বয়ঃসন্ধিকালীন জীবনযাপনের কৌশলগত গুরুত্ব
বয়ঃসন্ধি একজন মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশ এবং উন্নতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই সময়টিকে সাধারণত শৈশব থেকে যৌবনের পথে পা বাড়ানোর মধ্যবর্তী কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এই পর্বের বৈশিষ্ট্য হল দ্রুত মানসিক পরিবর্তন এবং মানসিকভাবে পরিণত হয়ে ওঠা। এটি জীবনের এমন একটি পর্যায় যখন একটি ছেলে বা মেয়ে তার অভিভাবক এবং পরিবারের গণ্ডির বাইরে আরও অনেক নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এইসময় কিশোর-কিশোরীরা তাদের সমকক্ষ মানুষজন এবং বৃহত্তর পৃথিবীর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত
হয়ে থাকে।
বয়ঃসন্ধিকালে যেহেতু জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, তা পরিণত হয়ে ওঠে, সেহেতু মানুষের চিন্তাভাবনার মধ্যে যুক্তির প্রাধান্য গড়ে ওঠে। এই পর্বের ছেলে-মেয়েরা বিমূর্ত চিন্তা বা কল্পনা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে, বোধ-বুদ্ধির বিকাশের ফলে তাদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তাভাবনার জন্ম হয়। এইসময় একটি তরুণ বা তরুণীর মধ্যে প্রকৃত অর্থে সৃষ্টিশীলতা, আদর্শবাদ, ফুরফুরে মেজাজ এবং দুঃসাহসিক কাজ করার নেশা পেয়ে বসে। এই বয়সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ও ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। তাছাড়া সমতুল্য কারও চাপে নেতিবাচক মনোভাব, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এলোমেলো বা ভুলভাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিশেষত একজন কিশোর বা কিশোরীর মনে এইসময় দেহগত এবং যৌনতার ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। আসলে বয়ঃসন্ধি মানুষের জীবনের মোড় বা গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বয়সের একজন ছেলে বা মেয়ের মধ্যে যেমন প্রচুর সম্ভাবনা দেখা যায়, তেমন অপরদিকে কোনোরকম আঘাত বা সমালোচনার মুখে এরা খুব অসহায় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।
বয়ঃসন্ধিকালে কয়েকটি মূল বিষয়ের দিকে নজর রাখা জরুরি। যেগুলির মধ্যে রয়েছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে গঠন করা, নিজের অনুভূতিগুলির নিয়ন্ত্রণ, সম্পর্ক স্থাপন, ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নিজের সমকক্ষ কারোর চাপ সামলানো ও তাদের কুপ্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করা। এই বয়সের সবচেয়ে ক্ষতিকর ও দুর্বল দিক হল যে, কোনও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং সেই কাজে যেনতেনপ্রকারে সফল হওয়া।
অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে যে, কিশোর-কিশোরীরা তাদের জীবনের চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবিলা করতে সফল হচ্ছে। আবার কখনও বাধা অতিক্রম করার জন্য তাদের লড়াই করতেও হয়। গুরুতর সমস্যা সফলভাবে সমাধানের জন্য বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের কয়েকটি বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হয়। সেগুলি হল— ব্যক্তিত্ব, পারিপার্শ্বিকের কাছ থেকে অর্থাৎ অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমকক্ষদের মানসিক সমর্থন ও নিজেদের জীবনযাপন পদ্ধতির কৌশল রপ্ত
করা জরুরি।
জীবনযাপনের যথাযথ কৌশল অবলম্বন একটি বয়ঃসন্ধির ছেলে বা মেয়ের দায়িত্বশীলতা, উদ্যোগী হওয়া এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ফলদায়ক মাধ্যম। এহেন কৌশল নেওয়া তখনই সম্ভব হয় যখন একজন অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ে দৈনন্দিন জীবনের সংঘাত, সম্পর্কের জটিলতা এবং সমকক্ষদের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট ভাবাবেগের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। যে কোনও সমাজবিরোধী এবং বিপজ্জনক কাজকর্ম থেকে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের দূরে রাখতে গেলে সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করা একান্ত জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা 'হু'-এর মতে, জীবনযাপনের দক্ষতা আসলে মানুষের মধ্যে এমন ইতিবাচক মনোভাব এবং পারদর্শিতার জন্ম দেয়, যার ফলে কোনও ব্যক্তি তার প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা এবং সংকটগুলির মোকাবিলা করে সফল হতে পারে। কোনও কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে একজন মানুষের চিন্তাভাবনায় নমনীয়তা দেখা যায় এবং সে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে ইতিবাচক মানসিকতা যে কোনও ব্যক্তিকেই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে এবং প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও সে আশার আলো দেখতে পায় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়।
জীবনযাপনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে একজন মানুষের মধ্যে মানসিক ক্ষমতা এবং তার অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটে। এর ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, সমস্যার সমাধান, চিন্তার গভীরতা, সৃষ্টিশীলতা, সফলভাবে যোগাযোগ স্থাপন, সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা, সবার সঙ্গে সহযোগিতা করা এবং জীবনকে সুস্থ ও উৎপাদনশীল করে তোলা সম্ভবপর হয়।
সুচিন্তিত ভাবনা এবং ব্যবহারিক দক্ষতা
সাধারণভাবে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে দুই ধরনের কৌশল অবলম্বন করা যায়। এক ধরনের কৌশলের সাহায্যে মানুষের চিন্তাভাবনায় গভীরতা আসে। আবার আরেক ধরনের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। চিন্তাগত দক্ষতা ব্যক্তির জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সহায়ক হয়। অপরদিকে, ব্যবহারিক ক্ষমতার বলে সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ দৃঢ় হয়ে ওঠে। মানুষের আচরণ এবং কার্যকলাপের ক্ষেত্রে এই দুই পদ্ধতির ব্যবহার অত্যন্ত উপযোগী ও ফলদায়ক।
আবেগপ্রবণতা মানুষের এমন একটি দক্ষতা, যা তাকে শুধুমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নিতেই সাহায্য করে না, সেই সঙ্গে অন্যের মতামতকে সম্মান করতেও শেখায়। এই কারণে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের এমন শিক্ষা দেওয়া উচিত যাতে তারা তাদের নিজেদের মনের দ্বন্দ্ব এবং অনুভূতিগুলিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে। আর অন্যদিকে নিজেদের ভাবাবেগ, মানসিক উদ্বেগ এবং সমকক্ষ কারও বা পরিবারের সদস্যদের চাপের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে। সুচিন্তিত ভাবনা এবং ব্যবহারিক দক্ষতা কিশোর-কিশোরীদের সুস্থ ও সবলভাবে বাঁচতে সাহায্য করে।
'হু'-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রধান দশটা (১০) জীবনযাপনের কৌশল হল—
আত্মসচেতনতা — এর মধ্যে আমাদের ব্যক্তিগত চরিত্র, শক্তি, দুর্বলতা, পছন্দ এবং অপছন্দ সব কিছুই রয়েছে। আত্মসচেতনতা গড়ে ওঠার মাধ্যমে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েরা তাদের মানসিক চাপ অনুভব করতে সক্ষম হয়। নিজের সঙ্গে এবং সমাজে অন্যদের সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আত্মসচেতনতা একান্ত জরুরি বিষয়। এছাড়া অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতেও সাহায্য করে আত্মসচেতনতা।
সহানুভূতি — প্রিয়জন বা বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সফল সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়ঃসন্ধির সময়ে অন্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া, তার চাওয়া-পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ বা অনুভূতিগুলিকে বোঝা, সম্মান করতে শেখা একান্ত জরুরি। সহানুভূতিশীলতা মানুষের এমন একটি গুণ, যা তাকে জীবনে অপরের কথা ভাবতে শেখায়। ব্যক্তির মধ্যে এহেন গুণ না থাকলে সামাজিক আদান-প্রদান হয় না। বয়ঃসন্ধি যদি নিজেকে চেনা, জানা, বোঝার বয়স হয়, তাহলে অন্যের প্রতি সহানুভূতি, তাদের সমর্থন আদায় বা অন্যকে বোঝাও এই বয়সের অন্যতম ধর্ম। এই গুণের সাহায্যে একজন বয়ঃসন্ধির ছেলে বা মেয়ে নিজের থেকে আলাদা কাউকে সহজে গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে সামাজিক আদান-প্রদানেরও উন্নতি ঘটে। এই সময় রুচি এবং সংস্কৃতির পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মানুষের জীবনে এমন বন্ধুত্বের সূচনা হয়, যা পরবর্তী অনেক কাল ধরে স্থায়ী হয়।
বিচক্ষণ চিন্তাভাবনা মানুষের এমন একটি পারদর্শিতা, যা তাকে বাস্তব সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তোলে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে শেখায়। কোনও বিষয়ের প্রতি গভীর চিন্তা একজন কিশোর বা কিশোরীর মানসিকতা ও আচরণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এর ফলে তাদের মধ্যে মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।
সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা বয়ঃসন্ধিকালে একজন ব্যক্তির উপর সাধারণত চারভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যেমন — মনে নতুন ভাবনার উদয় হয়, কাজকর্মের ক্ষেত্রে নমনীয়তা আসে, নতুন কিছু করার ইচ্ছা জাগে এবং অন্যান্যদের সঙ্গে নিজের চিন্তার আদান-প্রদানের প্রবণতা দেখা দেয়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা একজন বয়ঃসন্ধির ছেলে বা মেয়েকে জীবন গঠনে সাহায্য করে। অনেক মতামতের মধ্য থেকে তারা ঠিক এবং কার্যকরী মতটিকেই গ্রহণ করতে সচেষ্ট হয়।
জীবনের নানা সমস্যা সমাধানের অভ্যাস গড়ে ওঠায় একজন তরুণ বা তরুণী কোনও সমস্যাকেই ভয় না পেয়ে সেগুলির মোকাবিলা করতে তারা এগিয়ে আসে। পরিস্থিতির ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতাও এইসময় তাদের মধ্যে জেগে ওঠে।
দৈনন্দিন জীবনে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক গড়ে তোলার সদিচ্ছা একজন অল্পবয়সির মনে ইতিবাচক মানসিকতার জন্ম দেয়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন এই বয়সের ছেলে বা মেয়েদের মানসিক এবং সামাজিক দিক থেকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে তাদের সাহচর্য এবং সমর্থন আদায় সহজ হয়। এহেন দক্ষতা অনেক ভাঙা সম্পর্ককে জোড়া লাগাতে সাহায্য করে।
যোগাযোগের যথাযথ পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে বয়ঃসন্ধির মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এর ফলে তারা নিজেদের মতামত, ভালো লাগা, চাহিদা, ভীতি এমনকী প্রয়োজন মতো অন্যের সাহায্য চাইতেও এগিয়ে যায়।
মানসিক চাপের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে তারা চাপের কারণ, কীভাবে তা তাদের জীবনে প্রভাব ফেলছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, কীভাবে নিজেকে চাপমুক্ত রাখা যায় প্রভৃতি বুঝতে পারে। এইভাবে তাদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের জন্য ইতিবাচক পদ্ধতি অবলম্বন এবং অন্যের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজের সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করার অভ্যাস তৈরি হয়। এর জন্য তারা তাদের জীবনযাপন পদ্ধতির বা পরিবেশের বদলও ঘটাতে পারে এবং কীভাবে ভালো থাকা যায়, তার সন্ধানও করতে পারে।
ভাবাবেগের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের নিজেদের এবং অপরের অনুভূতিকে সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করে। আবেগ তাদের প্রাত্যহিক আচরণের উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করছে সে সম্পর্কে তাদের সচেতনতা বাড়ে এবং অনুভূতির প্রতি তারা যথাযথভাবে সাড়া দিতে শেখে। এই কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রাগ বা দুঃখের মতো মনের গভীর অনুভূতিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা। যদি এইসব নেতিবাচক মনোভাব দূর করার চেষ্টা করা না হয় তাহলে তা শরীরের উপর কুপ্রভাব ফেলতে পারে।
ডাক্তার গরিমা শ্রীবাস্তব দিল্লির একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সাইন্সেস থেকে তিনি পিএইচডি করেছেন।