শৈশবের মানসিক চাপ কি অবসাদের কারণ হতে পারে?

শৈশবের মানসিক চাপ কি অবসাদের কারণ হতে পারে?

Published on

নমনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ২০১২ সালে। সে বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকত। নমনের বাবা-মা আমাকে বলেছিল যে ছেলেকে নিয়ে তারা সবমসময়েই সমস্যায় থাকে। দশ বছরের মধ্যে নমনকে চারবার স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল। কারণ স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নমন ছিল একজন শান্তিভঙ্গকারী এবং বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ছাত্র, যার কুপ্রভাব স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের উপরও পড়ত।

নমনের তখন ১৯ বছর বয়স ছিল এবং গুরুতরভাবে তার ড্রাগের প্রতি আসক্ত জন্মেছিল। সারাদিন সে নিজের ঘরে বন্দি থাকত এবং সন্ধেবেলায় নেশা করতে  'গাঁজা পার্টিতে' যোগ দিত। নমনের বাবা-মা চেয়েছিল ড্রাগের নেশা ছাড়িয়ে তাকে কলেজে পড়তে পাঠাতে। সেজন্য তারা হাসপাতালে এসে বিশেষজ্ঞদের  পরামর্শ নেওয়া শুরু করেছিল।

আমি ছেলেটার সঙ্গে একা কথা বলেছিলাম। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলাম যে তার জীবনটা মোটেই শান্তির বা সুখের ছিল না। নমনের বাবা-মায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে অনেক টানাপোড়েন থাকায় ছোটবেলাটা তার খুব মানসিক উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে কেটেছিল; তার মা খুব অল্পতেই রেগে যেত এবং সামান্য কিছু ভুলভ্রান্তি হলেই নমনকে মারধর করত। নমনের বাবা ছেলের উপরে রেগেমেগে চেঁচামেচি করত এবং তাকে সবসময়ে একজন হেরে যাওয়া ছেলে বলে তিরস্কার করত; প্রত্যেকটা স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েই নমনের মানিয়ে নিতে অসুবিধা হত; স্কুলে নমনের অশান্তি করার পিছনে আসল কারণটা খুঁজে বের করার জন্য কোনও চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি; নমনের বাবা চেয়েছিল ছেলে তাদের পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরবে। সেজন্য ২০১১ সালের জুন মাসে নমন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হয়েছিল।

কিন্তু নমনের প্রকৃত আগ্রহ বা ঝোঁক ছিল লেখালিখি করার প্রতি। স্কুলে ইংরেজি এবং ইতিহাস পড়তেই তার সবচাইতে ভালো লাগত এবং দশ ক্লাসের পরীক্ষায় অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল সার্টিফিকেট অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন বা আইজিসিএসই-তে এই দুটো বিষয়ে নমন ভালো ফল করেছিল। নমনের বাবা-মা ছেলেকে ১১-১২ ক্লাসে সিবিএসই বোর্ডে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। নমন সেই সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পড়তে ঢুকে তার ওই পাঠক্রমটি খুব একঘেয়ে লাগতে শুরু করে এবং যেখানে কেরিয়ারের প্রশ্নটাই বড় হয় দেখা দেওয়ার কথা ছিল সেখানে ওই পাঠক্রমের প্রতি তার সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে যেতে শুরু করে। তখন নমন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হয়।

সেই সময় থেকেই নমন খুব অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেকথা সে বাইরে প্রকাশ করত না। কারণ নমন তার জীবনে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছিল। তার জীবনে পড়াশোনার বিষয়টি বদলানোর কোনও আশা ছিল না এবং সেই চেষ্টা করাই নমন ছেড়ে দিয়েছিল। মন খারাপ হলে তার চোখে জলও আসত না। কারণ প্রশ্ন করলে তার দিকে বাঁকা হাসি হেসে উত্তর আসত ''তার জীবনে দুঃখ পাওয়ার মতো কি এমন ঘটনা ঘটেছে?''

