সারাহাহ, সোশ্যাল মিডিয়া এবং আত্মমর্যাদা: আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এদের প্রাসঙ্গিকতা কী

সারাহাহ, সোশ্যাল মিডিয়া এবং আত্মমর্যাদা: আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এদের প্রাসঙ্গিকতা কী

আমাদের অধিকাংশের মধ্যেই কৌতুহল জাগে যে অন্যরা আমাদের নিয়ে কী চিন্তাভাবনা করছে। অন্যদের মুখ থেকে নিজেদের প্রশংসা শুনে আমরা খুব তৃপ্তি পাই এবং এর ফলে আমাদের মধ্যে নিজের সম্পর্কে গ্রহণযোগ্যতার বোধ উপলব্ধি হয়। ঠিক একইভাবে যখন আমরা শুনি যে আমাদের করা কাজ অন্যরা সেভাবে পছন্দ করছে না বা অন্যান্যরা আমাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চাইছে না, তখন সেই ঘটনার মোকাবিলা করা আমাদের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। একটা কথা প্রায়ই বলা হয় যে, আমাদের অনেকের মনের মধ্যেই কৌতুহলের বোধ ভয়ের থেকে বেশি জোড়ালো হয়ে দেখা দেয়। এবং হয়তো এজন্যই গত কয়েক সপ্তাহে সারাহাহ-র জনপ্রিয়তা প্রবল সাড়া ফেলেছে।

কেন মানুষ সারাহাহ-র প্রতি এতটা আকৃষ্ট হয়েছে ও আমাদের মানসিক সাস্থ্যের উপর এই ঘটনার কী প্রভাব পড়তে পারে তা বোঝার জন্য আমরা কথা বলেছিলাম মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।

সারাহাহ কী?

এটা একটা অনলাইন মাধ্যম বা মঞ্চ যেখানে মানুষ তার মনের কথা খোলাখুলি বলতে পারে ও নিজের বৃত্তের মানুষজনের কাছ থেকে বেনামে নানারকম মতামত অথবা সাড়া পায়। গত কয়েক সপ্তাহে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী মানুষজন তাদের ফেসবুক, ট্যুইটার এবং ইন্সটাগ্রামে এই সারাহাহ-এর মাধ্যমে নিজেদের  মধ্যে বিভিন্ন লিংক বা যোগসূত্র আদানপ্রদান করেছে এবং পরিচিত মানুষের কাছ থেকে তারা সাড়াও খুঁজেছে। এসব মতামত বা সাড়াগুলোর মধ্যে বেশ কিছু বিষয় ছিল উষ্ণ ও গঠনমূলক। কিন্তু আবার কিছু ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের অনলাইন নির্যাতন এবং আক্রমণের মুখোমুখিও হতে হয়েছে।

কেন এই অনলাইন মাধ্যমে বেনামে নিজেদের মতামত দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে?

পারস্পরিক মত বিনিময়ের ধারণা খুবই লোভনীয় বিষয়। এর সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার কার্যকলাপের মিল রয়েছে, যেমন- কারোর পোস্ট করা ছবিতে লাইক করা বা কমেন্ট অর্থাৎ মতামত দেওয়ার মতো বিষয়; এগুলো আমাদের মধ্যে মূল্যায়নের ক্ষমতা বা বিচারশক্তির বোধ জাগাতে সাহায্য করে। কিন্তু আমরা অধিকাংশই একথা মানি না যে বেনামে কিছু কাজ করাটা কতটা মারাত্মক একটা বিষয় হিসেবে দেখা দিতে পারে। যদি মানুষ তার পরিচয় গোপন রেখে কিছু করতে চায় তখন সে বেনামে সেই কাজ করে। তাই সারাহাহ-র মতো একটা অনলাইন মাধ্যম কতটা ভালো বা খারাপ সেটা প্রশ্ন নয়। আসল প্রশ্ন হল ব্যবহারকারী হিসেবে একজন মানুষ নেতিবাচক মতামত বা সাড়া গ্রহণ করতে পারবে কিনা?

কীভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা সাড়া আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে?

মনোবিদ সোনালী গুপ্তা-র মতে প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একজনের সক্ষমতা  যাচাইয়ের মাপকাঠিতে পর্যবসিত হয়। তিনি মনে করেন ''কিছু মানুষ অত্যন্ত সচেতনভাবেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা সাড়া মেনে নিতে সক্ষম হয়। এটাকে তারা নিজেদের আচার-আচরণ বিচার করার সুযোগ এবং যদি তারা এসব প্রতিক্রিয়াগুলোকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে চায় তাহলে সেক্ষেত্রে নিজেদের কাছেই তারা দায়বদ্ধ থাকে। কিন্তু কিছু মানুষ থাকে যারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলোকে তত সহজে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। তাদের কাছে সেই বিষয়টা তখন অত্যন্ত নিরাশাজনক বা হতাশাজনক হয়ে ওঠে। এটা নির্ভর করে একজন মানুষকে কত বেশি প্রতিক্রিয়া শুনতে হচ্ছে তার উপর। বহু মানুষ মনে করে যে এই বিষয়টা তারা ভালোভাবেই সামলাতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষের পক্ষেই তা করা সম্ভব হয় না।''

মানুষের মস্তিষ্কের উপরেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জোড়ালো প্রভাব পড়ে। শিশু ও বয়ঃসন্ধি বিষয়ক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ভূষণ শুক্লা-র মতে ''একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রভাবের মোকাবিলায় মানুষের পাঁচটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু একথা ক'জনই বা মনে রাখতে পারে?''

একজন মানুষ কীভাবে নিজেকে বিচার করছে তার উপর মানুষের কোনও প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করার প্রভাব পড়ে। কিন্তু নিজেকে এই বিষয়ের সঙ্গে না জড়ালে ঘটনাটা অনেকটা নতুন কোনও প্রযুক্তির (অ্যাপ) মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা বা অন্যের আক্রমণের প্রত্যুত্তর হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সেখানে বেনামে প্রতিক্রিয়া জানানোকে একটা সহজ ঘটনা বলেই মনে হতে পারে। উপরন্তু, নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং ঘৃণ্য মন্তব্যের মধ্যে বড়সড় পার্থক্য রয়েছে। ''প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ চায় অন্য আরেকজন মানুষ যেন তার কাজকর্মের ক্ষেত্রে বদল ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষ নিজে থেকে কোনও উদ্যোগ নেয় না। অপরদিকে, কারোর উদ্দেশ্যে করা ঘৃণ্য মন্তব্য কখনোই গঠনমূলক হয় না এবং এটা সাধারণত একজন মানুষকে আক্রমণ করার জন্যই করা হয়। এই ধরনের মন্তব্যের মূলে থাকে মানুষের লিঙ্গবৈষম্য, জাতিভেদ, শ্রেণিভেদের ধারণা, জীবনযাত্রা প্রণালীর পছন্দ-অপছন্দ প্রভৃতি বিষয়।''- এমনই মনে করেন একজন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট পারাস শর্মা।

এর ফলে কারা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে?

একজন মানুষ যে আত্মমর্যাদাহীনতায় ভুগছে তার পক্ষে নেতিবাচক কোনও প্রতিক্রিয়া গ্রহণ সত্যিই দিশাহারা হয়ে যাওয়ার মতো একটা বিষয়। অন্যরা একজন মানুষকে কীভাবে বিচার করছে তা যদি সেই মানুষটার আত্মমর্যাদা বা আত্মবিশ্বাসের মাপকাঠি হয় তাহলে তার মনে জন্ম নেওয়া গভীর উদ্বেগের পিছনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া অনেকাংশেই দায়ী হয়।

অধীর, সামাজিকভাবে অস্থির বা কম-বেশি অবসাদে ভুগছে এমন মানুষের ক্ষেত্রে  নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এই ধরনের মানুষ মনে করে যে তাদের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানানোর অর্থ হল কেউ তাদেরকে ভালোবাসে না। আর এই মনোভাব অত্যন্ত মারাত্মক একটা বিষয়। অন্যদিকে মানুষ যদি অনবরত ভাবে যে অন্য আরেকজন মানুষ তার সম্পর্কে কী মন্তব্য করবে তাহলেই সে অধীর বা অস্থির হয়ে উঠবে।

কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট পারাস শর্মা বলেছেন, ''বাস্তব ঘটনা হল সারাহাহ হল অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার মতোই একটা মঞ্চ যার সাহায্যে মানুষ চায় ঘৃণা এবং নির্যাতন ছড়াতে। কিন্তু একমাত্র পার্থক্য হল সারাহাহ-র অন্য কারোর প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা থাকে না। কারণ এখানে বেনামে প্রতিক্রিয়া আদানপ্রদান হয়। এজন্য একজন পরিচর্যাকারীর কাছের মানুষ যদি এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তারা এখানে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। তাই তার ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আদপে এই মঞ্চে কে কী বলল, বা যার সম্পর্কে ঘৃণ্য মন্তব্য করা হল, সে  সেই মন্তব্যের যোগ্য কিনা, সেগুলো আদৌ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় না।''

যদি কেউ এই ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যে বিচলিত বোধ করে তাহলে সে তার বিশ্বাসভাজন মানুষের কাছে তার মনের কথা বলতে পারে। এছাড়া সাহায্যের জন্য নীচের হেল্পলাইনগুলোতেও যোগাযোগ করা যেতে পারে-

আইকল: 022-25521111/022-25563291 (সোমবার থেকে শনিবার, সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা) বা লিখুন এই ঠিকানায় icall@tiss.edu

স্নেহা ইন্ডিয়া: 044-24640050; 91-44-24640060 (৭দিন/২৪ঘন্টা) বা ইমেইল help@snehaindia.org

পরিবর্তন কাউন্সেলিং হেল্পলাইন: 080-65333323 (সোমবার থেকে শুক্রবার, বিকেল ৪টে থেকে রাত ১০টা) 

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org