মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা
মানসিক অসুস্থতার ঘটনা আমি যখন প্রথম দেখতে পাই তখন আমার বয়স ৮-৯ বছর। মার সঙ্গে আমি বাজারের পথ ধরে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখি বেশ কিছু মানুষের জটলা। একজন মানুষ যার গায়ে নোংরা জামাকাপড় আর মাথায় জট পাকানো চুল, শূন্যে হাত ছুঁড়ে কাউকে কিছু চিৎকার করে বলছে। তাকে ঘিরেই মানুষের জটলা, অথচ সেই মানুষটি অবিরাম আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে কথা বলে চলেছে এবং তার আশপাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষদের দিকে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার মা শক্ত করে আমার হাত ধরে বললেন, "এখুনি এখান থেকে চল নাহলে ওই পাগল লোকটি আমাদের ক্ষতি করতে পারে।"
'পাগল' শব্দটি আমি বছরের পর বছর ধরে শুনে আসছি। বইতে পড়েছি, আবার সিনেমাতেও এই শব্দটি বারে বারে রেকর্ডের মতো বেজেছে। তারপর যখন একটু বড় হয়েছি, অন্য সকলের মতো আমিও জেনেছি যে, পাগল লোকেদের সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নিয়ে যেতে হয়। এরপর জানলাম সাইকিয়াট্রিস্টরা পাগলদের চিকিৎসা করেন। যখন বড় হলাম এবং মেডিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়লাম, তখন বুঝলাম সত্যটা একেবারে ভিন্ন।
যৌবনে মানুষের মনেও একই ধারণা জন্মায় যে, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া মানেই পাগল। ঠিক যেমন ছোট বাচ্চারা সূর্য ও চাঁদকে একই আয়তনের বলে মনে করে। বাচ্চাদের যদি এই ধারণা বড় হয়ে না বদলায় তাহলে বুঝতে হবে তাদের যথাযোগ্য শিক্ষার অভাব রয়ে গিয়েছে বা তারা সঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। আর একটি কথা, যা সচরাচর মানুষের মধ্যে দেখা দেয় তা হল, সাইকিয়াট্রিস্ট-এর নাম শুনলেই তাঁরা ভাবতে শুরু করেন যে পাগলের কথা বলা হচ্ছে, কারণ একমাত্র পাগলরাই নাকি সাইকিয়াট্রিস্টদের সঙ্গে দেখা করে বা পরামর্শ নেয়।
সত্যি কথাটা হল একাধিক রোগের কারণে যদি হার্ট, লাংস, কিডনি, লিভার-সহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খারাপ হতে পারে তাহলে মস্তিষ্কের সমস্যা কেন হতে পারে না? এবং মানসিক সমস্যা হলেই সেটি আলাদাভাবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে পড়বে এটি একেবারে ভ্রান্ত ধারণা।
একথাও বুঝতে হবে যে, মস্তিষ্ক যখন কোনও বস্তুকে দেখে বা চিহ্নিত করে তখন একটি দীর্ঘ শৃঙ্খলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। চোখ দিয়ে যখন কোনও জিনিসকে দেখা হয় তখন চোখের রেটিনা ও করনিয়া-য় বিস্তৃত অংশে কোষিকার জাল অতিক্রম করার পর মস্তিষ্ক সংবাদ পায় এবং মস্তিষ্ক জিনিসটিকে চিহ্নিত করে এবং আমরা জানতে পারি বস্তুটি কী, বস্তুটির রং এবং আকার প্রকারের বিভেদ চিন্হিত করতে পারি। এই প্রক্রিয়াটি ঘটে মাত্র এক সেকেন্ডেরও কয়েক ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে। সেজন্য এই ঘটনাটিকে মানুষ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না বললেই চলে। এবং এটি তো হওয়ারই কথা বলে পাশ কাটিয়ে যায়। চোখ ও মস্তিষ্কের মধ্যে হাজার হাজার কার্যরত কোষিকা-র সঞ্চার মাধ্যম যা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার দ্বারা চালিত হয় তাকে নিউট্রোট্রান্সমিটার বলা হয়। এবার ধরা যাক যদি নিউট্রোট্রান্সমিটারের একাধিক সংযোগ স্থলে কোনও কোষিকার সঙ্গে অন্য কোষিকার যোগাযোগে বাধা পায় তাহলে চোখ দিয়ে বস্তুটিকে দেখা যাবে না আর পাশাপাশি মস্তিষ্ক কোনও ভাবেই বস্তুটিকে চিহ্নিত করে জানান দিতে পারবে না।
এভাবেই কিন্তু নার্ভ সেল এবং নিউট্রোট্রান্সমিটার মানুষের চিন্তা এবং ভাবনার ক্ষেত্রে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। নার্ভ সেল ও নিউট্রোট্রান্সমিটার যদি সঠিক ভাবে কাজ না করে তাহলে মানুষের ব্যবহার এবং আচার-আচরণে বিকৃতি দেখা দেয়। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও শারীরিক কারণেই হয়। যেমন ডায়েবেটিস বা পার্কিনসন্সের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে।
দেখা যাচ্ছে যে, শতকরা ৯০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, অ্যালার্জি, স্কিন র্যাশ, মাথাধরা বা ডায়রিয়ার মতোই যা সারাতে মানুষ জেনারেল ফিজিসিয়ান-এর কাছে যায়। যদি কেউ পেটে ব্যাথা বা অ্যাসিডিটির কারণে জেনারেল ফিজিসিয়ান-এর কাছে যায় তাহলে চিকিৎসক তাঁকে অ্যান্টাসিড দেন। যদি চিকিৎসক জিজ্ঞেস করেন যে আপনি কি খুব চিন্তিত এবং উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয় তাহলে চিকিৎসক তাঁকে চিন্তা মুক্ত রাখতে এক সপ্তাহের ওষুধ দেন। এরপরেও যদি রোগী চিন্তা-মুক্ত না হন তাহলে চিকিৎসক তাঁকে সাইকিয়াটিস্ট দেখাতে বলেন। ঠিক এভাবেই কান বা গলার ব্যথা না সারলে চিকিৎসক রোগীকে ইএনটি বিশেষজ্ঞ দেখাতে বলেন। সেজন্য সাইকিয়াটিস্ট দেখাতে বলা মানেই যে মানুষের মাথা কাজ করছে না বা মানসিকভাবে অসুস্থ একথা ভাবার কোনো কারণ নেই।
ছয় মাস আগের কথা, আমি এক মহিলাকে দেখেছিলাম যার বয়স ৩৫ এবং সে অনবরত চিন্তার কারণে নিজের বাড়িতে মানিয়ে নিতে পারছিল না। এই মহিলার চিন্তা ছিল, সে কর্মক্ষেত্রে প্রথম হতে কেন পারছে না। এই চিন্তা থেকে সে কিছুতেই বার হতে না পেরে অবশেষে হাই-ব্লাডপ্রেশার, ইনসোমেনিয়া, অ্যাসিডিটি সহ কিছু খেলেই বমি হওয়ার মতো রোগের শিকার হয়। এই মহিলার স্বামী বহু চিকিৎসা করানোর পরেও নিরাময় লাভে বিফল হয়ে অবশেষে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মহিলা বাড়ির কোনও কাজ করতেন না, এমনকী সন্তানদেরও খেতে দিতেন না। এভাবেই চলছিল এবং স্বামী বার বার লজ্জিত হতে হতে আত্নঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু হঠাৎ জীবনে মোড় ঘোরে। সঠিক চিকৎসার কারণে ১২ বছর ধরে চলতে থাকা এই মহিলার সমস্যা দূর হয় মাত্র ৬ মাস চিকিৎসা করানোর পরেই। তারপর মহিলা আবার নিজের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন এবং স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গেও আজ তিনি আবার সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। বাড়ি ও বাইরে সমান দক্ষতায় কাজ করছেন তিনি। এই মহিলাকে চিকিৎসা করার সুবাদে এই কথাই বলতে পারি যে, অবসাদ, ভয়, দুশ্চিন্তার কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তা সহজেই দূর করা যায় যদি মানুষ একথা বিশ্বাস করেন যে, মানসিক রোগের চিকিৎসা ঠিক শারীরিক রোগের মতোই। মানসিক রোগ শারীরিক রোগেরই এক অংশ এবং মানসিক রোগের কারণ বুঝতে হলে রোগীর সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করে, জীবনের প্রতি আস্থা বাড়িয়ে তাঁকে আশাবাদী করে তুললে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রতিটি মানুষকেই বুঝতে হবে যে, মানসিক রোগটি কোনও এমন দুঃসাধ্য রোগ নয় এবং এই রোগটিও মানুষের অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই।
ডাঃ শ্যামলা বৎস বিগত দুই দশক ধরে মানসিক রোগের চিকিৎসায় কার্যরত এবং বাঙ্গালোরে এক স্বনামধন্য সাইকিয়াটিস্ট।