শিশু পরিচর্যাকারী: অদৃশ্য এবং অসমর্থিত
ভারতে এমন অনেক শিশু পরিচর্যাকারী রয়েছে যাদের ভূমিকা আমরা অধিকাংশ মানুষই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি না। এমনকী, তারা বন্ধ দরজার ওপারেই প্রতিনিয়ত নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলে। একটা বাচ্চার অভিভাবকরা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তাদের দেখভালের ভার বাচ্চাটার উপরেই এসে পড়ে। তখন সেই বাচ্চাটার দিকে কেউই নজর দেয় না। এসব বাচ্চারা তাদের ছোট্ট কাঁধে অবিশ্বাস্য পরিমাণে দায়িত্ব বহন করে আর রাতারাতি বড় হয়ে যায়। পরিচর্যার কাজ শুধু যে মানসিক দিক থেকেই কষ্টসাধ্য তা নয়, সেই সঙ্গে বাচ্চাদের শরীরে, সামাজিক জীবনযাপনে ও তাদের লেখাপড়ার উপরও এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে।
শিশু পরিচর্যাকারীদের জীবনটা খুব কঠোর ও কঠিন
ভয়াবহ দুর্ঘটনায় একটা বাচ্চা মেয়ে প্রিয়ার বাবা যখন শারীরিকভাবে অসাড় হয়ে পড়েছিলেন তখন প্রিয়ার দরকার ছিল অন্যান্যদের সাহায্য ও সহযোগিতা। প্রিয়ার মা এক রাতের মধ্যেই তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং বাবার দেখভাল করার জন্য মেয়ে-ই ছিল একমাত্র সহায়সম্বল। প্রিয়া তার বাবার পরিচর্যাকারী হিসেবে রান্নাবান্না, জামাকাপড় পরিষ্কার, ঘরদোর মোছামুছি সবই একা হাতে করত। প্রিয়ার তখন কোনও রোজগারই ছিল না। ফলে সে ক্রমশ দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। সামাজিক জীবন বলতে কিছুই ছিল না। এমনকী তার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রিয়ার মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতা বেড়ে যাচ্ছিল। সৌভাগ্যবশত একটা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (এনজিও) প্রিয়ায় অবস্থার কথা জানতে পারে। সেই সংস্থা তখন প্রিয়া এবং তার বাবাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সেই অবস্থায় প্রিয়া আবার পড়াশোনা শুরু করেছিল। স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে সে তার বাবার দেখভাল করত। ওই স্বেচ্ছাসেবি সংস্থার দেওয়া অর্থ সাহায্যেই প্রিয়াদের বাড়ির পিছনে একটা শৌচাগার তৈরি করা হয়েছিল। সংস্থার মহিলা সদস্যরা নিয়মিত প্রিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাকে মানসিকভাবে শক্তি যোগাত এবং সুপরামর্শ দিতেন। প্রিয়ার জীবনটা কোনওদিক থেকেই খুব সহজ না থাকলেও এখন তার মনে ভবিষ্যতে ভালো থাকার আশা জেগেছে।
প্রিয়ার মতো বাচ্চাদের ছোট্ট কাঁধে এই ধরনের কঠিন দায়িত্ব পালন করার বিষয়টা সত্যিই অকল্পনীয়। পরিচর্যা করতে গিয়ে বাচ্চাদের ঘর-গৃহস্থালীর সব দায়িত্ব পালন করতে হয়, যেমন- জামাকাপড় পরিষ্কার করা, রান্নাবান্না করা, রুগির সেবা করা, অর্থাৎ অসুস্থ মানুষকে খাওয়ানো, পরানো, স্নান করানোর মতো কঠিন কাজ বাচ্চাদের করতে হয়। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় অসুস্থ মানুষকে মানসিক দিক থেকে চাঙ্গা রাখা, সংসার চালানো ও ভাইবোনের দেখাশোনা করার জন্য অর্থনৈতিক চাপ।
শিশু পরিচর্যাকারীদের জন্য প্রয়োজন যত্ন ও সহযোগিতা
