প্রিয়জনের আত্মহত্যাজনিত শোকের নানা দিক

প্রিয়জনের আত্মহত্যাজনিত শোকের নানা দিক

Published on

আত্মত্যাজনিত দুঃখের অভিজ্ঞতা আমাদের মনে রহস্যের আড়ালে এক অনন্য দৃষ্টিকোণের জন্ম দেয়। একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটার পর 'কেন' আত্মহত্যা ঘটল সে সম্পর্কে আমরা গভীর অনুসন্ধান করি এবং আমাদের জীবনে এই 'কেন'-র নতুন ব্যাখ্যা আমরা আবিষ্কার করি।– অ্যালান উলফেল্ট তাঁর অ্যান্ডারস্ট্যান্ডিং ইওর সুইসাইড গ্রিফ-এ একথা বলেছেন।

আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু খুবই রহস্যজনক, গোলমেলে এবং বিভ্রান্তকর। হিংস্রতা, কারোর হঠাৎ মৃত্যু ঘটা প্রভৃতি ঘটনাগুলো আমাদের আত্মরক্ষার প্রত্যেকটি প্রথাসিদ্ধ আচরণ বা নিয়মকে লঙ্ঘন করে। প্রিয়জনের আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুশোকের মোকাবিলা আমাদের কাছে এক ভীষণ চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠলেও, ঘটনাটি পারিপার্শ্বিকগতভাবে তেমন অগ্রাধিকার বা প্রাধান্য পায় না।

আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুশোক (এর সঙ্গে রয়েছে- মানুষকে খুন করা, কোনও আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে মৃত্যুর ঘটনাও) মানুষের মনে একপ্রকার ক্ষতের জন্ম দেয়। আমার জীবনে প্রিয়জনের আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুশোক দেখা দিয়েছিল আমার স্বামীর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে, যা ছিল আমার কাছে আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত, বেদনাদায়ক এবং স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো একটি ঘটনা। আমি আমার জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে শুধু শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম তা নয়, মানসিকভাবেও ভীষণ আঘাত লেগেছিল আমার। আর এতটাই আঘাত লেগেছিল যে আত্মহত্যার মতো ঘটনার রহস্য, তার পিছনে একজন মানুষের মানসিক অবস্থান, অভিপ্রায় ঠিক কেমন হতে পারে প্রভৃতি বিষয়গুলো উদ্‌ঘাটন করার চেষ্টাও করেছিলাম।

আত্মহত্যার মতো একটা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলা খুব সহজ নয়। খোলাখুলি আত্মহত্যার ঘটনা ব্যাখ্যা বা বর্ণণার ক্ষেত্রে মানুষের মনে একটা কলঙ্ক ও লজ্জাবোধ দেখা দেয়। যার ফলে আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে মানুষ তেমন মুখ খোলে না অর্থাৎ চুপ করে থাকে এবং বিষয়টিকে গোপন করতে চায়। আত্মহত্যাকে সাধারণত মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে ধরা হয় এবং এর জন্য মানুষের আচরণগত সমস্যা বা সীমাবদ্ধতাকেই দায়ী করা হয়। আত্মহত্যাকে জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে বিচার করা হয় না এবং এর সামাজিক প্রভাবকেও স্বীকার করা হয় না।

আত্মহত্যার ঘটনার প্রকাশ, তার প্রভাব সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক গতানুগতিক ধারণার জন্য এই আত্মঘাতী অভিযানের শোক একপ্রকার কৃত্তিমতার আবর্তে ঘুরপাক খায়। তাই এই ঘটনার ফলে শোকগ্রস্ত একজন মানুষ সমাজে নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুই একমাত্র মৃত্যু যেখানে মৃত্যুর আসল কারণকে স্বীকার করা যায় না, বা তা লুকিয়ে রাখতে হয় বা মৃত্যুর এমন একটা কারণ তুলে ধরা হয় যা সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ আমাদের সমাজে, সংস্কৃতিতে এবং ধর্মে আত্মহত্যাকে একপ্রকার নিষিদ্ধ ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়। আত্মহত্যার মতো ঘটনার পর আমরা দিশাহারাভাবে লজ্জা বোধ করি এবং অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। আমাদের মধ্যে যেন আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর উদ্দেশ্যকে নতুন করে খোঁজার একটা তাগিদ গড়ে ওঠে এবং এধরনের মৃত্যুকে  স্বীকার্য করে তোলার খাতিরে আমরা নতুন কারণের রচনা করি, মৃত ব্যক্তি, আমাদের পরিবার এবং আমাদের নিজেদের জন্য।

