরের স্বভাব। ব্যক্তিগতভাবে এর অন্য অর্থ ছিল নিজেকে সামাজিকভাবে গুটিয়ে রাখার প্রবণতাকে ত্যাগ করে একটি মতাদর্শের পাশে দাঁড়ানো - সাধারন জনতা এখন যে পরিস্থিতির সম্মুখীন সেই হতাশা, ক্রমশ বেড়ে চলা উদ্বেগ ও নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে কিছু একটা করা।

আমার কাছে এটা আমার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতীক।

মানসিক স্বাস্থ্য মানেই শান্ত থাকা নয়। যেটা যেরকম সেইরকম ভাবে তাকে মেনে নেওয়া – বাস্তব সম্মত; আন্তরিক অথবা আবেগের দিক দিয়ে আবার বাইরের বা তুলনামূলক ভাবে। মানসিক স্বাস্থ্য হল সবরকম আবেগকে উপলব্ধি করা। উদ্দীপনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিক্রিয়া করা – হলই বা সেগুলি জট পাকানো বা মিশ্রিত। কিছু হারিয়ে গেলে দুঃখ পাওয়া, অনধিকার প্রবেশের কারণে রাগ হওয়া, যার প্রতি টান রয়েছে তাকে ভালোবাসা, কোনও কিছুর পূর্বাভাস পেলে উত্তেজিত হওয়া - সবই এর চিহ্ন।

ক্রোধ, দুঃখ, ভয় এবং অপরাধ বোধ এই সমস্ত অনুভূতিগুলি সম্পর্কে আমি অবহিত। এটি এমন একটি মিশ্রণ যেটা কারুর মানসিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী, তবুও, আমি যা অনুভব করছি সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের দুর্বলতা নয়। হতাশা, নৈরাশ্য এবং অসহায়তার একটি অবস্থার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একই ভাবে থেকে যাওয়া - এইগুলি অন্তরিক অভিজ্ঞতা যা মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিকে আরও জোরালো করে, অবসাদ এবং হাল ছেড়ে দেওয়ার দিকে ঠেলে দেয়।

আপনার চারপাশে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই মুহূর্তে যা ঘটে চলেছে সেটা আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে নাড়া দিতে পারে বা আপনার মনে হতে পারে যে এই ঘটনাগুলির সাথে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা নির্ভর করে এই বিষয়গুলি নিয়ে আপনার নিজস্ব মতামত এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর। এই সমস্যাগুলিকে যত বেশি ব্যক্তিগত মনে হবে, ততই বিপন্ন বোধ করবেন। আমি আমার পেশাদারী অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি যে তরুণ সম্প্রদায় অহরহ চেষ্টা করে আঘাত বা যন্ত্রণার স্রোতের থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে এবং এইসব চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলতে। এইসবের জন্য এখন নানা ধরনের উপায় আছে – মুঠোফোন এবং সামাজিক মাধ্যম, মদ এবং ঔদাসীন্য, ড্রাগস এবং অস্বীকার করার প্রবণতা। এইগুলি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার একটা ভালো উপায় হতে পারে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এইগুলি কোনোভাবেই মানসিক সুস্থতার চিহ্ন বা উপায় হতে পারে না।

বিকল্পরূপে আমরা অন্য একটি পন্থা বেছে নিতে পারি যেটা একটা চিরায়ত মেরুকরণ পদ্ধতি - নিজেদের আবেগকে ভাগ করে যাদের ভালবাসি এবং যাদের ঘৃণা করি তাদের পৃথক করে নেওয়া, এই অস্বস্তিকর ব্যাপারটি খেয়াল না করে যে এই শ্রেণীগুলি পরস্পর বিরোধী নয়। এটা একটা নির্দিষ্ট দল ও আদর্শের অন্তর্গত থাকার ধারনা তৈরি করে, কিন্তু এটা একপ্রকার মেকি প্রশান্তি যেটা মানুষের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের জটিলতাকে অস্বীকার করে।

তৃতীয় পদ্ধতিও রয়েছে। সেটা হল নিজের বক্তব্য সমর্থক এবং বিরোধীদের সামনে সমানভাবে রাখা এবং যা ঘটছে তার সাথে সরাসরিভাবে যুক্ত হওয়া। আমার কাছে এটাই সবথেকে স্বাস্থ্যকর কর্মকৌশল যদিও এটা যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য এবং আমাদের আবেগকে তীব্র ভাবে প্রভাবিত করে।

আমরা যে পদ্ধতিই বেছে নিই না কেন, সবগুলোরই তলার পরতে একই ধরনের বিপন্নতা, উদ্বেগ এবং তীব্র আবেগ কাজ করে। কর্মক্রম বেছে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আমরা যে ধরণের কাজের সাথে যুক্ত হতে চাই এবং যা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব সেই মানসিকতাই প্রকাশ পায়।

যে কোন বয়স এবং পটভূমির প্রতিবাদী হিসেবে আমাদের নিজেদের প্রতিনিয়ত এই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলি করতে হবে – আমি কী নিয়ে প্রতিবাদ করছি? আমি কোন বিষয়ে নিয়ে প্রবল ভাবে সংবেদনশীল? আমার কোন মূল্যবোধ গুলিতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করা হচ্ছে? এই ব্যাপারে আমার অনুভূতি কী?   

বুদ্ধিজীবী হিসেবে এই প্রশ্নগুলো আমাদের ক্ষেত্রে অপরিহার্য, যার অভাবে এইগুলি আমাদেরকে গ্রাস করতে পারে:

  • অপরাধবোধ - যেটা সক্রিয় প্রতিবাদের জন্য যথেষ্ট কারণ নয়, এবং এর প্রকৃতি দীর্ঘমেয়াদি নয়, এবং / অথবা

  • দলগত ভাবনা – যে কোনও দল হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য সুবিদিত এবং প্রাথমিক ভাবে মূলত দ্বিমাত্রিক চিন্তার অধিকারী – আমরা বনাম তারা অথবা ভালো বনাম মন্দ। কোনও একটা প্রয়োজনের জন্য উদ্বেল হয়ে পড়লে সেটা আমাদের এমন সব কাজের মধ্যে ঠেলে দেয় যেটা আমাদের অন্তরের চাহিদা প্রকাশ করেনা বা যার সাথে আমাদের সঙ্গতিও থাকে না।

যেদিন থেকে আমি “এই বড়দিনে আমি চাই নূতন একটি সরকার” মতাদর্শের সাথে সুর মিলিয়েছি, আমি দেখেছি মহিলাদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ (শাহিনবাগের); বসে করা প্রতিবাদ (নিজামুদ্দিন); কবিতা আবৃত্তির দ্বারা প্রতিবাদ; শিল্পিদের - গান গেয়ে করা প্রতিবাদ (ইন্ডিয়া গেট); ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ যারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন এই স্রোতের সাথে যুক্ত হওয়ার তাগিদে (যন্তর মন্তর)। এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে এই শীত যথেষ্ট দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং আমাদের শক্তি সঞ্চয়ের নানারকম পথ খুঁজে বার করতে হবে যাতে আমাদের কণ্ঠস্বরের জোর সময়ের সাথে সাথে কমে না আসে।

প্রতিবাদের সাথে নানা উপায়ে যুক্ত হওয়া যায়। যেটুকু আপনার পক্ষে এই সময় করা সম্ভব ঠিক ততটাই করুন কারণ এই যাত্রাপথ দীর্ঘ এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল নিজের ক্ষমতা বুঝে নিজের ছন্দ ঠিক করা।  

শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে আমি নিজেকে পুনর্জীবিত করার রাস্তা খুঁজতে থাকি। অনলাইন সাপোর্ট খুঁজে পেয়ে আমি বেশ খুশী হয়েছিলাম। 

এখানে একটি তালিকা দিচ্ছি যেটা নিজের জন্য বানিয়েছি :

  • খাদ্য, জল এবং বিশ্রাম।

  • টুইটার এবং সংবাদের থেকে বিরতি নেওয়া – এটা তিনদিন পরে দেখলেও কোনও ক্ষতি হবে না।

  • নিকট আত্মীয় ও বন্ধুদের উষ্ণতা। এই বন্ধনের স্থায়িত্ব রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা কে ছাপিয়ে যাবে।

  • অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যারা আপনার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে।

  • ব্যায়াম – দৌড়ানো, যোগ ব্যায়াম বা নৃত্য। শরীর মনকে সবসময় ফিডব্যাক দেয়। শরীর শক্তি সঞ্চয় করলে সেটা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও কাজে লাগে।

  • শেষ এবং সবচাইতে চমকপ্রদ হাতিয়ার – বুট জুতো পরা। বুট পরার ইতিহাস বেশি শক্তিসম্পন্ন দলগুলির সাথে জড়িয়ে এবং এটি দুর্বল জনতার ওপর সেনাদলের কুচকাওয়াজ করার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু একজোড়া বুট জুতো যে কিনতে পারে তারই থাকতে পারে। বুট জুতো প্রতিটি পদক্ষেপকে শক্তিশালী করে, শারীরিক ভঙ্গিকে উন্নত করে এবং এর সাথে সঙ্কল্পকে আরও জোরদার করে তোলে। এছাড়া, ঠাণ্ডা কে আমি অপছন্দ করি তাই এগুলি আমার পায়ের পাতাকে শীত থেকে বাঁচায়।

ডাঃ নূপুর ধিংরা পাইভা একজন মনোবিজ্ঞানী এবং লেখিকা।

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org