পরিচর্যাকারীদেরও যত্নের প্রয়োজন রয়েছে
আমাদের চারপাশে থাকা অধিকাংশ পরিচর্যাকারীই প্রথাসিদ্ধ নয়। পরিস্থিতির চাপে পড়ে তাদের পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অসুস্থ মানুষের যত্নের বিষয়টাই একজন পরিচর্যাকারীর কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে নিজের সুরক্ষার চিন্তা একজন পরিচর্যাকারীর মনে সেভাবে বড় হয়ে দেখা দেয় না। এমনকী, অনেকসময়ে নিজেদের দেখভাল করার বিষয়টা সামনে এলে পরিচর্যাকারীদের মনে একপ্রকার অপরাধ বোধও জেগে ওঠে।
পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন পরিচর্যাকারীর জীবনে যে মানসিক চাপের জন্ম হয় তা ইতিমধ্যেই আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে বিরামহীনভাবে সর্বক্ষণ পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত থাকার সময়ে একজন পরিচর্যাকারী যে কোনওরকম পারিপার্শ্বিক অতিরিক্ত সাহায্য পায় না, সেই বিষয়টাও গবেষণার মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রকাশ পেয়েছে। যদিও পারিপার্শ্বিক সাহায্যের অভাবের জন্যই পরিচর্যাকারীরা নিজেদের প্রতি যত্ন নিতে সক্ষম হয় না এবং তাদের মধ্যে আত্মতুষ্টিরও জন্ম হয় না।
নিজের প্রতি যথাযথ যত্ন নেওয়ার দশটি বৈশিষ্ট্য হল-
১. দৈনন্দিন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা - এর ফলে শরীরে ও মনে বার্তা পৌঁছয় যে তাদেরও যত্নের প্রয়োজন রয়েছে।
২. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং সময় ধরে যথাযথ খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা - এর সাহায্যে লাগাতার ক্লান্তি ও অপুষ্টির সমস্যা এড়ানো সম্ভবপর হয়।
৩. পর্যাপ্ত জল পান করা - এর মূল উদ্দেশ্য হল শরীরকে শুষ্ক হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা।
৪. শরীরচর্চা করা - যদি পরিচর্যাকারীরা দিনে দশ মিনিট অবসর পায় তাহলে হাঁটাহাঁটি করা তাদের পক্ষে খুবই জরুরি। কারণ এর ফলে তাদের মধ্যে প্রশান্তি ভাব জেগে ওঠা ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা সহজসাধ্য হয়। যোগচর্চাও এক্ষেত্রে ভালো ফল দেয়। যদি রুগিকে ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে শরীরচর্চা করা সম্ভব না হয় তাহলে বাড়িতেই শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত ব্যায়াম এবং ধ্যান করা যেতে পারে। এর সাহায্যে পরিচর্যার মতো দায়িত্বের বোঝা কিছুটা হালকা বলে মনে হতে পারে।
৫. নিজের সামাজিক বৃত্তের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রাখা - যোগাযোগ যদি অল্প সময়ের জন্য হয় তাহলেও কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু যোগাযোগ বজায় রাখা একান্ত জরুরি। বাইরের জগতের খবরাখবর নিজের ঘর ও সামাজিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করতে পারে।
৬. পারস্পরিক কথোপকথন - যদি মানুষজন একজন পরিচর্যাকারীর সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে কিছু বুঝতে না পারে তাহলে তারা কখনোই পরিচর্যাকারীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। কিন্তু যদি তারা বিষয়টা বুঝতে পারে তাহলে তারা পরিচর্যাকারীদের সহায়তার জন্য নিজেদের হাত বাড়াতে পারে। আর একারণেই প্রয়োজন পারস্পরিক কথপোকথন।
৭. পরিচর্যাকারীদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ গড়ে তোলা দরকার - এর সাহায্যে নিজেদের মনের অনুভূতি আদান-প্রদান এবং চিন্তাভাবনা দূর করা সম্ভব হয়।
৮. অনুভূতিগত সহায়তা - একজন পরিচর্যাকারীর জানা প্রয়োজন যে যদি তার মনে কোনওরকম অবসাদ বা হতাশা অথবা বেপরোয়া বোধ জন্মায় তাহলে তার উচিত অবিলম্বে একজন ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সেই বিষয়ে আলোচনা করা। এবং সেই সঙ্গে এটাও জেনে রাখা ভালো যে সাহায্য চাওয়া কোনও দুর্বলতার লক্ষণ নয়।
৯. পরিবেশের বদল বা পরিবর্তন দরকার - পরিচর্যাকারী এবং অসুস্থ মানুষ- দু'জনেরই দরকার মাঝে মাঝে কাছে-দূরে বেড়াতে যাওয়া। যদি ঘণ্টাখানেকের অবসরও পাওয়া যায় তাহলে পরিচর্যাকারীর উচিত তাদের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করা, হাঁটতে যাওয়া বা ভিন্ন পরিবেশে যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ নিজের মতো সময় কাটানো।
১০. পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন - দিনের যাবতীয় ক্লান্তি কাটানোর জন্য বিকেল, সন্ধে বা রাত হল মোক্ষম সময়। কিন্তু বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকার ফলে মানুষের মধ্যে লাগাতার ক্লান্তি জন্মায়। বিশেষ করে যেসব পরিচর্যাকারীরা অপরাধ বোধে ভোগে তাদের জানা দরকার যে নিজের যত্ন নেওয়া কোনও অপরাধ নয়। বরং অন্যকে সাহায্য করতে গেলে নিজেকে সুস্থ রাখাটা একান্ত জরুরি। এর ফলে তারা যেমন অন্যকে ভালো রাখতে সক্ষম হয়, তেমন নিজেরও উপকার হয়। তাই পরিচর্যাকারীরা যদি দীর্ঘমেয়াদিভাবে পরিচর্যার কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে এবং নিজেদের শক্তিক্ষয় রোধ করতে চায় তাহলে তাদের উচিত সবার আগে নিজেদের যত্ন করা এবং সুস্থ থাকা।
প্রবন্ধটি লিখেছেন কেয়ারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্যনির্বাহী ডিরেক্টর ডাক্তার অনিল পাটিল এবং সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক কর্মী রুথ পাটিল। এই সংস্থাটি পারিবারিক স্তরে অবৈতনিক পরিচর্যাকারীদের সমস্যা নিয়ে কাজ করে। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি নথিবদ্ধ হয় ব্রিটেনে। উন্নয়নশীল দেশের পরিচর্যাকারীদের স্বার্থ দেখাই এই সংস্থার প্রধান কাজ। আরও তথ্য জানার জন্য আপনি Carers Worldwide লগ অন করতে পারেন। তাছাড়া এই ঠিকানায় যোগাযোগ করা যাবে- columns@whiteswanfoundation.org