আবেগ বনাম বাস্তব
আঠেরো। আমাদের দেশে এই বয়সে যুবক যুবতীদের ঠিক করে নিতে হয় যে তারা জীবনে কোন পথে এগোবে, তাদের কর্মক্ষেত্র কী, কী নিয়ে পড়বে, ইত্যাদি। সাধারণত এই বয়সের ছেলেমেয়েরা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর চাপে থাকে। তার উপর ভবিষ্যতের চিন্তা। অতিরিক্ত মানসিক দুশ্চিন্তার জন্য তাদের মনে এবং শরীর উভয়ের ওপরেই সাংঘাতিক চাপ পড়ে। এই চাপের জন্যে ডিপ্রেশন জাতীয় সমস্যা দেখা দেয়। প্রত্যেক বছর ফেব্রুয়ারী এবং মার্চ নাগাদ পরীক্ষা, অনিদ্রা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে এইরকম প্রচুর ছেলেমেয়ে আমার কাছে আসে।
বেশিরভাগ পরিবারেই সন্তানকে নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকেই গবেষণা আরম্ভ হয়ে যায়। কিন্তু মা-বাবা হিসেবে তাঁদের সবার আগে সন্তানের মনের কথা জানা উচিৎ। নিজেদের উচ্চাশার ভার না চাপিয়ে, সন্তানের সাথে বসে আলোচনা করা উচিৎ। প্রায় প্রতিদিনই শুনি ছেলেমেয়েরা এত চাপ সামলাতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেমেয়েরা যদি তেইশ-চব্বিশ বছর বয়েস থেকে রোজগার করে, মা-বাবা নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। এই সব চাপের জন্যে ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন পরীক্ষা দেয় যাতে পাস করলেই মোটা বেতনের চাকরি পাওয়া যায়। তাঁরা আদৌ যা পড়ছে তা ভাল লাগছে কি না, তাই নিয়ে ভাবার বা বোঝার সময় থাকেনা।
কিন্তু সত্যি যদি আমাদের ভাবার বা বোঝার সময় থাকতো, তাহলে কিরকম হত সেটা ভেবে দেখেছেন? যদি সবাই বসে ভাবার সময় পেতো, তাদের কি ভালো লাগে, কি পড়লে তারা তাদের স্বপ্ন সত্যি করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে শুধু মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বা একজন কাউন্সেলরই সাহায্য করতে পারেন। যদিও শেষপর্যন্ত নিজেকেই বুঝতে হবে যে কি পড়লে তাদের স্বপ্ন সত্যি হওয়া সম্ভব।
নতুন ধরণের কোন পেশা বেছে নেবার আগে দেখা উচিৎ যে যথেষ্ট প্রতিভা আছে কিনা। যেমন খেলাধুলো। সেরা না হওয়া আর যোগদান না করা একই ব্যাপার। আর যদি সে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে তবে সে ‘বার্ন আউট’এ ভুগবে। ‘বার্ন আউট’ হচ্ছে একটি মানসিক সমস্যা, যা হলে মানুষ প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কোনো কিছুতে মন লাগে না, খুব নেতিবাচক হয়ে পড়ে, এবং কোন কাজই ঠিক করে করতে পারে না।
আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের বাবা-মাকে সব সময় নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে বোঝাতে হয়, রাজি করাতে হয় কারণ পুরো খরচটাই তাঁরা বইবেন। যেমন কেউ হয়ত অঙ্কে বা বিজ্ঞানে ভালো নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও সাংবাদিক হতে চায়। কিন্তু মা বাবা চায় সে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে অনেক টাকা রোজগার করুক, কারন তাঁরা ভাবেন যে সাংবাদিকতায় কোন ভবিষ্যৎ নেই। এবং এই ক্ষেত্রে অহেতুক অশান্তি করেও লাভ হয় না। পৃথিবীতে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে একটি প্রচলিত বিশ্বাস হল যে শুধু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং অঙ্ক জাতীয় পড়াশোনা করলেই ভাল চাকরি পাওয়া সম্ভব। আজকালকার ছেলেমেয়েরা এই পাকেচক্রেই ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
এইসব শুনতে স্বাভাবিক মনে হলেও এর ফলাফল খুবই ভয়ঙ্কর। জোর করে অপছন্দের বিষয়ে নিয়ে পড়ার ফলে অনেকেরই ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়। একের পর এক ফেলের রেসাল্ট হাতে এলে তখন পেছনে ঘুরে তাকাবারও সুযোগ থাকে না। দাঁতে দাঁত যেপে তাঁরা তখন লেগে থাকে এই আশায় যে কোনও রকমে পাশ করলে হয়ত ছবিটা পালটে যাবে। অন্তত আর্থিক দিক থেকে। কিন্তু তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল ভেঙ্গে যায়। এক কথায় তাঁরা মানসিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলে।
দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার ফলে এরা প্রায়ই ভাবেন যে সমস্যাটা তাঁদের নিজেরই। অপছন্দের বিষয় পড়তে গিয়ে ক্রমাগত নিজের বিধিকে দোষ দিয়ে চলেন। আপাত দৃষ্টিতে বোঝা না গেলেও ভেতরে ভেতরে এই হতাশা তাঁদের প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খেতে থাকে।
শিক্ষাবিদরা বলেন যে পড়াশোনা করার মূল কারণ হলো নিজেকে আরো ভালোভাবে গড়ে তোলা। নিজেকে ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্যে তিনটি বিশেষ জিনিস জরুরি- স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, পরিষ্কার ভাবে নিজের চিন্তা ভাবনা সাজানো আর নিজের সিদ্ধান্তের সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা। বিভিন্ন চাপ থাকা সত্তেও নিজের ওপর বিশ্বাস বজায়ে রাখাটাই হলো সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে ভারতবর্ষে পড়াশোনা করা মানেই হলো ভালো রোজগার করে পরিবারের দেখাশোনা করা। যতক্ষণ তাঁদের সামান্য দরকারগুলো পূরণ হচ্ছে ততক্ষণ তারা নিজের মনের ইচ্ছা পূরণ করার কথা ভাবতেও পারে না। তাও কয়েকজন এই সব জটিলতার মধ্যেও নিজের মনের মত ভবিষ্যৎ বেছে নিয়ে নিজের মনের শান্তি খুঁজে পেয়েছে, তাই আশা করা যায় যে ভবিষ্যতে ছবিটা কিছুটা হলেও পাল্টাতে পারে।
ডাঃ শ্যামলা বৎসা বেঙ্গালুরুর একজন মনোবৈজ্ঞানিক (সাইকিয়াট্রিস্ট) যিনি কুড়ি বছরেরও বেশী সময় ধরে এই পেশার সাথে যুক্ত। এই সংক্রান্ত আরো লেখা এখানে পাক্ষিক ভাবে প্রকাশিত হবে। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন।