জীবনে এই প্রথমবার 'মানসিক অসুস্থতা' কথাটি উচ্চারণ করেছিলাম

জীবনে এই প্রথমবার 'মানসিক অসুস্থতা' কথাটি উচ্চারণ করেছিলাম

Published on

যেদিন আমি আমার মাকে প্রচণ্ড মারমুখী হয়ে উঠতে দেখেছিলাম, সেদিন আমি ভয়ে ভয়ে সেই শব্দটার কথা মুখে উচ্চারণ করেছিলাম। তবে ফিসফিস করে বলেছিলাম। শব্দটা হল - 'মানসিক অসুস্থতা'। আমি সেই সময়ে খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমার বন্ধুরা সবসময়ে আমার পাশে ছিল। আর আমি গুগ্‌ল ঘেঁটে খুঁজছিলাম যে কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আমাকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য করতে পারবে। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না ঠিক কোন ধরনের লক্ষণের কথা সার্চ বারে লিখব? আমরা সেই বিষয়ে কিছু জানতামই না এবং আমার এই বিষয়ে অজ্ঞতার জন্য কোনও ধারণা বা সচেতনতাই ছিল না। আমরা অনেককে ফোন করেছিলাম। আমি মায়ের অবস্থার খুঁটিনাটি সম্পর্কে অনেক মানুষকে ই-মেইল করে পরিস্থিতির বর্ণনা করেছিলাম। মায়ের অসুখের বিষয়ে আমরা অনেক মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলতাম এবং বোঝার চেষ্টা করতাম যে সমস্যার সমাধানের জন্য কীভাবে আমাদের এগোতে হবে। আমরা কয়েকজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ফোন নম্বর জোগাড় করেছিলাম যাদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছিল।

পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ ছিল এবং আমরা চাইছিলাম সঠিক ব্যবস্থা নিতে। অবশেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা নিমহ্যান্সে যাব। আমরা শুনেছিলাম, এটি মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ও সেরা প্রতিষ্ঠান। সেই মতো দেরি না করে পরের দিনই আমরা মাকে বুঝিয়েসুজিয়ে ডাক্তার দেখাতে রাজি করাই। আমরা জানতাম না যে মা আদৌ এই প্রস্তাবে সম্মতি দেবে কিনা। তবে যদি দেয় তাহলে পরের দিন থেকেই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম যে নিমহ্যান্সে ডাক্তার দেখানোর সময় হল- সকাল ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত।

শীতের এক ঝলমলে রোদ ওঠা সকালে আমরা নিমহ্যান্সের গেটে লম্বা লাইনে দাঁড়াই। তখন ঘড়িতে প্রায় ৮টা বাজে। তখনও আমরা জানতাম না কোন ডাক্তারের কাছে যাব এবং কী করব। আমাদের মতো এভাবেই প্রতিদিন শ'য়ে শ'য়ে লোক নিমহ্যান্সের উপর তাদের বিশ্বাস নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়ায় এবং অবশেষে তারা ডাক্তারের দেখা পায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম- বড় একটা ঘর তার মধ্যে ছোট ছোট ভাগ করা, ওয়েটিং রুমে শ'খানেক চেয়ার পাতা ছিল। যেমন রেল স্টেশনে মানুষের বসার জন্য থাকে। বাইরেও বসার বেঞ্চ ছিল। একটা পেন ছিল। সেই পেনটাই সবার হাতে হাতে ঘুরছিল ফর্ম ফিলাপ করার জন্য। ওই ফর্মে রুগির নাম, বয়স এবং লিঙ্গ প্রভৃতি লিখতে হচ্ছিল। অত লোকের মধ্যে কে রুগি আর কে পরিচর্যাকারী অর্থাৎ রুগির বাড়ির লোক সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই করা যাচ্ছিল না। অপেক্ষারত মানুষগুলিকে এলোমেলো, হতাশ দেখাচ্ছিল। তারা ধৈর্য ধরার ভান করছিল।

