সম্প্রদায়ের পুনর্নির্মাণ – আশাবাদের পক্ষে তর্ক
বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ ভারতে দেখা দেওয়ার সাথে-সাথেই পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন লকডাউন-ও আমাদের দেশে চালু করা হয়। এতে মানুষের জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। বিস্তর সংখ্যায় পরিযায়ী মানুষ বাড়ি ফিরে আসেন এবং তাদের জীবন ও জীবিকার অপূরণীয় ক্ষতি হয়। কোঠর নিয়মাবলীর ফলে নিজেদের সামাজিক গোষ্ঠীর থেকে এবং অনুভুতিগত, সামাজিক এবং ত্রাণের ক্ষেত্রে মানুষ যাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল তাদের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। এই নিবন্ধের লেখিকা এমন মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন যারা এই সময় অনুভব করা শূন্যতা পূরণ করতে নতুন স্থান সৃষ্টি করার কথা ভেবেছেন।
“কেমন আছো?”
“যখন আমি এটা করা শুরু করি তখন আমার কোনও ধারণা ছিল না যে কী হতে পারে কিন্তু সময়ের সাথে এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রোজ দেখা দিতে হয় এবং অন্যদের সেই জায়গা করে দিতে হয়।” এমনটা জানালেন হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের কন্টেন্ট রাইটার শ্রীরঞ্জিতা জেউরকর। স্বাভাবিক জীবন চলছিল। হঠাৎ করে লকডাউনের সাথে মানিয়ে নিতে তার অসুবিধা হওয়ার ফলে তিনি বন্ধুদের মেসেজ করে জানতে পেরেছিলেন যে এমন নয় যে এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের ফলে অস্বস্তি তিনি একাই অনুভব করছেন। সবার মধ্যে দূরত্ব, একাকীত্ব, সংশয় এবং উদ্বেগের যোগসূত্রকে সম্বোধন করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি রোজ তার ফেসবুক প্রোফাইলে “কেমন আছো?” পোস্ট লিখতে শুরু করেন। এতে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখতে পান তিনি। কয়েকজন শুধু “লাইক” দিয়েই চুপ করে যেতেন আর কিছুজন কোনও না কোনও ধরনের মন্তব্য অবশই করতেন। এরই সাথে অনেকে তাকে জানাতে শুরু করেন যে এই পোস্টগুলোর ফলে তাদের কিছুটা হলেও নিজেদের কম বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে গড়ে তোলা এই স্বস্তির গণ্ডি মানুষকে সেই কথাগুলো বলার সুযোগ করে দিয়েছে যা ব্যক্ত করার সুযোগ তাদের জীবনে আপাতত নেই।
রেডিও কোয়ারেন্টাইন
দর্শনা মিত্র তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে রেডিও কোয়ারেন্টাইন শুরু করেন। এটি একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন যেখানে অনলাইন প্রোগ্রামিং–এর মাধ্যমে বিবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেমন বাচ্চাদের জন্য একটি শো, গল্প বলার আসর, গানের আসর এবং সাক্ষাৎকার ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সামাজিক ধারাবিবরণী। তিনি জানিয়েছেন “অনেক মাস ধরে সিটিজেনস এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (ক্যা) কে ঘিরে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা এবং এটি মানুষকে কিভাবে প্রভাবিত করবে সেই নিয়ে করা অনেক কাজ হঠাৎ থেমে যায়। খুব অদ্ভুত লাগছিল।”
দর্শনা কলকাতার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জুরিডিক্যাল সায়েন্সজ-এ শিক্ষকতা করেন এবং স্বীকার করেছেন যে এই উদ্যোগের মূল কারণ ছিল “একে অপরের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা।”
তার এবং অন্যদের ওপর এর প্রভাবের বিষয়ে তিনি জানান যে সেটা মাপা কঠিন কিন্তু সাথে এটাও জানান যে তার কাজিনের বন্ধু, যিনি একজন বিমান সেবিকা, তার সাথে যোগাযোগ করে বলেন যে তিনি একটি গান রেকর্ড করে তাকে পাঠাতে চাইছেন রেডিওতে বাজানোর উদ্দেশ্যে। জানিয়ে দেন “যদি ভাল হয় তবেই সম্প্রচার করো”। দেখা যায় যে গানটি তিনি ভালই গেয়েছেন এবং সেটি সম্প্রচার করা হয়। ধন্যবাদ জানানোর জন্য ফোন করে তিনি সঙ্গে এটাও জানান যে এর গুরুত্ব তার জীবনে কতটা। তিনি বলেন যে তিনি বিদেশে আটকা পড়েছেন এবং কলকাতায় তার বাবা একা রয়েছেন। এই গানের মাধ্যমে তিনি তার বাবার কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন।
কগওয়ার্কস
বেঙ্গালুরুর আন্নাস্বামি মুদালিয়ার হাসপাতালে কগওয়ার্কস শুরু করেছিলেন নিউরো সাইকিয়াট্রিস্ট জ্বালা নারায়ণন। অন্যান্য মনোবিদ এবং স্বেচ্ছাসেবীদের পাশাপাশি এর তত্বাবধানে রয়েছেন সাইকোলগিস্ট প্রিয়াঙ্কা কুপ্পুস্বামী। এখানে আলঝাইমার্স আর ডিমেনশিয়ার মতো বিভিন্ন ধরনের স্নায়বিক ব্যাধিতে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সপ্তাহে দুবার তিন ঘণ্টার সেশনের আয়োজন করা হয় যার মধ্যে রয়েছে আর্ট আর মুভমেন্ট থেরাপির ব্যবস্থা। কাঠামো আর কর্মসূচির ফলে এখানে একটি ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায় স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে। এতে থেরাপিস্টদের প্রভাব এবং হস্তক্ষেপ প্রায় নগণ্য।
এটি এমন একটি জায়গা যেখানে এসে বয়স্করা তাদের জীবন আর সমস্যা নিয়ে এমন মানুষের সাথে আলোচনা করতে পারেন যারা সেই সমস্যা বা পরিস্থিতির বিষয়ে বোঝার ক্ষমতা রাখেন। গ্রুপের মাধ্যমে অন্যদের সাথে গড়ে ওঠা এই যোগাযোগ তাদের ভাল থাকার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ডিমেশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনে বিচ্ছিন্নতা আর একাকীত্ব এমনিতেই বেশি। “তারা নাচ করেন, গেমস খেলেন, নিজের কথা লিখে রাখার বিষয়ে জানান আর মাঝেমধ্যে স্মৃতি লোপ পাওয়া নিয়ে হাসিঠাট্টাও করেন,” জানালেন প্রিয়াঙ্কা।
লকডাউনের ফলে কগওয়ার্কস-এ যেতে পারছেন না - এটা সদস্যদের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে আসা পরিবর্তনগুলি থেরাপিস্টদের চোখে পড়েছে। যেমন, কোনও এক্টিভিটিতে যোগ দিতে না চাওয়া, সামাজিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া এবং বাড়িতে কম কথা বলা। পরিচর্যাকারীরা জানিয়েছেন যে সদস্যরা তাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে কগওয়ার্কস-এ যেতে হবে। তারা অন্য সদস্যদের বিষয়ে খোঁজখবর-ও নিচ্ছেন। কিছু পরিচর্যাকারীদের পক্ষে তাদের অস্থিরতাকে সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
থেরাপিস্টরা এখন এক ঘণ্টার একটি অনলাইন সেশন তৈরি করছেন যাতে এমন এক্টিভিটি থাকবে যা সদস্যরা করতে পারবেন। এটা নিয়মিত সেশনের পরিবর্তে তৈরি করা হচ্ছে না। এই সময়টুকু পার করতে তাদের সাহায্য করার জন্যই কেবলমাত্র এর আয়োজন করা হচ্ছে।
কমিউনিটি এবং স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব
সামাজিক সংযোগের গুরুত্ব যথাযথভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে । ৩,০৯,০০০ জন ব্যক্তির উপর করা একটি গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে মজবুত সম্পর্কগুলি আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে ৫০% বাড়িয়ে তোলে। অন্যদিকে এই সংযোগগুলির অনুপস্থিতি এমন হারে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে যার তুলনা দিনে ১৫টি সিগারেট পানের সাথে করা চলে।
নাটক থেরাপির বিশেষজ্ঞ কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট মৈত্রী গোপালকৃষ্ণ জানিয়েছেন যে এই মুহুর্তে তিনি লকডাউনের মোকাবেলা কীভাবে করা উচিত সে বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন না। এর পরিবর্তে তিনি মন দিয়ে শুনছেন তার ক্লায়েন্টদের জীবনে ঘটা পরিবর্তনগুলির বিষয়ে - প্রতিবেশীকে সাহায্য করে তারা কীভাবে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলছেন, বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছেন, মুখোমুখি দেখা করা সম্ভব নয় তাই এর বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন এবং যাদের সম্বলহীন অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের জন্য ত্রাণ যোগাড় করার কাজে লেগে পড়ার বিষয়ে।
এই ধরনের কাজের প্রেক্ষাপটে সম্প্রদায়ের ভূমিকার বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে মৈত্রী জানান "এদের মধ্যে এমনও অনেকে রয়েছেন যারা এই প্রথমবার এমন কিছু করছেন। যারা এর আগে কোন ধরনের সামাজিক কর্মে যোগ দেননি।"
একটি চাহিদা পূরণ করা
মুম্বাইয়ের থেরপিষ্ট অপর্ণা মেনন রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রচলিত অভ্যন্তরীণ সামাজিক আদর্শের বিষয়ে জানালেন "সমাজ আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে যে সিঙ্গল বা কোন সম্পর্কে না থাকাটা একেবারেই কাম্য নয়।" রোমান্টিক সঙ্গীই যে আমাদের জীবনে প্রেমের প্রাথমিক স্রোত সেই ভাবনার থেকে জন্মায় এমন একটি অনুভূতি যা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় যে একা থাকাটা যে একটি অসম্পূর্ণ অবস্থা যা বদলে ফেলা উচিত। এই মানসিকতার বিকল্প হিসেবে অপর্ণা এই ধারণাটি তুলে ধরেছেন: “চাহিদা পূরণ হওয়ার ক্ষেত্রে যতক্ষণ সেই চাহিদা পূরণ হয়ে চলেছে ততক্ষণ আপনার মস্তিষ্ক জানতে চাইবে না যে এর উত্সটি কী।” এর মানে দাড়াচ্ছে যে নিজেকে ভালোবাসা, কাছের বন্ধুদের থেকে পাওয়া উষ্ণতা আর সুরক্ষার অনুভূতি এবং নিজের বেছে নেওয়া সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে থাকার ফলেও আমরা একই ধরনের পরিপূর্ণতা অনুভব করতে সক্ষম।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রদায় বলতে আমরা যা বুঝি সেই ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এখন আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বাধা-নিষেধ মেনে চলতে হচ্ছে এবং নিজেদের জন্য সেখানে আমরা বিকল্প তৈরি করছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই আপাতত এই বিকল্পগুলিকে টিকা আবিষ্কার না হওয়া অবধি শূন্যস্থান পূরণ করার উপায় হিসাবে দেখছেন।
এই বিকল্পগুলির কার্যকারিতা বিবেচনা করে দেখা আমাদের পক্ষে উপকারী হতে পারে। এর অর্থ হতে পারে আমরা বদলে যাওয়া পৃথিবীতে মজবুত সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছি এবং পারব।
নতুন করে তৈরি হওয়া জায়গাগুলির থেকে আমরা কি সম্প্রদায়ের সেই অনুভূতির পেতে পারি যেমনটা মহামারীর আগে ছিল? জেনে নেওয়ার একটিমাত্র উপায় রয়েছে।