১০০ জন মাদকাসক্ত মানুষের মধ্যে মাত্র ৩ জন তাদের সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজে। এক্ষেত্রে আমাদের কী করা জরুরি?

১০০ জন মাদকাসক্ত মানুষের মধ্যে মাত্র ৩ জন তাদের সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজে। এক্ষেত্রে আমাদের কী করা জরুরি?

সম্প্রতি ভারতে নিমহ্যান্স একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার ব্যবস্থা করেছিল।  সেই সমীক্ষায় দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নেশায় আক্রান্ত মানুষের কয়েকটি সংখ্যাতাত্ত্বিক নমুনা প্রকাশ করা হয়।

কেন এত অল্প সংখ্যক মানুষ তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে?

প্রথম বাধা- অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারে না যে অ্যালকোহলের প্রতি আসক্তি একপ্রকার সমস্যা, যা সমাধানের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই আসক্তিকে একপ্রকার নৈতিক সমস্যা (যেমন- ''মদ্যপান খুব বাজে অভ্যাস'') বা মন্দ পছন্দ অথবা নোংরা রুচির (যেমন- ''তোমার দরকার নিজেকে সংযত করা'') পরিচয় বলে মনে করে।

কিন্তু বাস্তবটা ঠিক কী- আসক্তির পিছনে নানারকম জিনের মিশ্রণ, ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা এবং সামাজিক প্রভাব রয়েছে। এর পিছনে মানুষের ইচ্ছাশক্তির প্রভাব অত্যন্ত অল্প।

দ্বিতীয় বাধা- অধিকাংশ মানুষ ধূমপান, মদ্যপান বা মাদক ব্যবহারের জন্য নিজেদের শারীরিক সমস্যার কথা চিন্তাভাবনা করে না। এসব নেশায় আক্রান্ত মানুষ ডাক্তারের কাছে নিজেদের ঘুমের সমস্যা, দুর্বলতা, খিদে না পাওয়া, মাথাব্যথা প্রভৃতি সমস্যার কথা বলে। কিছু মানুষ আবার বিশেষজ্ঞের কাছে নিজেদের উচ্চ বা নিম্ন রক্তচাপ অথবা গ্যাসট্রিকের সমস্যা সমাধানের জন্য আসে।

কিন্তু বাস্তবে ঠিক কী ঘটে- প্রায়শই সাধারণ ডাক্তার এবং নার্সরা রুগির  জীবনযাত্রাজনিত অভ্যাসগুলোকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন করে না। তাদের উদ্দেশ্য থাকে সিগারেট বা মদ্যপানজনিত সমস্যার লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু এগুলো ব্যবহারের কারণ তারা খুঁজে দেখতে চায় না।

তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা- আসক্তির কারণে একজন মানুষের কি বিশেষজ্ঞের কাছে সাহায্যের জন্য যাওয়া উচিত, এক্ষেত্রে কি তারা বিজ্ঞানসম্মত হস্তক্ষেপ দাবি করতে পারে না। আসলে তাদের সমস্যা সঠিকভাবে নির্ধারণ করাও হয় না আবার সমস্যা সমাধানের জন্য যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। ডাক্তাররা শুধু রুগিকে তামাক বা অ্যালকোহল ব্যবহার বন্ধ করার পরামর্শ দেয়, কিন্তু কীভাবে বন্ধ করা সম্ভব সে বিষয়ে তাদের সাহায্য করে না।

এই পরিস্থিতিতে কার্যকরী চিকিৎসা বলতে বোঝায়- সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত  করা, নেশার দ্রব্যের প্রতি আসক্তি দূর করতে সাহায্য করা (এক্ষেত্রে মানুষকে বোঝানো জরুরি যে কেন নেশার বস্তুর ব্যবহার ছাড়তে হবে) এবং আসক্তি দূর  করার পথে যেসব বাধা আসে তার মোকাবিলা করতে সহায়তা করা (যেমন- কীভাবে ব্যবহারের পরিমাণ কমানো যায়, কীভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়, কীভাবে দূরে সরে থাকার লক্ষণের সমস্যা কাটানো যায় বা কীভাবে প্রিয়জনের অথবা সামাজিক চাপের মোকাবিলা করা যায়)। আসক্তিমুক্ত হওয়ার লক্ষণজনিত চিকিৎসাও এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চতুর্থ প্রতিবন্ধকতা- আসক্তির সমস্যা দূর করার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসালয় বা  লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে খুব কমই রয়েছে। পরিবর্তে অনেক পুর্নবাসন কেন্দ্র রয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটির মান যথাযথ। বাকিগুলোর অবস্থা যথাযথ নয়। কিছু আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই নিজেদের ভূমিকা পালন করে।

কীভাবে আমরা এসব বাধা দূর করতে বা শূন্যস্থান পূরণ করতে পারব?

সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হল-

১. জন-সচেতনতা গড়ে তোলা- মাদকাসক্তি যে একপ্রকার মস্তিষ্কজনিত অসুস্থতা, তা যে মানুষের নৈতিক সমস্যা বা অবক্ষয় নয়, সে সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।

২. সম্ভাব্য চিকিৎসা বা সুরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো- প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের ডাক্তার, নার্স প্রমুখ ব্যক্তি যাতে রুগির আসক্তিজনিত সমস্যা নির্ধারণ করতে পারে এবং কার্যকরী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। সেজন্য নিম্নলিখিত উপায়ে তাদের প্রশিক্ষিত করা দরকার-

  • নিয়ম করে মানুষকে অ্যালকোহল বা তামাক ব্যবহারের সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা করতে হবে। যদি মানুষ চিকিৎসার দ্বারস্থ না-ও হয় তাহলেও তাদের প্রশ্ন করা উচিত।

  • তাদের শারীরিক সমস্যার কথা জানতে হবে এবং আসক্তির কারণে তাদের শারীরিক সমস্যা বা আচরণগত অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে কিনা তা বুঝতে হবে।

  • সাধ্য মত রুগির চিকিৎসা করতে হবে বা প্রয়োজন হলে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি।

এসব কারণে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট বা পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্তরে ডাক্তার ও নার্সদের জন্য আসক্তিজনিত প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রম অর্ন্তভুক্ত করা একান্ত দরকার।

৩. লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা গড়ে তোলা- যথাযথ চিকিৎসা এবং পুর্নবাসন কেন্দ্র গড়ে তুলে উচ্চমানের ও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টাও প্রাধান্য পাবে, তা গড়ে তোলা দরকার। এর ফলে রুগিরা যেমন বুঝতে পারবে যে কোথায় গেলে তারা সঠিক সাহায্য পাবে, তেমন বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার আগেই তারা উপযুক্ত প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।

কিন্তু কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

যেসব মানুষ অ্যালকোহল বা তামাক সেবন করে তাদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। সেগুলো হল-

শ্রেণি ১- যারা মাঝে মাঝে বা কদাচিৎ নেশার দ্রব্য ব্যবহার করে।

শ্রেণি ২- যারা নিয়মিত ব্যবহার করে, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও মানসিক বা চিকিৎসাশাস্ত্রজনিত জটিলতা দেখা যায় না।

শ্রেনি ৩- আসক্তির চরম লক্ষণ দেখা দেওয়ার জন্য যাদের বিশেষজ্ঞের কাছে
যেতে হয়।

তৃতীয় শ্রেণির মানুষদের সাধারণত আসক্তি ছাড়াও অন্যান্য নানারকম সমস্যার জন্য বিশেষজ্ঞের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। সমস্যাগুলো হল- গ্যাসট্রোইনটেসটিনাল বিপর্যয়, হিংসা বা দুর্ঘটনা, লিভারের সমস্যা প্রভৃতি। এই পর্যায়ের চিকিৎসা সবার কাছে পৌঁছুতে পারে না। কারণ এর পিছনে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় হয়।

দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষরাই বেশি পরিমাণে নেশার দ্রব্য ব্যবহার করে থাকে। কারণ এক্ষেত্রে কোনও চিকিৎসাশাস্ত্রজনিত বা মানসিক জটিলতার জন্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য লাগে না। কিন্তু এই শ্রেণির মানুষরা সময়মতো চিকিৎসা করালে উপকার পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং-ও ফলদায়ক হয়।

একজন মানুষ যখন মাদক ব্যবহার শুরু করে তখন দশ থেকে পনেরো বছরের  মধ্যে তার আসক্তির প্রবণতা বিকাশ লাভ করে। আসক্তি চরম মাত্রায় পৌঁছনোর আগে (অর্থাৎ শ্রেণি ১ ও ২-য়ে থাকাকালীন) যদি কেউ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়  তাহলে চিকিৎসায় ভালো সাড়া মেলে এবং সেখানে কম অর্থ খরচ হয়। সেই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও মানুষ অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য নিমহ্যান্সের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার প্রতিমা মূর্থি এবং আরেক অধ্যাপক ডাক্তার প্রভাত চাঁদ-এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।   

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org