ইংল্যান্ডের চিলড্রেন সোসাইটির করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে অল্পবয়সি পরিচর্যাকারী অর্থাৎ যাদের বয়স ১৭ বা তার নীচে তাদের দেড়গুণ বেশি বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন তখনই পড়ে যখন তারা তাদের প্রিয়জনদের দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার সময়ে তাদের দেখভাল করে। এই বাচ্চারা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলে, সামাজিক আদানপ্রদান থেকে বঞ্চিত হয়ে বিচ্ছিন্ন, একা ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে এমন যোগাযোগের দক্ষতার দুর্বলতা দেখা দেয় যার ফলে পূর্ণবয়সে পৌঁছিয়েও তাদের এই সমস্যা জটিল আকার নেয়। স্কুলের শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা ক্রমশ পিছিয়ে যায় অথবা বেপরোয়াভাবে স্কুলের পড়াশোনা সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়। রুগির পরিচর্যা করতে গিয়ে বাচ্চারা ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে প্রিয়ার মতো পরিস্থিতি হলে বাচ্চাদের জীবনে বেঁচে থাকাটাই কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
এসব কারণে আমাদের উচিত শিশু পরিচর্যাকারীদের সাহায্য করা। আর এজন্য শুরুতেই দরকার আমাদের চারপাশে থাকা সেই সব কমবয়সি পরিচর্যাকারীকে খুঁজে বের করা যারা পর্দার আড়ালে থেকে একাকিত্বকে মানিয়ে নিয়ে চলে। একবার যদি আমরা পরিস্থিতিকে বুঝতে পারি তাহলে নানা উপায়ে শিশু পরিচর্যাকারীদের সাহায্য করতে পারব। রুগির পরিবারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে সেই পরিবার থেকে বিকল্প এমন পরিচর্যাকারীদের সন্ধান করা জরুরি যারা বাচ্চাদের কাঁধে থাকা গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিতে পারে। স্কুলের শিক্ষকদেরও এই পরিস্থিতিতে শিশু পরিচর্যাকারীদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া জরুরি এবং তারা যাতে আবার স্কুল বা কলেজে যোগ দেয় তার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা দরকার। বাচ্চাদের সামাজিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসাটাও এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্য সব শিশু পরিচর্যাকারীকেই একসঙ্গে উদ্যোগী হতে হবে। এই কাজ করতে গিয়ে শিশু পরিচর্যাকারীরা যে একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করবে বা আনন্দ ভাগ করে নেবে তাই নয়, তারা এ-ও অনুভব করতে শুরু করবে যে সমাজে তারা একা নয়। এভাবে শিশুদের মধ্যে একটা সামাজিক বন্ধন গড়ে উঠবে। আমাদের সমবেত চেষ্টাই শিশুদের স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সাহায্য করতে পারে এবং তাদের জীবনে নতুন করে আশার আলো জ্বালাতে পারে। প্রিয়া তাই এখন একথাই বলে যে জীবন এখনও তার কাছে যথেষ্ঠ কঠিন। কিন্তু সে আবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে এবং এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে।
ডাক্তার অনিল পাটিল কেয়ারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা এবং এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর। এই প্রতিষ্ঠানটি একটা পরিবারের বেতনহীন পরিচর্যাকারীদের নানারকম সমস্যা নিয়ে কাজ করে। ২০১২ সালে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে এবং নথিবদ্ধ হয়। উন্নয়নশীল দেশের পরিচর্যাকারীদের নিয়েই মূলত এরা কাজ করে থাকে। এই প্রবন্ধের সহ-লেখক রুথ পাটিল কেরার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের একজন স্বেচ্ছাসেবি কর্মী। এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিশদে জানতে লগ-ইন করুন Carers Worldwide – এ। লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ঠিকানা হল- columns@whiteswanfoundation.org