একটা অজানা, অচেনা চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারস্থ হলেও সেখানে হাঁফছাড়ার মতো কিছু বিষয় ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল অনেক মানুষের একইরকম সমস্যা - তারা প্রত্যেকেই ছিল অসহায়, পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা এবং ক্লান্ত। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। দ্বিতীয় স্বস্তির জায়গা ছিল এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে সুষ্ঠুভাবে এগোন। হাসপাতালে আমরা যে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম তা ক্রমশ ছোট হয়ে আসতে লাগল। এভাবে আমরা অ্যাডমিশন কাউন্টারের সামনে এসে পৌঁছলাম প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণ করলাম। এরপর আমাদের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলা হল। আমরা অন্য আরেকটা লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতে একটা টোকেন দেওয়া হল। ঠিক যেমন ব্যাঙ্কে টাকা তোলা বা জমা দেওয়ার সময়ে টোকেন দেওয়া হয় সেরকম টোকেন এখানেও দেওয়া হল। লাইনটা ক্রমশ ছোট হয়ে এল এবং আমরা একটা ঘরের সামনে এসে পৌঁছলাম। এই প্রথম আমরা একজন জুনিয়র ডাক্তারের দেখা পেলাম। এরপর আমি যেন কিছুটা স্বস্তি বোধ করেছিলাম।

ছোট ঘরে একজন বসেছিলেন। তার সামনের টেবিলে রাখা ছিল প্রচুর ফাইলপত্র। আমি জানতাম ওই লোকটিকে ভরসা করেই আমাদের এগোতে হবে এবং ওনাকে ওনার কাজ করতে দিতে হবে। এসব মনে মনে ভাবলেও বাস্তবে তা করে দেখানোটা সেইসময়ে সত্যিই বেশ কঠিন ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল উনি কি সঠিক প্রশ্ন করবেন? আমি কী করে বুঝব যে উনি আসলে কী জানতে চাইছেন যখন উনি আমাকে আমার মায়ের সাজ পোশাকের বিষয়ে প্রশ্ন করছেন? ওনার করা প্রশ্নকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা কি আমার রয়েছে?

এখন মনে হয় যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কে দেখানো অন্য ডাক্তার দেখানোর থেকে অনেক আলাদা। যদি আমি একজন দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিজের সমস্যা নিয়ে যাই, উনি যে প্রশ্নগুলো করবেন তার উত্তর একদম সোজা, যেমন - হ্যাঁ আমার কষের দাঁতে ব্যথা এবং আমি সিগারেট খাই ও দিনে দু'বার দাঁত ব্রাশ করি। কিন্তু একজন মনোবিদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একধরনের আত্মরক্ষামূলক ভাব চলেই আসে, বিশেষত যখন অন্যের হয়ে উত্তর দিতে হচ্ছে - হ্যাঁ উনি স্নান করেন, কিন্তু আপনি কেন সেকথা জিজ্ঞাসা করছেন? উনি সবসময়ে এরকম পোশাক পরেন, কিন্তু তার সঙ্গে এই বিষয়ের কী সম্পর্ক?

এভাবেই কিছুক্ষণ চলেছিল। আসলে আগে-পিছে বা এদিক-ওদিক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে মানসিক উদ্বেগের দিকটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন ডাক্তারবাবু। আমাদের কাছে একটা বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর তা হল চিকিৎসার যে প্রক্রিয়াটা চলছিল তা চলতে দেওয়া এবং তার উপর বিশ্বাস রাখা। তখন আমার কাছে আমার মায়ের অসুখের যথাযথ নজরদারিই ছিল মুখ্য বিষয়। ওই সময় আমাদের ক্যাম্পাসের অন্য আরেকটি জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হল চিড়িয়াখানা বা পার্কে চলা একরকম গাড়ি চাপিয়ে। এবার আমরা হাসপাতালের ডরমেটরিতে এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অন্য আরেক দল চিকিৎসকেরা এলেন। তারা অনেক প্রশ্ন করলেন আমাদের এবং তার উপর অনেক আলাপ-আলোচনাও চলল। এই গোটা ঘটনার শেষে আমাদের জানানো হল যে আমার মায়ের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন আছে।

