আত্মহত্যার বিষয়ে গণমাধ্যমে দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রচার - একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
বিগত দু' বছর ধরে আত্মহত্যা প্রতিরোধ কর্মী হিসেবে অসংখ্য ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। দেখেছি আত্মহত্যা ও সেই সংক্রান্ত বিষয়ে সাধারণ মানুষ কতটা অসংবেদনশীল। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি ঘটনা আমাকে নাড়া দিয়ে গেছে।
কিছুদিন আগে আমি একটি বহুল প্রচলিত রেডিও স্টেশনে উইমেনস ডে বিষয়ক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বক্তব্যের পর যে রেডিও জকি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন আমাকে অনেক সাধুবাদ জানান এবং আমার কাজে তিনি অনুপ্রাণিত তাও বলেন। তিনি এর সঙ্গে এও বলেন বিশেষকরে এইজন্যে যেহেতু “আমার স্বামী আত্মহত্যা করেছেন।”
এখানেই আমার আপত্তি। কারণ গণ মাধ্যমে যারা কর্মরত তারা আত্মহত্যা বিষয়ে একেবারেই সংবেদনশীল নন এবং বিষয়টিকে জলবত তরল করতে অভ্যস্থ। প্রথমত সেই রেডিও জকি আত্মহত্যা জনিত আমার ব্যক্তিগত ক্ষতির বিষয় বিনা অনুমতিতে গণ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, যেখানে আমাদের আলোচ্য বিষয়ে তার কোনো প্রয়োজন ছিল না, আমিও সেচ্ছায় এই বিষয়টি আমার বক্তব্যে উল্লেখ করিনি। এভাবে আলটপকা বিষয়টির অবতারণা করে তিনি হয়তো তার অনুষ্ঠানটিতে কিছুটা উত্তেজনা আমদানি করতে পেরেছেন, সস্তা জনপ্রিয়তার লক্ষ্যে। দ্বিতীয়ত কমিটেড সুইসাইড বা আত্মহত্যা করেছেন এই শব্দবন্ধটিতে যথেষ্ট পরিমাণে অপরাধের গন্ধ লেগে থাকে, যা বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন ও কৌতূহলের জন্ম দেয়। তিনি হয়তো তর্কের খাতিরে বলতে পারেন যে তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না এই মন্তব্যের পিছনে, কিন্তু বিষয়টির অভিঘাত আমার জীবনে কি তা অনেকেই সহজে অনুমান করতে পারবেন না।
আত্মহত্যা একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়। আত্মহনন প্রতিহত করা বা রোধ করা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। যারা স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করেন, যারা আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখেন, গণমাধ্যম, সরকার, সামাজিক সংস্থা, ধর্মগুরু, পরিবার এবং সমাজ সংস্কারক সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে। আমরা যখন মাদুরাইয়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংক্রান্ত সংগঠন স্পীক তৈরি করি তখন আত্মহত্যার বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা কি হওয়া উচিত তা নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করি। সেইদিন শহরের মাত্র দু'জন সাংবাদিক যোগদান করেন।
যারা আত্মহত্যা করতে গিয়ে অসফল হন বা যাদের পরিবারে কেউ আত্মহত্যা করেছেন তাদের সামাজিক ও মানসিক অবস্থান খুবই জটিল হয়। গোটা বিশ্বে প্রায় আট লক্ষ মানুষ প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন, আর প্রতিটি আত্মহত্যার সঙ্গে পারিবারিক বা অন্য সূত্রে অন্তত ছয় জন এই ঘটনার অভিঘাতে মানসিক দিক দিয়ে অবসন্ন হয়ে যান। এখানেই গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম খুব সহজে এই বিষয়ে ইতিবাচক জনমত তৈরি করতে পারে।
এখানে কয়েকটি নীতিগত ভাবে আদর্শ পদ্ধতি আলোচনা করছি যা আমাদের বুঝতে সহায়তা করবে কিভাবে গণমাধ্যম দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করতে পারে আত্মহত্যার বিষয়ে।
