বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যা ঠেকানো যায়
প্রতিদিনই খবরের কাগজের পাতায় বা টেলিভিশনের পর্দায় অল্পবয়সীদের আত্মহত্যার ঘটনা মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। মানসিক রোগের চিকিৎসকদের এইরকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় মাঝে মধ্যেই।
১৬ বছরের মহেশ দশম শ্রেণির ছাত্র। সে একটি মেয়েকে ভালবেসেছিল। কিন্তু মেয়েটি মহেশের ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে অন্য জনের সঙ্গে ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে। এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে মহেশ বাবা-মাকে একটা চিঠি লিখে রেখে আত্মঘাতী হয়।
এরকম আরও একটি ঘটনা। ১৫ বছরের জানাভি তার বন্ধু নিশার কাছ থেকে দশম শ্রণির ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের খবর পায়। জানাভি মোবাইল ফোনের সাহায্যে তার রেজাল্ট চেক করতে গিয়ে দেখে সে ইংরাজিতে পাশ করতে পারেনি। ওই মুহূর্তে সে বাড়ির কাউকে কিছু না বলে এবং স্কুলে গিয়ে পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার বদলে আত্মহত্যা করে বসে।
১৮ বছরের প্রজ্ঞাকেও একদিন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল। বাড়িতে বাবা-মার মধ্যে প্রতিদিনই ঝগড়া লেগে থাকত। তার বাবা প্রায়শই মদ খেয়ে মাকে মারধর করত। বাবা-মার এই দাম্পত্য কলহ প্রজ্ঞার মনে গভীর ছাপ ফেলে। লেখাপড়া এবং অন্যান্য কাজে তার মনোযোগ নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। সে তার সমস্যার কথা কারও কাছে বলতে না পেরে নিজের জীবন শেষ করে দেয়।
বয়ঃসন্ধির আবেগ
বয়ঃসন্ধি সাধারণত উচ্ছ্বলতা এবং গভীর আবেগে ভরপুর। কিন্তু চিন্তাভাবনা ও বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অপরিণত বা অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক। এই সব কারণে তাদের মধ্যে ব্যর্থতা, মানসিক হতাশা, অবসাদ বা অন্যান্য আরও সমস্যা দেখা যায় এবং এর ফলে তারা ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে না পেরে বয়ঃসন্ধিতে পালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠে। সমস্যার মোকাবিলায় তারা অন্য কারও কাছ থেকে সাহায্য চাইবার বদলে আত্মহত্যার সহজ পথে এগিয়ে যায়।
বয়ঃসন্ধির আত্মহত্যা মূলত হঠকারী চিন্তাভাবনার ফল। এই বয়সের ছেলে-মেয়েরা ভাবে যে, কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরনোর জন্য কারও কাছে সাহায্য চাওয়া মানে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা। কিন্তু সময়োচিত সহায়তা এবং জীবনের জটিলতাগুলি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পরিবার ও বন্ধুদের সাহচর্য পাওয়া এবং তাদের আবেগপ্রবণ সমর্থন খুবই দরকারি বিষয়।
বাস্তব এবং সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে দেখা
আজ সারা বিশ্বের বহু বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের অকালে ঝরে যাওয়ার পিছনে রয়েছে আত্মহত্যার ঘটনা। তথ্যের সাহায্যে জানা গিয়েছে, প্রতি বছরই এহেন আত্মহত্যার ঘটনা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর পিছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। যেগুলি মূলত ব্যক্তিগত, পারিবারিক, শিক্ষা সংক্রান্ত এবং মানসিক। সমগ্র বিশ্বে প্রতি বছর ৭১,০০০ উঠতি বয়সিদের আত্মহত্যার ঘটনা জানতে পারা যায়।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরো (এন সি আর বি)-র তথ্য অনুযায়ী ভারতে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৩৪ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯-এর মধ্যে। ২০০১ সালে এই বয়সিদের আত্মহত্যার মোট সংখ্যা ছিল ৩৮,৯১০। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬,৬৩৫। এই সময়ের মধ্যে আত্মহত্যার হার প্রায় ১৯.৯ শতাংশ বেড়েছে।
জীবনে ব্যবহারিক দক্ষতার প্রশিক্ষণ
বয়ঃসন্ধিকালের আত্মহত্যাগুলি অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। এই বয়সের একটি ছেলে বা মেয়ের মধ্যে ব্যবহারিক দক্ষতা যত বাড়বে, তত তাদের মধ্যে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। এর ফলে তারা জীবনের হতাশাগুলিকে যুক্তি দিয়ে বিচার করার জায়গায় পৌঁছবে। জীবনে দক্ষতার প্রশিক্ষণ পেলে একজন উঠতি বয়সির মধ্যে সময়ের সদ্ব্যবহার, কার্যকরী সংযোগ, পারস্পরিক সম্পর্ক, অবসাদ কাটানো, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বেড়ে যায়। এই প্রশিক্ষণ একদিকে আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করতে পারে এবং অন্যদিকে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে সহায়তা করে।
ডা. বৃন্দা এম এন, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সাইকিয়াট্রিক সোসাল ওয়ার্ক, নিমহান্স।