একটা গোটা দিন ধরে অনেক কিছু করলেন ডাক্তারবাবুরা, যেখানে না হল আসল অসুখ চিহ্নিত করা বা না ঘটল তার সমাধানের সাথে পরিস্থিতির আবর্তন। এমন অনেকদিন ধরেই চলল। তবে সেই সময়ে ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না আমাদের কাছে। এতদিনের যাত্রাপথ আমাদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা লম্বা একটা অধ্যায়। আরও না হয় কিছুদিন অপেক্ষা করলাম।

হাসপাতালে প্রথমদিন সকালে ঘুমের ওষুধের ঘোর কেটে আমার ঘুম ভাঙে। আসলে ভয় ও উদ্বেগের ফলে আমি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং ডাক্তাররা আমায় ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠেই আমি দেখলাম আমার মা তার বিছানায় নেই। সেই দেখে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল। তবে ওখানে ওই সময়ে এমন অনেক মানুষ ছিলেন যাঁরা আমার প্রতি খুবই স্নেহশীল ছিলেন। কারণ তাঁরা আমার আতঙ্ক ও চিন্তার কারণটা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছিলেন। ওই ডরমেটরিতে যেসব পরিচর্যাকারীরা ছিলেন তারা পুরো ব্যাপারটাই দেখেছিলেন। তাঁরা আমায় বললেন যে আমার মাকে কিছু পরীক্ষা করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাকে তাঁরা শুয়ে থাকতে বললেন এবং সব কিছু ঠিকঠাক হবে বলে আমায় আশ্বস্ত করলেন।

প্রতিদিন ভয় আর ধৈর্যের সঙ্গে সময় কাটতে হত। প্রচুর টেস্ট করা হল মায়ের। রিপোর্ট সংগ্রহ করা হল। মায়ের মানসিক অবস্থার খুঁটিনাটির ইতিহাস ফাইলে লিপিবদ্ধ করার কাজও চলছিল পাশাপাশি। হাসপাতালের ডাক্তাররা আমাকে অসুখের বিষয়ে কোনওরকম স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে চাইছিলেন না এবং তাঁরা পুরো সময়টাই ব্যয় করতেন সঠিকভাবে রোগ নির্ধারণের জন্য।

আমার বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমি চাইছিলাম আমার জায়গায় হাসপাতালে অন্য কেউ এসে থাকুক। আমি এই পরিবেশ থেকে দূরে সরে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু আমাকে বলা হল আমি যেন হাসপাতালেই থাকি। আসলে আমার ওখানে থাকার প্রয়োজন ছিল মায়ের কাজকর্ম, আচার-আচরণের দিকে নজর রেখে সে বিষয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য। এছাড়া চিকিৎসকদের কাছাকাছি থেকে মায়ের অসুখের সঠিক গতিপ্রকৃতি ঠিক করতে সাহায্য করাও সেই সময় আমার অন্যতম দায়িত্ব ছিল। আমি ছিলাম সেই সময় আমার মায়ের কল্পিত জগতের একজন বাস্তব সাক্ষী, যে শুধু অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজের মায়ের অসহায়তা, দুর্দশাগুলো চেয়ে চেয়ে দেখত।

অনেকগুলো দিন এভাবেই কেটে গেল। আমার বন্ধুরা সেই সময়ে ডাক্তারকে সাহায্য করার জন্য যে সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লাগবে সেগুলো একত্রিত করার কাজে আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল। ওই বন্ধুরা সেই সময় ছিল আমার কাছের মানুষ, একেবারে পরিবারের লোকদের মতো। তারা সমস্ত দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। একজন বন্ধু সারা রাত হাসপাতালে থাকত আর আমাকে সাহায্য করত। বন্ধুরা সবাই আমাকে খেতে, শুতে, চলতে, ফিরতে এমনকী হাসতেও মনের জোর দিত। আর আমি যাতে কোনও ভাবেই ভয় বা আতঙ্কের শিকার না হই, সেদিকে কড়া নজর রাখত। কারণ আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সেই সময়ে ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিল।