আত্মহত্যার যথাযথ ও দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশন করা - আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক আঘাত, লজ্জা, গোপনীয়তা এবং নিরবতা জড়িয়ে রয়েছে। আত্মহত্যার খবর করতে গিয়ে তাকে অহেতুক উত্তেজক, বা খুব সাধারণ ঘটনা অথবা সব সমস্যার এক মাত্র সমাধান হিসেবে তুলে ধরা আর যাই হোক বিবেকের প্রমান বলে মনে হয় না। এটি একেবারে ভ্রান্ত ধারণা।
সাধারণ মানুষকে আত্মহত্যার বিষয়ে শিক্ষিত করা - শারীরবৃত্তিয়, মানসিক, সামাজিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন কারণ এর পিছনে লুকিয়ে থাকে। নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখানে চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু সংবাদমাধ্যম কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে নিয়ে খবর করে দেয়। যেমন পরীক্ষায় পাশ করতে না পারার জন্য আত্মহত্যা, ব্যক্তিগত সম্পর্কে টানা পোড়েনের কারণে আত্মহত্যা ইত্যাদি। বাস্তবে এগুলি কিন্তু কোনো সঠিক কারণ নয়।
অযথা আতঙ্ক তৈরি না করে যথাযথ্য তথ্য পরিবেশন করা প্রয়োজন - নেতিবাচক তথ্য যথা আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি বা রকেটের গতিতে বাড়ছে ইত্যাদি যা নিতান্তই অবিবেচকের মতো।
শব্দচয়ন ভেবে চিন্তে করা দরকার- আত্মহত্যা অপরাধ বা পাপ কোনোটাই না। এটি কোনো মতেই ভীতুদের নায়কোচিত পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হতে পারে না। এই যুক্তিকে হাতিয়ার করেই গণমাধ্যম যারা আত্মহত্যা করেছেন, যারা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন এবং আত্মহন্তার পরিবার পরিজনদের মহান, নিকৃষ্ট বা ভীতু কোনোটাই আখ্যা দিতে পারে না।
খবরের কাগজের প্রথম পাতায়, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং শিরোনামে আত্মহত্যা শব্দটির ব্যবহার এড়াতে পারলে ভালো - এখানে বুঝতে হবে কোনটি খবর আর কোনটি সস্তা উত্তেজক তথ্য। যদি কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি বা সেলেব্রিটির আত্মহত্যার খবর এভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয় তা আবার আত্মহত্যাপ্রবন মানুষকে উৎসাহিত করতে পারে। তাই নিরপেক্ষ শিরোনাম লিখতে হবে এবং পাঠকের কৌতুহল নিরসনের নামে অহেতুক উত্তেজক ও দায়িত্বজ্ঞান রহিত খবর না করাই উচিত।
ভাষা প্রয়োগে সংবেদনশীলতা - ভাষা ভাবনার প্রতিবিম্ব এবং সামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবিও বটে। তাই ভাষা ব্যবহারে যথেষ্ট যত্নবান হতে হবে। ইংরেজি ভাষায় কমিটেড সুইসাইড কথাটি কিছু অপরাধমূলক কর্মের দিকে ইঙ্গিত করে। ঠিক তেমনি "আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা", "আত্মহত্যা মহামারীর আকার ধারণ করেছে", "রাজনৈতিক আত্মহত্যা" প্রভৃতি শব্দবন্ধের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। যা এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। তাই একটু অন্যভাবে লেখা, যেমন আত্মহত্যার মহামারী কে আত্মহত্যার প্রবনতা বৃদ্ধি লেখা যেতেই পারে। এভাবেই সঠিক শব্দ চয়ন নেতিবাচক বাক্য গঠনকে সরিয়ে রাখতে পারলে সংবাদমাধ্যম এই বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।
আত্মহত্যার অযথা বিস্তারিত বিবরণ - কিভাবে আত্মহত্যা করলেন, কতটা পরিকল্পনা করে তিনি তা করলেন এবং অবশ্যই কেন করলেন তার গাল গল্প শুধু বিরক্তিকরই নয় মৃতের পরিবারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করে না এবং তাদেরকে যথেষ্ট বিব্রত করে। আত্মহত্যার পদ্ধতির বিস্তারিত ব্যখ্যা অন্য আত্মহত্যাপ্রবন মানুষদের উৎসাহিত করে। তাই এই ধরনের প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।
মৃতের বা তার পরিবারের এবং সুইসাইড নোটের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা অনুচিত - মৃতের পরিবার এমনিতেই ঘটনার অভিঘাতে মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে থাকেন। তারপর এই সব প্রকাশ তাদের সামাজিক সম্মান ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে লঙ্ঘন করে। যা অন্য অর্থে মৃতের প্রতিও অসম্মান প্রদর্শন করা। যদি নিতান্তই করতে হয় মৃতের পূর্বের কোনো ছবি প্রকাশ করা যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশিত হোক যা আত্মহননকারীর পরিবারকে সহায়তা করবে - কোথায় গেলে অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, কিভাবে কোথায় মানসিক সহযোগিতা মিলবে এই তথ্যগুলি প্রকাশিত হলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে যারা কাজ করছেন তাদের হাত শক্ত হয়। যাদের পরিবারে কেউ আত্মহত্যা করেছেন তারা কিভাবে সেই মানসিক বৈকল্য থেকে বেরিয়ে এসে জীবন নতুন ভাবে শুরু করতে পারবেন, কোথায় গেলে মনস্তাত্বিক সহায়তা পাবেন এগুলি যদি নিয়মিত প্রকাশিত হয় তাহলে সেই সব হতভাগ্য পরিজনেরা সত্যিই উপকৃত হবেন।
পরিজনদের অযথা বিরক্ত না করা উচিত - আত্মহত্যার পর পরিজনদের সাক্ষাতকার চেয়ে, টিভির জন্য বাইট চেয়ে বা ছবি তুলতে গিয়ে বিরক্ত করা অনুচিত। এটা ঠিক মৃতের পরিবারের বক্তব্য হয়তো সংবাদ পরিবেশন যথাযথ করে কিন্তু তা যদি হতভাগ্য পরিবারটির শান্তি ও ব্যক্তিগত পরিসরে অযথা অনুপ্রবেশ করে তখন রীতিমতো বিরক্তি উদ্রেক করে।
প্রতিরোধে জনমত গড়ে তুলতে ক্ষুদ্র বিষয় ছেড়ে বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ - জনস্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নিয়ে এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে জনমত গড়ে তুলতে সংবাদমাধ্যম দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান, এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত, মনোবিজ্ঞানীদের ব্যখ্যা ও বিভিন্ন রেখাচিত্র এই ইতিবাচক জনমত গঠনে যথেষ্ট সহায়তা করতে পারে। যা আত্মহত্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যে যারা কাজ করছেন তাদের সহায়তা করবে।
ইতিবাচক আশাবাদী খবর প্রকাশিত হোক - খবরের কাগজে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাঙ্কর স্টোরি, কিভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা গেছে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন, মৃতের পরিবার কিভাবে শূণ্যতাকে মুছে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এই ধরনের ইতিবাচক খবর ভীষন প্রয়োজন।
পরিশেষে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যাদের পরিবারে কেউ আত্মহত্যা করেছেন তা দূর থেকে অনুধাবন করার চেষ্টা না করে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারলে এই পথ চলা অনেক সহজ হবে।
ডাঃ নন্দিনী মুরলী পেশাদারী ভাবে যোগাযোগ, লিঙ্গ এবং বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন। সম্প্রতি নিজের প্রিয়জনকে আত্মহত্যায় হারানোর পর তিনি এম এস চেল্লামুথু ট্রাস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডেশনের সাথে হাত মিলিয়ে স্পিক নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেন, যার মূল উদ্দেশ্য হল আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা।