আমার কাহিনী: আমি কী করে বুঝব যে আমি তৈরি?

আমার কাহিনী: আমি কী করে বুঝব যে আমি তৈরি?

যৌন হেনস্থার কারণে হওয়া মানসিক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা সবার সমান হয় না। ব্যক্তিবিশেষে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী এটা আলাদা হয়: অভিজ্ঞতার ধরন, তার স্থায়ীত্ব, আততায়ীর সাথে সম্পর্ক, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ - এর কোনও শেষ নেই।

যৌন নিপীড়ন একজন ব্যক্তির জন্যে চূড়ান্ত ক্ষতিকর। এর ফলে মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। নিজের অন্তরে কুরে কুরে খাওয়া লজ্জা, অপরাধবোধ, ক্ষোভ, আতঙ্ক আর অভিযোগে জর্জরিত হয়ে একসময় ব্যক্তি নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেন। এই জন্য যৌন নিপীড়িত ব্যক্তিরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মুখ বন্ধ করে থাকেন বা আইনি সাহায্য নিতে চান না। কাজেই “এতদিন ও চুপ করে ছিল কেন” ধরনের কথা সেই ব্যক্তির উপরে মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে দেয় কারণ তিনি নিজের নীরবতাকে নিজের ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন।

নিজের কাহিনি বলা

আমাদের কাহিনি সবাইকে শোনানোটা যেমন জরুরি, তেমনই নীরবতা আমাদের নিরাপদ বোধ করতেও সাহায্য করে। অত্যাচারের মুখে নিরাপত্তাই প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিৎ, আর তাছাড়া পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা তার সাথে মানিয়ে নেওয়ারই চেষ্টা করে থাকি। একে এক ধরনের শক্তিচক্র বলা যেতে পারে। রাত করে বন্ধুদের সাথে মদ খাওয়া যখন একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা দেয়, তখন আমরা সেই কাজটাই আবার করার চেষ্টা করি। এভাবেই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেখানে একটা সংস্কৃতির মূল পরিধিই হল লজ্জা, ভয় এবং দোষারোপ, সেখানে নীরবতা প্রয়োজন বৈকি। কারণ সেই শক্তিচক্রের জন্যই সেটি প্রয়োজন।

তাহলে আপনি কখন বুঝবেন যে আপনার কাহিনী শোনানোর জন্য আপনি প্রস্তুত? অধিকাংশ নিপীড়িত মহিলা যাদের সাথে আমি কাজ করেছি, সংঘবদ্ধ হয়ে আগে নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা নিজেদের মতন সাথীদের সাথে একত্র হয়ে একটা জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন যেটা তাঁদেরকে অন্যের সামনে নিজেকে দুর্বল হিসেবে প্রকাশ করতে, অকপটে নিজের মানসিকতা প্ৰকাশ করতে এবং সমর্থন পেতে দেবে। সাবধানতার সাথে তাঁরা নিজেদের কাহিনী বলার দিকে এগোন যা হয়ত খুবই স্বাভাবিক।

নিজের কাহিনী প্রকাশ করার আগে আপনি নিজেকে এই প্রশ্নগুলি করতে পারেন:

  • এই ব্যক্তি বা এই সংগঠন কীভাবে আমার কাহিনীতে প্রতিক্রিয়া দেবে?

  • আমি কি তাঁদের প্রতিক্রিয়ার জন্যে তৈরি?

  • আমার সমর্থনের জন্য কোন জিনিসগুলো সবার আগে দরকার?

এর উত্তরগুলো দিয়ে আপনি শুরু করুন। আমাদের ধারণা যে সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির সামনে নিজের যন্ত্রণার কথা বলতে যথেষ্ট সাহস লাগে যা কোনও মেডেল জেতার থেকে কোনও অংশে কম না। কিন্তু না! আপনি সাহসী কারণ আপনি সেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েও টিঁকে  আছেন। এই জয়ের স্বীকৃতি খুবই প্রয়োজন। নিজের যৌন যন্ত্রণার আখ্যান শোনানোর জন্যে ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দাম দিতে হয়, কাজেই একমাত্র আপনিই নির্ধারণ করতে পারেন যে আপনি তার জন্যে প্রস্তুত কিনা। কাউকে সেই অভিজ্ঞতা না জানালে, আপনার অভিজ্ঞতার গুরুত্ব কোনওভাবে কমে যাবেনা।

যৌন নিপীড়ন একজনের কর্মক্ষমতা কেড়ে নেয়। বিশেষ করে যখন সেটা নিয়ে মুখ খুলতে বলা হয় তখন সেই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে ভুক্তভোগীকে আবার যেতে হয়। ঘটনার পরবর্তী সময়ে আপনার মানসিক অবস্থার উপরেই নির্ভর করবে যে আপনি কাকে-কখন-কোথায়-কতটা নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলবেন।

ঘুরে  দাঁড়ানো

মানসিক আঘাত সামলে ওঠা কোনও সোজা কাজ নয়। এর জন্য মনঃসংযোগ প্রয়োজন। মানসিক আঘাতের সাথে মোকাবিলা করার কৌশল এবং দক্ষতা এই ক্ষেত্রে খুবই গুরত্বপূর্ণ। পরিচিত গণ্ডির মধ্যে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলে সেক্ষেত্রে সুবিধা হতে পারে। লোকে হয়ত তখন নানারকম প্রশ্ন করবে, কিন্তু সেই সমস্ত কৌতূহল মেটানোর দায় আপনার নেই। আপনি না বলতেই পারেন, অথবা পুরোটা না বলতে পারেন (কতটা বলবেন সেটা আপনার ইচ্ছার উপরে নির্ভরশীল), এবং নিজের জিদে অনড় থাকবেন।

নিজের গল্প ভোলার সময় ভুক্তভোগীকে সেই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আবার যেতে হয়। এর ফলে বিভিন্ন মানসিক উদ্দীপনা যেমন খারাপ স্মৃতি, দুঃখের আবেগ দেখা দিতে পারে বা শারীরিক সমস্যা যেমন ব্যাথা বা হাত-পা অবশ হয়ে যেতে পারে। তাই যদি কোনও সময় মনে হয় যে আপনি আর বলতে চান না, তাহলে আপনি চুপ করে যেতে পারেন।

যতটা সম্ভব নিজেকে নিয়ে সচেতন থাকুন। আপনার শ্রোতারাও হয়ত শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে পারেন, এতএব একটা নির্দিষ্ট গন্ডি বজায় রাখুন। তাঁদের প্রতিক্রিয়া তাঁদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত, কাজেই তৎক্ষণাৎ তাঁদেরকে সামলানোর ভার আপনাকেই নিতে হবে। যদি আপনি আপনার কাহিনী একটি বৃহত্তর গন্ডির সাথে ভাগ করেন, যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায়, তাহলে আপনার অফলাইনেও সমর্থন প্রয়োজন। আপনার কাহিনী শুনে একদিকে যেমন প্রচুর লোক সাহস ও সমর্থন পাবেন, অপরদিকে আপনি ট্রোলিং, সাইবারবুলিং, এবং অপরিচিত লোকদের প্রশ্নবানের শিকারও হবেন। এই জিনিসগুলির জন্যে আপনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বোধ করতে পারেন বলেই আপনার অফলাইনে, রক্তমাংসের পরিচিত লোকজনদের থেকে সমর্থন প্রয়োজন।

নিজের মত করে মোকাবিলা করার কৌশল তৈরি করুন

পাশাপাশি, নিজের মত করে মোকাবিলা করার কৌশল তৈরি করতে পারলে ভাল। সেটা ব্যায়াম হবে? খেলাধুলো হবে? যোগব্যায়াম হবে? না ধ্যান হবে? এমন কি আছে যেটার সাহায্যে আপনি শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন? দুটোকে একসাথে?

একটানা মনঃসংযোগ অভ্যাস করলে নিজের শরীরকে অনেক তাড়াতাড়ি চেনা যায়। এর ফলে আপনি মানসিক চাপকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে সক্ষম হবেন মানসিক আঘাতের তীব্রতাকে কমাতে পারবেন।যদি আপনি থেরাপি করান (যেটা অবশ্যই করানো উচিৎ) তাহলে মানসিক চাপ মোকাবিলা করার কৌশল তৈরি থাকেলে নিজের কাহিনী ভাগ করে নিতে সুবিধা হয়। মানসিক আঘাতকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিজের কাহিনী বলার গুরুত্ব উপলব্ধি করলে মানসিক সুস্থতা লাভ করা অনেক সহজ হয়।

যৌন অত্যাচার ও যৌন হয়রানি এমন দু’টো শব্দ যা আমরা গত কয়েক সপ্তাহে প্রচুর শুনেছি। আমরা সীমা লঙ্ঘনের মাপকাঠি নিয়ে আলোচনা করেছি, সকলের অভিজ্ঞতা শুনেছি, আততায়ীদের চিহ্নিত করেছি, সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করেছি এবং সবাইকে একসাথে সকলের পাশে দাঁড় করিয়েছি। কোথাও জিতেছি, কোথাও হেরেছি, কিন্তু অনেক কিছু শিখেছি। বরফের মধ্যে গরম জামা ছাড়া এক দিন কাটালেই আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে। সেরকমই মানসিক সহায়তা এবং সুরক্ষার অভাব আপনার মানসিক আঘাতকে চরম পর্যায় নিয়ে যেতে পারে। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও শারীরিক স্বাস্থ্য দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এবং সুস্থতা এক সাধারণ কাজ নয়, এটি একটি যাত্রা, যাতে সাহায্য আমাদের সবারই লাগে।

রুচিতা চন্দ্রশেখর শিকাগোতে অবস্থিত একজন মনোবিদ, যিনি যৌন হেনস্থার ভুক্তভোগীদের (এলজিবিটিকিউআই কমিউনিটি- সদস্যদেরও) মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করেন উনি ট্রমা ইনফর্মড থেরাপি সম্বন্ধে দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কুন্ঠা কাটিয়ে তুলতে বিশেষ আগ্রহী  এছাড়াও উনি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চনা নিপীড়ন নিয়েও কাজ করেছেন

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org