আত্মহত্যায় মৃত মানুষের পরিবারের জীবিত সদস্যদের মধ্যে একপ্রকার অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায় এবং অধিকাংশ জীবিত সদস্যের মনে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন বারবার উঠে আসে - কেন আমরা বা আমি আত্মহত্যার ঘটনা যে ঘটতে পারে তা আঁচ করতে পারলাম না এবং মৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারলাম না? আমরা মৃত ব্যক্তির কাজকর্ম এবং তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তের জন্য নিজেদের দায়ী মনে করি। তাই আমরা সামঞ্জস্যহীনভাবে নিজেদের শোক নিয়ে নানা কথা ভাবতে থাকি; আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে কেন একজন মানুষ তার জীবন শেষ করে দিল বা তার আত্মহত্যা করার পিছনে কী উদ্দেশ্য ছিল তা খোঁজার চেষ্টা করি।

এছাড়া, যে করেই হোক এই ঘটনাকে অর্থবহ করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেদের মনস্তত্ত্বের গভীর বিশ্লেষণ করি। আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর কারণ এবং তার প্রেক্ষাপটকে নিজেদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করার জন্য আমাদের মনে শোকের পাশাপাশি এই জটিল ধাঁধা সমানে ঘুরপাক খেতে থাকে। অনেকটা সময় ধরে এমনটা করার পরে কোনও এক সময় সত্যিকে উপলব্ধি করতে পারি যে আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন আমরা কখনোই একটা বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারব না যে আমাদের প্রিয়জন কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। নিজেদের সারিয়ে তোলার জন্য, আমরা, যাদের প্রিয়জন আত্মহত্যা করেছেন, তাদের এই অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি হতে হবে এবং তাকে মেনে নিতে হবে।  

''একটা আত্মহত্যার ঘটনা আপনার নিজের জীবনের গতি-প্রকৃতি, অন্যদের সঙ্গে  আপনার সম্পর্ক এবং আপনার নিজস্ব পৃথিবীটাকে একেবারে তছনছ করে দিতে  পারে''- ডঃ জন জর্ডন তাঁর 'আফটার সুইসাইড লস: কোপিং উইথ ইওর গ্রিফ' বইতে একথা লিখেছেন। প্রিয়জন সম্পর্কে আমাদের মনের অনুভূতিগুলোকে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয় আত্মহত্যার ঘটনা। সেই সঙ্গে কাছের মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের বাস্তবতাগুলোর অস্তিত্ব হারিয়ে যায়। সহসাই আমরা রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি হই এবং আমরা নিজেদের বারবার জিজ্ঞাসা করি যে আমরা কি সত্যিই আদৌ আমাদের প্রিয়জনকে ভালো করে চিনতাম বা জানতাম? অথবা আমরা কি এতদিন অপরিচিত কোনও ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিলাম?

আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে একজন মানুষ মারা যাওয়ার পরে তার চারপাশে থাকা জীবিত মানুষজনকে বারবার অনেক কিছু বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়। প্রথমত, আত্মহত্যার মতো রহস্যজনক মৃত্যুর পিছনে কী অর্থ থাকতে পারে তা জানা আমাদের কাছে জরুরি হয়ে ওঠে। আত্মহত্যাজনিত রহস্যের কিনারা করার চেষ্টা করি আমরা, এই মৃত্যুর পিছনে আমরা আমাদের দায়িত্ব ও ভূমিকাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। সেই সঙ্গে আমরা নিজেদের উপর রাগ করি, নিজেদের অপরাধী বলে ভাবি এবং নিজেদেরকে দোষারোপ করি। এভাবে এই অদম্য অনুভূতিগুলোর ঢেউ-এ আমরা নিজেকে ভাসিয়ে দিই। আসলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে আত্মহত্যা করা যে মহা পাপ ও অপরাধ- সেই বোধটাই আমাদের এসব অদম্য অনুভূতিগুলোকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলে ও আমাদের মধ্যে সেগুলোকে একেবারে গেঁথে দেয়।

''আত্মহত্যা হল একপ্রকার জটিল ধাঁধা''- এমনই মত জন জর্ডন –এর। আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু অন্যান্য মৃত্যুর ঘটনাকে এভাবে বিবেচনা করা হয় না। আত্মহত্যার ঘটনায় প্রিয়জনকে হারানো মানুষ এমন একটা দ্বিধা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যেখানে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে তারা সেই পরিস্থিতি থেকে পালানোর পথ পায় না। একদিকে আমার মনে হতো যে আমার স্বামী তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আত্মহননের মাধ্যমে সে যেন আমাকে ত্যাগ করেছে। এই ভেবে আমার রাগ হতো।  তেমনই অন্যদিকে এই দুঃখজনক ঘটনা আমি প্রতিরোধ করতে পারিনি বলে নিজের উপরেও আমার খুব রাগ ছিল। মানুষ আত্মহত্যার মতো একটা বিষয় কেন বেছে নেয় সেই প্রশ্নের কোনও জবাব এখনো মেলেনি। আত্মহত্যা কি স্বেচ্ছাকৃত? এটা কি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির দ্বারা প্ররোচিত? নাকি মানসিক চাপ, অনিয়ন্ত্রিত মানসিক সমস্যা এবং পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ তার জীবন নিজে হাতে শেষ করে দেয়?

আত্মহত্যার ঘটনার পরে অধিকাংশ মানুষ যখন আমাদের স্বান্ত্বনা দেয় তখন তারা আমাদের একটাই প্রশ্ন করে কেন এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। যখন আমার জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছিল তখন আমি দেখলাম যে আমি আমার স্বামীর গুণগান করছি, ওর পেশাগত এবং ব্যক্তিগত বিশেষত্বের কথা বলছি। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি যে তত সহজ নয় এবং আত্মহত্যার ব্যাখ্যা যে এককথায় করা যায় না তা আমার জানা ছিল না বলে আমি আমাদের দুজনকেই আত্মহত্যার দায় থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিলাম। অন্যান্য মৃত্যুর ক্ষেত্রেও কি এমনই ঘটনা ঘটে? কিছু মানুষ আন্তরিকতার সঙ্গে সমবেদনা জানিয়েছিল। তবে সামগ্রিকভাবে আমি সমানুভূতি ও সমবেদনার ঘাটতি অনুভব করেছিলাম। আমার শোকের কারণ যদি ‘স্বাভিবিক’ অথচ আচমকা মৃত্যু হতো তাহলে আমার ধারনা যে মানুষের প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি সহযোগিতাপূর্ণ হতো।

আত্মহত্যার দ্বারা যে সামাজিক সম্পর্কগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সে বিষয়টা আমার কাছে আদৌ আশ্চর্যজনক বলে মনে হয় না। আত্মহত্যার কারণে প্রিয়জন হারানো মানুষের মনে একটাই ভয় থাকে যে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের লোকেরা এই ঘটনার জন্য কী বলবে বা তারা কীভাবে ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করবে। এবং অধিকাংশ মানুষ এই বিষয়ে অনিশ্চিত এবং অজ্ঞ যে আত্মহত্যার দ্বারা কারোর প্রিয়জন মারা গেলে তার সামনে ঠিক কীভাবে শোক প্রকাশ করা উচিত। অনিশ্চিয়তার কারণ হল অস্বস্তি, এবং অজ্ঞতা কারণ হল আত্মহত্যাকে অবমাননা এবং প্রত্যাখ্যান করা। এই দোটানা ও অস্পষ্টতার জন্যই প্রিয়জনের মৃত্যুর পর শোকগ্রস্ত মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।

জর্ডানের মতে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু একটা পরিবারের মধ্যে যোগাযোগের আদান- প্রদানগত সমস্যার সৃষ্টি করে। মৃত্যুর কারণ তারা কতটা খোলাখুলি ভাবে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক, সেই বিষয় নিয়ে অধিকাংশ পরিবার মানসিক দোটানায় ভোগেন। আত্মহত্যার পিছনে কী কারণ ছিল তা প্রকাশ করা হবে কী না, তাই নিয়ে পরিবারের মধ্যে মতের অমিল থেকে ভাঙন দেখা দেয়। তবে অধিকাংশ পরিবারই আত্মহত্যার ঘটনাকে গোপন রাখার পক্ষে থাকে এবং এর প্রভাব পরিবারের সদস্যদের দুর্ঘটনাটির সঙ্গে আপস করে দুঃখ কাটিয়ে উঠার উপর পরে। আত্মহত্যার পরিণাম হিসেবে পরিবারগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, ঘটনার বর্ণনা একই ভাবে করতে না পারার কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ হারিয়ে যায়, এবং একাধারে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ও পারস্পরিক মন কষাকষি শুরু হয়। এসব জটিলতার ফলেই প্রাথমিকভাবে পরিবারের সদস্যদের মনে আঘাত লাগে এবং প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকবিহ্বল এসব মানুষজন তাদের জীবনের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে মূল্যবান সাহায্যটুকুও পায় না।       

ডঃ নন্দিনী মুরলী পেশাদারী ভাবে যোগাযোগ, লিঙ্গ এবং বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন সম্প্রতি নিজের প্রিয়জনকে আত্মহত্যায় হারানোর পর তিনি এম এস চেল্লামুথু ট্রাস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডেশনের সাথে হাত মিলিয়ে স্পিক নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেন, যার মূল উদ্দেশ্য হল আত্মহত্যা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org