এইভাবে ওই বছরে এমন একটা সময় মায়ের আসুখের বৃত্তান্ত জানা গেল যখন আকাশে বাতাসে ফুরফুরে ভাব। একটা গোলাপি ফুলে ভরা গাছ ছিল নিমহ্যান্সের সাইক ব্লক বি-এর সামনে। বাগানের দু'টো বড় বড় গাছে দেখা যেত নরম গোলাপি ফুলের সমারোহ। আকাশটাকেও যেন অদ্ভুতভাবে নীল দেখাত এবং সূর্যাস্তের সময় আকাশটা যেন কেমন জাঁকজমকপূর্ণ থাকত। একদিন বিকেলে ওই গাছের ফুলগুলো সব ঝরে পড়ল। শান্তভাবে। ঠিক পেঁজা তুলোর মতো করে। আর চারদিকটা যেন মনে হল কেউ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। আর হাসপাতাল চত্বরের অন্যদিকটায় ছিল বেগুনি আর হলুদ ফুলের ছড়াছড়ি।

এটা ভাবলে খুব অবাক হতে হয় যে আমার মনের মধ্যে যে নিরানন্দের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তার ছাপ জগতের কোথাও ছিল না। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে এমন একটা গাছ চোখে পড়ত যার পাতাগুলোকে কন্নড় ভাষায় চিগুরু অর্থাৎ সদ্য বিকশিত হয়েছে বলে মনে হত। আমার মা আমাকে সবসময়ে বলত যে ওই গাছের ছায়া যেন ঠিক মায়েদের স্নেহ, স্পর্শের অনুভূতি দান করে (কন্নড় ভাষায় একে বলে থাআইয়া মাডিলু)।

ওই মনোরম গাছের তলায় বসে আমি আর মা কত সময় কাটিয়েছি। স্বপ্নের মতো ছিল সেই সময়টা। পরে মনে হত যে ওই সময়টা বোধ হয় আমাদের অজান্তেই চুরি হয়ে গিয়েছে। আমি একটা কথা জানতাম না যে আমার মা আবার সুস্থ হয়ে উঠবে কিনা, আমি এটাও জানতাম না যে ভবিষ্যতে মা এর থেকেও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে কিনা। আমি এটাও মাঝে মাঝে ভুলে যেতাম যে আমি আসলে কে এবং এও জানতাম না যে, যে মহিলা এখন আমার সামনে রয়েছে তিনিই বা কে। গাছের পাতা ঝরা দেখতে দেখতে মনটা কেমন অবশ হয়ে যেত। বসে বসে তাই দেখতাম। তাদের পাশে থাকলেও তাদের মনের কথা আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না।

এভাবেই সময় কাটছিল। ইতিমধ্যে ডাক্তাবাবুরা আমার মায়ের অসুখের নাম আমাদের জানিয়েছিলেন- সাইকোসিস। প্রথমবার আমি এই শব্দটা শুনেছিলাম। কোনও মানেই বুঝতে পারিনি। শব্দটা শুধু আমার কানে জোরে ধাক্কা দিয়েছিল। কিন্তু তার বিন্দু বিসর্গ আমি বুঝতে পারিনি। তবে এটুকু উপলব্ধি করেছিলাম যে শারীরিক অসুস্থতার মতো নয় এই অসুখ। একে বুঝতে গেলে উপমা বা তুলনার প্রয়োজন হয়। তার সঙ্গে পার্থিব জগতের খুব বেশি মিল নেই।

আমার সমস্ত পৃথিবীটা যেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন আমি আমার মায়ের সাথে থাকতে থাকতে এটা বুঝতে পারতাম যে মার জগত আর আমার বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। কিন্তু কীভাবে এই পরিস্থিতি জন্মাল? মায়ের আসল ব্যক্তিত্বটাই বা কী, যদি আসলে এমন কিছু থেকে থাকে। আমার সামনে যে  মানুষটা ছিল সে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা শুনে রেগে যাচ্ছিল, মনে করছিল যে তার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যে বলছিল যে আমি তার মেয়ে না? এগুলো কীভাবে হল?

মস্তিষ্কের মধ্যে অন্যদের আওয়াজ শুনতে পারাটা ঠিক কী?এই অসুখের সঙ্গে কি কিডনি বা হার্টের রোগের কিছু মিল রয়েছে? যখন আমি আমার বন্ধুর সাথে মাথার ভেতরে শুনতে পাওয়া এই আওয়াজগুলোর কথা আলোচনা করছিলাম, তখন আমরা ভাবতে শুরু করি যে আমরাও তো মাঝে মধ্যে নিজেদের সাথে কথা বলি, গল্প ফাঁদি। সেই ব্যবহার কি স্বাভাবিক?

মায়ের অসুখ চিহ্নিত করার বিষয়টা বুঝতে পারা খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু ডাক্তাররা আমাদের এই রোগের বিষয়ে অতটুকু জানিয়েছিলেন যাতে ঘটনাগুলি আমাদের পক্ষে বোঝা সহজ হয়। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো অসুখের ক্ষেত্রে বাস্তবের সঙ্গে রুগির কোনও সম্পর্কই থাকে না; তারা সম্মোহন ও আচ্ছন্নতার মধ্যে দিন কাটায়। এই তথ্যে আমরা কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করছিলাম।মায়ের ভাবনাচিন্তা বা কাজকর্মের মধ্যে যুক্তি বা পরিকল্পনা খুঁজে পাওয়ার প্রয়োজন আমার আর ছিল না।তার পরিবর্তে আমি মায়ের দেখাশুনা করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে শুরু করেছিলাম।

মায়ের মাথা থেকে সম্মোহনী শক্তি উধাও হতে পাঁচ সপ্তাহ সময় লেগেছিল। এই উধাও হওয়ার বিষয়টার কথা ভেবে আমার হাসি পায়, যেন মস্তিষ্কের মধ্যে জন্ম নেওয়া যে আচ্ছন্নতা, নানারকম শব্দ এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে মা এতদিন কাটাচ্ছিল সেগুলোকে উচ্ছেদের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পরে তারা শান্তভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। ওই পাঁচ সপ্তাহে আমি উপলব্ধি করেছিলাম কতদিন ধরে আমি এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সঙ্গে বোঝাপড়া করেছিলাম যা অনেক আগে সারিয়ে তোলা যেত। আমি বুঝতেই পারিনি যে মানুষের মস্তিষ্ক শরীরের আরেকটা এমন অঙ্গ যার নিজস্ব সমস্যা আর রোগ হতে পারে। অন্যান্য শারীরিক রোগের মতো মস্তিষ্কের রোগও একধরনের রোগ যা চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব।

মার এই অসুস্থতার বিষয়ে অনেক উত্তর আমার কাছে নেই। আমি মাকে নানান সাইকোথেরাপিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এমনকী, মাঝে মাঝে মনোবিদের কাছেও গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা মায়ের অসুখটাকে ঠিকমতো ধরতে পারেননি। কিন্তু আমার মনে বিশ্বাস ছিল যে, এমন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই রয়েছে যা আমার মায়ের সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করবে এবং আমাদের জীবনে পরিবর্তন এনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দেবে। এই ভাবনার জোরেই আমি এগিয়ে যাওয়ার সাহস খুঁজে পেয়েছি। আমি একথাও উপলব্ধি করেছিলাম যে এই পরিস্থিতির সাথে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেটা যদি আমাদের জানা থাকত তাহলে অনেক দুঃখ, কষ্ট আমাদের এতদিন ধরে সহ্য করতে হত না। কিন্তু আমি এবং আমার মা দু'জনেই খুব ভাগ্যবান যে ডাক্তাররা আমাদের সমস্যাকে খুবই সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিচার করে আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আমি একটা বিষয়ে সচেতন ছিলাম যে আমরা যে ধরনের সাহায্য পেয়েছি তা সবাই পায় না। কিছু কিছু রুগি চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। আবার অনেকের ভাগ্যে সঠিক চিকিৎসার সুযোগই জোটে না। এমনকী, অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে মানুষকে সাহায্য করার নামে প্রতারণা করা হয়। কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা অন্যদের ক্ষেত্রে হলেও আমার ভাগ্যে ঘটেনি।

ডাক্তাররা আমাদের বলেছিলেন মাকে আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে পারব এবং কোনওরকম মানসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে, যা অন্যান্য অনেক রুগির ক্ষেত্রে দরকার হয়, সেখানে আমার মাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি বেশ ভয়েভয়েই বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম; জানতাম যে জীবনে বড়সড় বদল আসতে চলেছে। আমি মাকে একা বাড়িতে রেখে বাইরে যেতে পারব না। আমার বন্ধুরা, যারা আমাদের দুঃসময়ে প্রতিটা মুহূর্তে আমার পাশে ছিল, তারাও তাদের নিজেদের জীবনে ফিরে গিয়েছিল।

আমার মা হাসপাতাল থেকে ফিরে আবার তার পুরনো ছন্দে ফিরতে শুরু করেছিল। মা আবার রান্নাবান্না করত আর সময়ে সময়ে আমার পিছনে খেয়ে নেওয়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করত। মা আবার আগের মতো গুছিয়ে জামাকাপড় ভাঁজ করছিল, ম্যাগাজিনগুলোকে সুষ্ঠভাবে গুছিয়ে রাখছিল। আমিও আস্তে আস্তে স্বস্তি বোধ করছিলাম এই ভেবে যে ওষুধে মায়ের কাজ হচ্ছে।

সবসময়ে মায়ের পাশে বসে থাকা সেই সময়ে খুব সহজ ছিল না কারণ মনের মধ্যে আতঙ্ক সবসময় দানা বেঁধে থাকত। ভয় হত যে মা আবার না অসুস্থ হয়ে পড়ে। আসলে মায়ের অসুখের ফলে আমার নিজের জীবনে ভারসাম্য আসতে বহু সময় লেগে গিয়েছিল। অসুখের নাম জানা ছিল সুস্থ হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ। মায়ের প্রয়োজন ছিল যত্ন আর সেবার যা সব সময় পরিমাণে মাপা সম্ভব ছিল না।

আমি আর আমার মা এখন একটা ছোট্ট সুন্দর বাড়িতে থাকি। মাঝে মাঝেই আমাদের মনে হয় আমরা যেন এক যুগ পরে একসঙ্গে থাকছি। আমরা একটা মিষ্টি মধুর জীবনের সন্ধান পেয়েছি। মায়ের সঙ্গে যা কিছু ঘটেছে সেই ঘটনাগুলো আমার খুব বেশী মনে পড়ে না। মায়েরও বোধহয় সেই সময়ের কথা মনে নাই। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ যে আমার মা আমার কাছে আবার ফিরে এসেছে। যখন মায়ের অসুস্থতার জন্য আমাদের জীবনে কোনও চাপ বা সমস্যা আসে, তখন আমি মায়ের  হাসিমুখটা দেখি আর ভাল লাগে যে মা আর নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থানের থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে না। মনে মনে আমি সেই চিকিৎসা, চিকিৎসক এবং ওষুধগুলোকে ধন্যবাদ জানাই, যা মাকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।


দু'ভাগের এই প্রবন্ধটিতে এমন একটি মেয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে যার জীবনে প্রথমবার মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল তার মায়ের স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রথম ভাগটি আপনি এখানে পড়তে পারবেন।

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org