ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীর পরিচর্যাকারীদের প্রতি যত্নশীলতা
আগের প্রবন্ধে আমি সেই সব পরিচর্যাকারীদের নানারকম সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছিলাম যারা প্রতিনিয়ত অসুস্থ মানুষজনের সেবা-শুশ্রূষা করে। এই প্রবন্ধে আমি একটি নির্দিষ্ট অসুখ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত মানুষের পরিচর্যাকারীদের বিষয়ে আলোচনা করব।
ডিমেনশিয়া বা তার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা সমস্যা একটা পরিবারের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চরম প্রভাব ফেলে। এর ফলে শুধু যে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত মানুষটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা নয়। বরং একটা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এই সমস্যার দ্বারা ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সমস্যা তখনই জোরালো হয়ে ওঠে যখন একজন রুগির দেখাশোনার ভার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপরে এসে পড়ে। আর আমাদের দেশে এই ছবিটাই বারবার চোখে পড়ে। চলমান জগতে এর সঙ্গে যে নতুন সমস্যাগুলো একটা পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় সেগুলো হল- অর্থনৈতিক, মানসিক এবং শারীরিক।
ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতো আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এশিয়া মহাদেশে ডিমেনশিয়ার মতো অসুখের প্রকোপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রুগির দেখভালকারী পরিচর্যাকারীদের সমস্যার বোঝা। এসব পরিচর্যাকারীরা মূলত রুগির পরিবারেরই সদস্য হয়ে থাকেন। সমস্যার মাত্রা প্রতিদিন কমার চাইতে এমনভাবে বেড়ে চলেছে যার ফলে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত মানুষের দেখভালোকারী হিসেবে যে সব পরিচর্যাকারীরা তাদের দায়িত্ব পালন করে, তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
ভারতে জনসংখ্যার এক বড় অংশ ডিমেনশিয়ার শিকার হওয়া সত্ত্বেও,(সম্প্রতি এই সংখ্যাটা ৩.৭ মিলিয়নের কাছাকাছি এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে ২০৩০-এ এই সংখ্যাটা ৭ মিলিয়নের চেয়েও বেশি হবে) এই সমস্যাকে ঘিরে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার কারণ এখনও অজানাই রয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একটা পরিবারের উপর অর্থনৈতিক সাহায্য যেমন থাকে না তেমন খুব সামান্য পরিমাণে থাকে মানসিকভাবে সহায়তা। অনেক ক্ষেত্রে পরিচর্যাকারীরা নিজেরাই নিজেদের যত্ন নিতে অবহেলা করে এবং প্রায়শই পরিস্থিতির চাপে পড়ে তারা জোর করে নিজেদের দেখভাল করা ছেড়ে দেয়।
পরিচর্যাকারীদের প্রতি মানসিক সাহায্যের অভাবের ফলাফলও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। পরিচর্যাকারীরা শুধু যে তাদের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত কাছের মানুষের দুর্দশার সঙ্গেই মোকাবিলা করে তা নয়, সেই সঙ্গে তাদের উপর অর্থনৈতিক এবং মানসিক চাপের বোঝাও থাকে পাহাড়প্রমাণ। এর ফলে একজন পরিচর্যাকারীর মধ্যে অবসাদ, উদ্বেগ এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার জন্ম হয়।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে একটা পরিবারের অনেক সদস্যই একজন অসুস্থ মানুষের দেখাশোনা করতে পারে এবং পরিবারের বয়স্করা অনেকক্ষেত্রেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে ও পরিবারে তাদের একটা ইতিবাচক ভূমিকাও থাকে। তাই অসুস্থ মানুষের দেখাশোনা করার জন্য একটা পরিবারের উপর যাতে কোনও নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেজন্য আমাদের প্রয়োজন পরিবারের পরিচর্যাকারীকে সাহায্য করা এবং তাদের ভূমিকাকে যথাযথ সম্মান জানানো।
আপনারা যারা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত নিজেদের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত রয়েছেন আমি তাঁদের ও তাঁদের দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে কয়েকটি পরামর্শ দিতে ইচ্ছুক। যেহেতু অসুস্থ কাছের মানুষের দেখভালকারী হিসেবে একজন পরিচর্যাকারীর ভালো-মন্দের বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে সেহেতু তার সুস্থতা ও ভালো থাকার ব্যাপারে সচেতনতা জাগানোও একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। যদি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত একজন রুগির পরিচর্যাকারী নিজের সমস্যাগুলোকে দ্রুত চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সচেষ্ট না হয় তাহলে তা সেই পরিচর্যাকারীর শরীরে ও মনে মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলতে পারে।
এখানে আমি এমন কতগুলো বাস্তব পরামর্শ এবং কৌশলের কথা বলব যা একজন পরিচর্যাকারীর নিজের ও তার কাছের মানুষের উপকারের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। সেগুলো হল-
নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া- যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম খাবার খাওয়া, নিজেকে সচল রাখা ও পর্যাপ্ত ঘুমানো। এগুলো না মেনে চললে পরিচর্যাকারীরা শারীরিকভাবে এতটাই পরিশ্রান্ত হয়ে উঠবে যে তার ফলে তাদের উপর চাপের
সৃষ্টি হবে।
নিজের অনুভূতি বা আবেগকে চিহ্নিত করা- শারীরিক সুস্থতার মতো মানসিক বা অনুভূতিগত সুস্থতাও একান্ত জরুরি। পরিচর্যাকারী হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই একজনের মধ্যে বিষণ্ণতা, চাপ, রাগ, হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, অস্থিরতা এবং অপরাধ বোধ জেগে উঠতে পারে। এমন কিছু অনুভূতি রয়েছে যা সবসময়ে বাইরে প্রকাশও করা যায় না। এই ধরনের অনুভূতি বা বোধগুলোকে চিহ্নিত করে, সেগুলো দূর করার জন্য পরিবারের সদস্য, অন্যান্য পরিচর্যাকারী বা ডাক্তারের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা প্রয়োজন।
কাজের ফাঁকে অবসর নেওয়া জরুরি- একজন পরিচর্যাকারীর সর্বাঙ্গীন সুস্থতার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ডিমেনশিয়ার রুগিকে দেখভাল করার কাজটা বড়ই ক্লান্তকর। তাই ক্লান্তি কাটিয়ে নতুন করে কাজে শক্তি পাওয়ার জন্য দরকার একটু বিশ্রাম, আরাম।
অর্থনৈতিক চাপের মোকাবিলা করা- পরিচর্যার দায়িত্বপালনের জন্য একজন পরিচর্যাকারীর কাছে অর্থনৈতিক চিন্তার বিষয়টা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এবং এর ফলে ভয়াবহ মানসিক চাপের জন্ম হয়। যদি পরিচর্যার কাজ করতে গিয়ে কোনও পরিচর্যাকারী অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে তাহলে কোনওরকম দ্বিধা-সংকোচ না করে পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবের কাছে সাহায্যের জন্য যেতে হবে।
সব শেষে একটা কথাই মনে রাখা জরুরি যে পরিচর্যাকারী হিসেবে একজন মানুষ যে দায়িত্বপালন করছে তা সবসময়েই সেরা ও শ্রেষ্ঠ।
আশা করা যায় যে উপরের দেওয়া বাস্তবসম্মত পরামর্শগুলো একজন পরিচর্যাকারীকে নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া এবং নিজের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সঠিক দিশা দেখাবে। সেই সঙ্গে পরিচর্যার কাজ আরও সুষ্ঠু ও কার্যকরী করে তোলার জন্য এই পরামর্শগুলোকে নতুন কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ডাক্তার অনিল পাটিল কেয়ারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা এবং এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর। এই প্রতিষ্ঠানটি একটা পরিবারের বেতনহীন পরিচর্যাকারীদের নানারকম সমস্যা নিয়ে কাজ করে। ২০১২ সালে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে এবং নথিবদ্ধ হয়। উন্নয়নশীল দেশের পরিচর্যাকারীদের নিয়েই মূলত এরা কাজ করে থাকে। এই প্রবন্ধের সহ-লেখক রুথ পাটিল কেরার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের একজন স্বেচ্ছাসেবি কর্মী। এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিশদে জানতে লগ-ইন করুন Carers Worldwide – এ। লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ঠিকানা হল- columns@whiteswanfoundation.org