ঠিকমত বোঝা প্রয়োজন আত্মহত্যার কারণ কী?
সম্প্রতি ৩৫ বছর বয়সি এক গৃহবধূ ব্যাঙ্গালোর শহরে নিজের দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হন। কারণ খুজতে গিয়ে জানা যায়, বহুদিন ধরেই আর্থিক অনটনের জন্য তাঁর পরিবারে তীব্র অশান্তি চলছিল। স্বামীর হাতে বহুবার লাঞ্জিত হওয়ার পর অবশেষে তিনি দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হন। মহিলার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহিলা চিরকালই খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন এবং তাঁর কোনও বন্ধুবান্ধব ছিল না। এমনকী নিজের বাপের বাড়ির কারও সঙ্গে কোনও দুঃখের কথাও বলতে দ্বিধা বোধ করতেন। স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করার সুবাদে এই মহিলা আত্মঘাতী হওয়ার জন্য খুব সহজেই ওষুধ সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন এই পথ বাছলেন তিনি?
গভীর অনুসন্ধান করে জানা গিয়েছে যে, আত্মহত্যার পিছনে শুধুমাত্র একটি কারণ থাকে না। মানুষের ব্যক্তিত্ব, পরিবার, আত্মীয়তা ও পরিবেশের উপরেও নির্ভর করে মানসিক ভারসাম্য। কারণ একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে যায় ও মানুষের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে।
একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, ভারতে ১৫-২৯ বছরের যুবক যুবতীদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা চরমে। সমীক্ষা বলছে যে, পরিবারের মধ্যে অশান্তি, পড়াশোনায় ভালো ফল না পাওয়া, সম্বন্ধ বিচ্ছেদ, বাড়িতে অত্যাচার ও মানসিক বিষাদের কারণে যুবক যুবতীরা নিজেদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এই পথ বেছে নেয়। এছাড়াও রয়েছে মিডিয়াতে এক্সপোজার না পাওয়া, মাদক আসক্তি সহ বহুকাল যাবৎ বিষাদে আক্রান্ত হয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে কাটাতে অবশেষে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার প্রবণতা। সমীক্ষা প্রমাণ দিচ্ছে যে, বহুবিধ সমস্যার জটিলতায় জর্জরিত হয়েই মানুষ এই পথ বেছে নেয়।
এছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গিয়েছে যে, পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবদের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে চলা, কারও লাঞ্জিত বা অকারণে নিগৃহীত হওয়া, খুব সহজেই ভোগ বিলাসের সামগ্রী হাতে পাওয়া, পরিবারে পূর্বে আত্মহত্যার ঘটনা, সমাজে নিজেকে সঠিক ভাবে মেলে ধরতে না পারা ও হীনমন্যতার কারণেও মানুষ হঠাৎ মানসিক বিষাদে আক্রান্ত হয়ে এই পথ বেছে নেয়।
নিমহ্যান্স ব্যাঙ্গালোর শহরে ২০১০ সালে ৪৩৬ জন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালায়। ১৮-২৫ বছরের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সমীক্ষা করে পাওয়া যায় যে, ১৫ শতাংশের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা রয়েছে। ৯ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী আত্মঘাতী হওয়ার প্রচেষ্টাও করেছে। মানসিক বিষাদে আক্রান্ত ছাত্র-ছাত্রীরা ৯ শতাংশ। শারীরিক, মানসিক ও যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে, এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ। যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বা যাদের মধ্যে আত্মহত্যর প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে শারীরিক, মানসিক বা যৌন হেনস্থার কারণে মানসিক বিষাদে আক্রান্ত।
স্কুলে পড়ুয়া ২০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর ও সদ্য কলেজে প্রবেশ করা ২৫৭ জন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে, ৪০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী মানসিক বিষাদে আক্রান্ত। এর মধ্যে ১১ শতাংশ কলেজের ও ৮ শতাংশ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী আত্মঘাতী হওয়ার প্রচেষ্টাও করেছে। কারণ হিসেবে অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক কলহ ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নানাবিধ সমস্যার কথাও স্বীকার করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা।
যদি সব বয়সের ব্যক্তিদের কথা ধরা হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, পারিবারিক কলহ, অসুস্থতা, অসাফল্য, আর্থিক দুর্যোগ, পণপ্রথার জন্য চাপ, দারিদ্র ও মাদক আসক্তির কারণেও মানুষ এই পথ বেছে নিচ্ছে। তবে এই অকাল মৃত্যুকে রোধ করা সম্ভব বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে সমাজকে সচেতন ও শিক্ষিত করে তুলতে পারলে এই ভয়ঙ্কর পরিণামকে রোধ করা সম্ভব। বিষাদগ্রস্ত বা মানসিক সমস্যায় জর্জরিত মানুষ যদি পরিবারবর্গের ও বন্ধু বান্ধবদের দুঃসময়ে পাশে পায় তাহলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া খুবই সহজ। সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তি যদি প্রকৃতভাবে সচেতন ও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন তাহলে মানসিক অবসাদ এবং বিষাদে আক্রান্ত মানুষেরা আবার নতুন ভাবে বেঁচে উঠতে পারে। সর্বোপরি আত্মহত্যার প্রবণতাকে অচিরেই রোধ করা সম্ভব হবে।
ডাঃ এম মঞ্জুলা নিমহান্সে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপিকা।