স্বাভাবিককে নতুন করে পরিভাষিত করা – বৈশ্বিক মহামারীর সময় আশাবাদী হওয়ার মানে

স্বাভাবিককে নতুন করে পরিভাষিত করা – বৈশ্বিক মহামারীর সময় আশাবাদী হওয়ার মানে

অতীতে ঘটা ভাল মুহূর্তগুলিকে মনে করা, কৌশলগত দক্ষতা ব্যবহার করা, অনলাইন কমিনিউটি খুঁজে নেওয়া – মানুষ কীভাবে এই সময় আশাবাদী থাকছেন
Published on

একজন কমবয়সী ক্লায়ন্ট তার সেশন শুরু করল পরিবার পরিকল্পনাকে ঘিরে তার চিন্তা দিয়ে। আমরা বিভিন্ন কগ্নিটিভ আর সোমাটিক সেশন নিয়ে কাজ করা শুরু করার আগে সে তার আশঙ্কাগুলির কথা বলল। আমরা যত এগিয়ে যেতে থাকলাম, আশঙ্কাগুলির বদলে সে খুঁজে পেল নতুন উদ্যম।

একজন কর্মরত পেশাদার ব্যক্তি, যার দীর্ঘমেয়াদী উদ্বেগ রয়েছে, তিনি সিঙ্গাপুরে নতুন কাজ পেয়েছেন এবং তিনি সেই কাজ শুরু করার জন্য অধীর হয়ে রয়েছেন। কন্ট্রাক্ট সই করা হয়ে গিয়েছে, ভিসা চলে এসেছে এবং এখন তিনি শুধু অপেক্ষায় দিন গুনছেন। পরিবর্তনকে ঘিরে উদ্বেগ রয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি এবং জীবন লক্ষ্য নির্ধারিত করা হয়েছে।

সদ্য স্নাতক হওয়া একজন, যে এক সময় পরীক্ষা সংক্রান্ত উদ্বেগ এবং সমকক্ষিদের সঙ্গে করা মারাত্মক তুলনার চাপে জর্জরিত ছিল, সে অনেক উন্নতি করেছে। আমাদের কথাবার্তা এখন নতুন আকাঙ্ক্ষা, গ্রীষ্ম প্রায় এসে পড়ার উত্তেজনা এবং কর্মজীবন শুরু করার আশঙ্কাকে ঘিরে চলে।

বৈশ্বিক মহামারীর এই সময়ে পুরানো ক্লায়েন্টদের সাথে আমার সেশনগুলি এখন অন্য রূপ ধারণ করেছে। আগে অনেক অমিল ছিল হয়তো কিন্তু এখন সবার গলায় একই সুর – জীবিকা আর অনিশ্চিয়তাকে ঘিরে আশঙ্কা। যারা নতুন প্রাণকে পৃথিবীতে আনার কথা ভাবছেন তাদের মধ্যে ক্লিনিক এবং হাসপাতালে যাওয়া নিয়ে ভয় দেখা দিয়েছে। এই সীমাহীন অনিশ্চিয়তা সদ্য স্নাতকের গোঁড়ার দিকের উত্তেজনাকে গ্রাস করেছে। পেশাদার ব্যক্তির কর্মজীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসা সত্ত্বেও তার মধ্যে হতাশার ভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

স্কুল-কলেজ বন্ধ। ব্যবসা করার পথ খোলা নেই। কর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। এই প্রথমবার এইভাবে সহস্র বিয়ে পিছিয়ে দিতে হয়েছে। যে পৃথিবী ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলছিল, সেটা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এই দেশ এখন লকডাউনে রয়েছে।

এত বিভ্রান্তি আর অনিশ্চিয়তার মধ্যে খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে যে আমরা স্বাভাবিকের নতুন পরিভাষা ঠিক করি।

এখন আমাদের সেশনে আমরা লভ্য এবং অকল্পনীয় দুটো বিকল্পের কথা আলোচনা করি। যে কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব যখন আমরা বুঝে যাই যে জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা – তা সে যতই নিশ্চয়তার সঙ্গে করা হোক না কেন – এখনো বদলানো সম্ভব, সময়সীমা পালটানো সম্ভব, এবং/অথবা পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

আমরা পিঙ্ক স্লিপের সাথে জড়িয়ে থাকা কলঙ্কের মোকাবিলা করি এই ভাবনা দিয়ে এবং এই বোধ নিয়ে যে ভেবেচিন্তে নেওয়া ঝুঁকি – যেমন একটি স্টার্ট আপে যোগ দেওয়ার নির্ণয় (যেখানে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি) আসলে সম্মানের ব্যাপার। রূপান্তর ঘটে যখন আপনাকে বাধ্য হয়ে পরিবর্তনের পথ বেছে নিয়ে হয়। এই ধরনের পরিস্থিতিগুলি সামাল দেওয়ার জন্য কৌশলগত দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে যা আপনাকে আপনার সুযোগগুলি কাজে লাগাতে এবং আপনার ক্যারিয়ারের পথ নতুন করে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়।

যে পেশাদার ব্যক্তিরা নতুন কাজের সম্ভাবনাকে একসাথে জুড়ে দেখতে পারছেন না, তাদের সাথে বসে আমরা বিকল্প আর সময়সীমার বিষয়গুলি পুনর্বিবেচনা করি। সেই সেশনগুলিতে প্রথমে দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে (রূপক এবং আক্ষরিক অর্থে) প্রাথমিক ক্লান্তি কাটানোর ওপর জোর দেওয়া হয়, অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করা হয়, আনন্দের মুহূর্তগুলিকে চিহ্নিত করা হয়- ব্যক্তিগত উপলব্ধি, কৃতিত্ব, কন্ট্রাক্ট জেতা, প্রশংসা পাওয়া (কখনো প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে), সমস্যা কাটিয়ে ওঠা – এবং একটি ‘পসিটিভ স্ক্র্যাপবুক’ তৈরি করা হয় যা তাদের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। তাদের হাসি তখন তাদের চোখে ধরা পড়ে, এবং ভিডিও সেশনেও দেখা যায়, যখন তারা আবার পিঠ সোজা করে উঠে বসেন।

থেরাপিস্ট হিসেবে আমি জানি যে ক্লায়েন্ট যদি তার ক্লান্তি আর আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারে তাহলে তার টিকে থাকার প্রবণতা আবার জেগে উঠবে আর তখন আমরা অনিশ্চিত পরিস্থিতির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা শুরু করতে পারব।

ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে যখন ক্লায়েন্টরা আমার কাছে আসেন তখন বোঝাই যায় যে ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তা ছাড়াও তারা সবাই সামগ্রিকভাবে একাকীত্বে ভুগছেন। তাদের মনে হয় যেন এই বৈশ্বিক মহামারীর সময় তাদের পাশে কেউ নেই। সামাজিক দূরত্বের মানেই যে বিচ্ছিন্নতা আর একাকীত্ব, এমন কিন্তু নয়। আমাদের অনলাইন সামাজিক জীবনকেও ততটাই জীবন্ত করে তোলা যেতে পারে ভিডিও কনফারেন্সিং আর ভার্চুয়াল গেমসের মাধ্যমে। এই বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরী যে এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর সব মানুষের জীবনেই সামগ্রিকভাবে একই অনিশ্চিয়তা রয়েছে।

স্বস্তি তখনই আসে যখন আমাদের অচেতন মন এটা বুঝতে পারে যে কেবলমাত্র আমরাই নিজেদের ভয়ের সাথে লড়াই করছি না। এই পরিস্থিতিতে আমরা একা নই এবং এইধরনের অনুভূতি আমাদের একার নয়। এই প্রথমবার আমরা সবাই মিলে স্বাভাবিকের একটি নতুন পরিভাষা, জীবনের এক নতুন ধারা খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি।

কিছুদিন আগে আমি নিজেই জানাই যে আমি আমার প্রতিবেশীদের সাথে জুমে তাম্বোলা খেলে খুব আনন্দ পেয়েছি। আমরা ছয়জন আশেপাশে থাকি আর সবাই মিলে ঠিক করা হয় যে এই একাকীত্বের সাথে আমরা লড়াই করব স্বাভাবিককে নতুন করে দেখে। আমরা ওয়াইন খেতে খেতে একে অপরের সাথে হাসিঠাট্টা করছিলাম আর আমাদের সবার বাড়িতে আমাদের হাসির শব্দের প্রতিধ্বনি একসাথে শোনা যাচ্ছিল – নতুন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া পুরানো বন্ধুত্ব।

একটি সেশনের শেষে আমার এক ক্লায়েন্টের পাঠানো মেসেজের আকারে আমি সুখ এবং পূর্ণতা অনুভব করি। মেসেজে লেখা ছিল - “আপনি কি হাউজ পার্টির বিষয়ে জানেন? এটা একটা নতুন অ্যাপ যেটা আমার বন্ধুরা আমাকে পাঠিয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা ভিডিও কনফারেন্সিং করার পাশাপাশি গেমসও খেলতে পারবো। আমার বন্ধুদের সাথে আমার আজ রাতে ওখানে দেখা হবে!” সে আরও জানায় যে ওই অ্যাপ দিয়ে একটা হাউজ পার্টির থেকে আরেকটিতে যাওয়া যায়। মেসেজটা সংক্ষিপ্ত ছিল কিন্তু সেটা আমাকে জানিয়ে দিলো যে স্বাভাবিকের এই নতুন পরিভাষা ততটাই প্রাণবন্ত আর প্রগতিশীল।

জয়া একজন কাউন্সেলর আর সাইকোথেরাপিস্ট এবং তার ইন্টিগ্রাল সোমাটিক সাইকোলজিতে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org