এই পরিস্থিতিতে জীবনের নানা প্রশ্নের অর্থ জানার জন্য নমন ইন্টারনেটে দর্শন পড়া শুরু করেছিল এবং সেখানে অ্যালবার্ট কামু'র কয়েকটি তত্ত্ব সে পড়ে জেনেছিল যে জীবন হল পরম্পরাগতভাবে বিমূর্ত একটা বিষয়, যাকে ঠিক সবসময়ে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এবং এহেন জীবনে বেঁচে থাকার বিষয়টাও অনেকটা এই নিয়মেই বাঁধা। তাই নমন মেনেই নিয়েছিল যে তার জীবনটাও ছিল বিমূর্ততায় ভরা এবং সেই কারণেই তার কোনও পছন্দ বা অপছন্দ থাকার প্রশ্ন নেই। এমনকী, জীবনে কোনও প্রত্যাশা রাখাও ঠিক নয়।

নমন বলেছিল সে যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানসম্মত ধরনের মানুষ নয়। বরং সে অনেক বেশি সৃষ্টিশীল ও অনুভবী ধরনের। কিন্তু লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জন করা শত চেষ্টার ভান করার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টা বাস্তব করা সবসময়ে সম্ভব নাও হতে পারে। নমন বলেছিল পড়ুয়া বাচ্চা, যারা বিজ্ঞান পড়তে ভালোবাসত এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির জন্য নিজেদের পড়াশোনার প্রস্তুতির মধ্যে ডুবিয়ে রাখত সে তাদের খুব হিংসে করত। কখনও কখনও ভাবত যে সেও যদি তাদের মতো হতে পারত তাহলে কত ভালো হত। কিন্তু এর সঙ্গে নমন এও জানত যে সে কোনওদিনই ওদের মতো হতে পারবে না।

নমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে অবসাদবিরোধী ওষুধ আর খাবে না। সে তার মনের কথা বলার এবং বিমূর্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল।

আমার সঙ্গে যখন নমনের তৃতীয় পর্যায়ে দেখা হয় তখন তার চোখ-মুখ থেকে নির্লিপ্ত ভাবটা যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। যেন সে তার ভিতরের ঘুমন্ত মানুষটার অস্তিত্বকে স্বীকৃতি জানাতে চাইছিল। নিষ্ক্রিয়তার আড়ালটাকে সরিয়ে ফেলতে চাইছিল। এভাবেই নমনের মানসিক অবসাদ আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। আমি তাকে খুব কম মাত্রার অবসাদবিরোধী ওষুধ দেওয়া শুরু করি। ওই ওষুধগুলো নমনের মানসিক উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করেছিল।

এরপর পঞ্চম পর্যায়ে যখন নমনের সঙ্গে আমার দেখা হয় তখন ও আমায় জানায় যে সে বিজনেস কোর্স নিয়ে আর পড়াশোনা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং লিবারাল আর্টস কলেজে ইংলিশ নিয়ে পড়ার জন্য আবেদন করেছে। এর পরেই নমন এই শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। তারপর আমার সঙ্গে আর তার দেখা হয়নি। নমনের ক্ষেত্রে একজন ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্টের দ্বারা চিকিৎসার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল। এর সাহায্যে শৈশবের একটা খারাপ অভিজ্ঞতার ফলে ছেলেটির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যে অসহায়তা, নিরাপত্তাহীনতার বোধ জেগেছিল তা দূর করা সম্ভব হয়েছিল। সেই সঙ্গে তার মধ্যে বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশলের যে অভাব ছিল তাও মেটানো গিয়েছিল। এবং এভাবেই ক্রমশ নমনের অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়েছিল।

নমনের মতো অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। এদের মধ্যে এই সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পিছনে থাকে জীবনের একেবারে প্রাথমিক পর্বে অর্থাৎ শৈশবে জন্মানো একটানা মানসিক চাপ, যা নানারকম ভাবে দেখা দিতে পারে।

একজন বাচ্চা যখন বড় হতে থাকে তখন নানা কারণে তার মধ্যে যে ধরনের মানসিক চাপ জন্মায়, তাকে সাধারণত স্বাভাবিক ঘটনা বলে বিবেচনা করা হয়। এর ফলে একজন মানুষের মধ্যে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হয় এবং বৃহত্তর জীবনে আরও বেশি করে চাপ সামলানোর ক্ষমতা জন্মায়। একটানা মানসিক চাপ আমাদের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যামপাস এবং অ্যামিগডালা অংশে একধরনের আপাতস্থায়ী পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে পরবর্তীকালে মানুষের মস্তিষ্কের এই অংশগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। একটি বাচ্চা আপাতভাবে এই পরিস্থিতি গ্রহণ করলেও এবং দীর্ঘদিনের মানসিক চাপে অভ্যস্ত হলেও পরবর্তীকালে এর ফলে সে অসহায়ভাবে অবসাদের মতো একটা সমস্যার শিকার হয়ে যেতে পারে।

অবসাদের অন্য আরেকটি কারণ হল বংশগত ত্রুটি। বিশেষ ধরনের বা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসূচক জিনের অধিকারী মানুষের মধ্যে প্রায়শই অবসাদ জন্মানোর ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে, এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জিন রয়েছে যার ফলে মানুষের মধ্যে অবসাদের বদলে বেশি করে স্থিতিস্থাপকতা জন্মায়।

অবসাদ হল মানুষের প্রকৃতি এবং তার লালন-পালনের ফলাফল। এমনকী বংশগতভাবে দুর্বল বা ঝুঁকিপূর্ণ একটা বাচ্চা শক্তিশালী এবং স্থিতিস্থাপক হয়ে বড় হতে পারে যদি তার শৈশব একেবারে চাপমুক্ত থাকে। আবার এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে থাকে। অর্থাৎ একটা বাচ্চা সুস্থ-সবল হয়ে জন্মালেও বড় হওয়ার সময়ে যদি সে একটানা মানসিক চাপের শিকার হয় তাহলে তার মধ্যে অবসাদ জন্মানোর ঝুঁকি প্রবল হয়। এই ঘটনাই মূলত নমনের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

অবসাদবিরোধী ওষুধ অবসাদের লক্ষণ এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই ওষুধগুলো লাগাতার চাপের ফলে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুকোষগুলোর উন্নতি ঘটাতেও সহায়তা করে থাকে। নমনের মতো মানুষের অবসাদ দূর করতে স্বল্প সময়কালীন ওষুধের চিকিৎসা এবং সেই সঙ্গে সাইকোথেরাপি খুবই ফলদায়ক। এর সাহায্যে মানুষের জীবন অর্থবহ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে আবার অবসাদের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।

এই ধরনের প্রবন্ধে ডাঃ শ্যামলা বৎসা দেখাতে চেয়েছেন যে অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের আচরণের পরিবর্তনের আড়ালে লুকিয়ে থাকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা। কীভাবে অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের সাধারণ আচার-আচরণের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার পূর্ব লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় তাও এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এই ধরনের রচনায় কমবয়সি ছেলে-মেয়েরা, যারা অহেতুকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা ভোগ করেছে, তাদের জীবনকাহিনী তুলে ধরে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে যখন একজন মানুষের আচরণের মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে তখন সেই ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে  বিচার করা জরুরি। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য বা পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

ডাঃ শ্যামলা বৎসা ব্যাঙ্গালোরের একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, যিনি কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের চিকিৎসা করছেন। যদি কোনও পাঠকের কোনও মন্তব্য বা প্রশ্ন থাকে তাহলে এই ঠিকানায় তিনি তাঁর মতামত লিখে জানাতে পারেন। ঠিকানাটি হল columns@whiteswanfoundation.org        

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org