পুরুষদের উপর হিংসার ঘটনার কথা খুব কম শোনা যায় বা সেই খবর জানাজানি হয় না। এই বিষয়টি প্রায়শই লুকিয়ে রাখা হয় এবং পুরুষরা এমন ঘটনার কথা চেপে যায়। সাধারণভাবে এমন ঘটনার কথা জানাজানি হলেও তাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় না। এই বিষয়টিকে সমস্যা মনে না করে, একে ঘিরে কলঙ্কের বোধ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এতটাই বেশি যে আলাপ-আলোচনা করাই নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়।
এবিষয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেব কী বলছে?
সারা পৃথিবীর সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেব অনুযায়ী দেখা গিয়েছে যে ছোটবেলায় মেয়েদের তুলনায় ছেলেরাই বেশি মারধর খায় এবং তারপর যত বয়স বাড়তে লাগে তত ছেলেরা আক্রমণাত্মক বা হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। ছেলেদের শুধুমাত্র যে হিংসাত্মক কাজকর্মের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা নয়, প্রায়শই তারা হিংসার শিকারও হয়। ভারতে ২০০৭ সালে নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের (এমডব্লিউসিডি) দ্বারা করা এক সমীক্ষা অনুযায়ী-
২০১৫-১৬ সালে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে বা এনএফএইচএস-৪)-র সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ''চিকিৎসা সম্পর্কীয় কারণের জন্য নয় (দুর্ঘটনা, হিংসা, বিষপ্রয়োগ, হত্যা বা আত্মহত্যা) এমন মৃত্যুর হার মহিলাদের তুলনায় (৮ শতাংশ) পুরুষদের মধ্যেই বেশি ঘটেছে (১২ শতাংশ)। এই ঘটনা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি পুরুষ ও মহিলাদের জীবনে বেশি ঘটে, আর যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তার অর্ধেকেরও বেশি ঘটনা ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সি পুরুষদের জীবনেই ঘটে।'' হিংসার সংখ্যা এবং কারণ গ্রাম ও শহরের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়।
পুরুষদের উপর এহেন হিংসার সতর্কবার্তা থাকা সত্ত্বেও এটাই সত্যি যে তারা কখনোই এই হিংসার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় না। কারণ তাদের মনে ভয় থাকে যে এজন্য তাদের গায়ে তকমা লেগে যাবে, তারা প্রত্যাখ্যাত হবে, তারা অন্যদের কাছে মজার পাত্র হয়ে উঠবে, অন্যদের দ্বারা বুলি হবে বা নিজের কাজ হারিয়ে ফেলবে। এভাবে হিংসার ঘটনা লুকিয়ে রাখার জন্য সমস্যা আরও বেড়ে যায়।
হিংসার সংস্পর্শে আসা
আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শাস্তি দেওয়া বা মারধর করার রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। আর এর ফলেই ছেলেদের মনে বিশ্বাস জন্মায় যে পুরুষ মাত্রই হিংসাত্মক বা আক্রমণাত্মক হবে। বয়স বাড়ার সাথে-সাথে তাদের মধ্যে হিংসা এবং অন্যদের ভয় দেখানোর প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে যা পূর্ণবয়সে পৌঁছে উগ্র রূপ ধারণ করে। এর অর্থ হল যে প্রাপ্তবয়সে তাদের আচরণ আক্রমণাত্মক হতে পারে, তারা হিংসার মতো অপরাধ ঘটাতে পারে বা নিজেরাই কোনও হিংসা বা আক্রমনের শিকার হতে পারে।
এনফল্ড ইন্ডিয়া নামক একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ডঃ শোইবা সালদানাহ লক্ষ্য করেছেন যে একজন পুরুষের দ্বারা ঘটানো হিংসামূলক আচরণের সুত্রপাত ঘটে শৈশব থেকে বাবাদের সব বিষয়ে নির্দেশ দেওয়ার কারণে - ছেলেকে শাসন করা, কী করবে আর কী করবে না, কী বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবে, কোন ধরণের কাজ করবে – যা ছেলেদের মধ্যে হতাশা এবং রাগকে বাড়িয়ে তোলে।
যে পুরুষদের সঙ্গীর মধ্যে রাগ বা হিংসাত্মক আচরণের সমস্যা থাকে তাদের পারিবারিক হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে তারা এই ঘটনা বাইরে কারোর কাছে বলতেই চায় না কারণ তাদের মনে ভয় থাকে যে তারা অন্যের উপহাসের পাত্র হয়ে উঠবে।
কীভাবে এই ঘটনা পুরুষদের উপর প্রভাব বিস্তার করে?
যে ছেলেটির জীবনে শৈশবে কোনও না কোনও হিংসার প্রকাশ ঘটেছে তার প্রভাব ছেলেটির জীবনে পরবর্তীকালে কীভাবে পড়তে পারে? যদি কোনও পুরুষ ছোটবেলায় হিংসার শিকার হয়ে থাকে তাহলে বড় হয়ে নিজে এমন আচরণ করার প্রবণতা কি বেড়ে যায়?
এই বিষয়টি আরও একটু ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে।
একটি বাচ্চা ছেলে যদি শারীরিক নির্যাতন (যেমন- বাবা বা পরিবারের অন্য কারোর দ্বারা মারধর খাওয়া) এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে তার মধ্যে নীচের অবস্থাগুলি দেখা দিতে পারে-
একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির জীবনে পারিবারিক হিংসার প্রভাব (যেমন- সঙ্গীর দ্বারা আঘাত পাওয়া) প্রায়শই পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বা বিশ্বাসকে ভেঙে দেয় যা পুরুষের আত্মম্ভরিতা বা অহং বোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাকে অসহায় বা হতাশ করে তোলে। যদি এমন হয় যে কোনও পুরুষের আচরণে হিংসার প্রকাশ নেই বা সে আগে জীবনে কখনও অন্যের দ্বারা মারধরও খায়নি, কিন্তু পরে তার সঙ্গীর কাছ থেকে যদি তার উপর কোনও আক্রমণ হয়, যার মধ্যে ক্রোধ বা আচরণের সমস্যা রয়েছে তাহলে ওই পুরুষের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে-
পুরুষরা কেন তাদের উপর হওয়া হিংসার কথা অন্যকে বলতে পারে না?
নীহার (নাম পরিবর্তিত) নামক ৩০ বছর বয়সি একটি ছেলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। তার কথায় ''যদি পুরুষরা তাদের উপর হওয়া হিংসার কথা অন্যকে বলে তাহলে তাদের নিজেদেরকে দুর্বল বলে মনে হয়''।
এক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হল পুরুষরা তাদের উপর হওয়া হিংসার কথা অন্যকে বলতে দ্বিধাবোধ করে এবং শেষ পর্যন্ত কাউকে বলতেও সক্ষম হয় না। ডঃ শইব্যা সালদান্হা বলেছেন যে হিংসা ঘটানো বা অন্যকে মারধর করাটাই একজন পুরুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। তাই পুরুষরা তাদের উপর হওয়া হিংসার কথা অন্যকে বলতে ভয় পায় পাছে তারা অন্যদের কাছে হাসিঠাট্টার পাত্র হয়ে উঠবে বলে। আর এই কারণেই তারা পুলিশ বা আদালতের দ্বারস্থও হয় না। আসলে পিতৃতান্ত্রিক ধারণায় কোনও পুরুষের উপর আক্রমণ হওয়ার ঘটনা অবিশ্বাস্য বলে
গণ্য হয়।
এক্ষেত্রে কী সাহায্য করা যেতে পারে?
হেল্পলাইন
যদি আপনি হিংসার শিকার হন তাহলে নীচের যেকোনও একটি হেল্পলাইনের সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করতে পারেন-
প্রবন্ধটি লেখার জন্য এনফল্ড-এর প্রতিষ্ঠাতা ডঃ শোইবা সালদানাহর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।