আমার কাহিনী: নিজেকে ফিরে পাওয়া
কিছু বছর আগে আমি উপলব্ধি করি যে আমাদের সকলের মধ্যেই একজন লেখক, কাহিনীকার ও শ্রোতা রয়েছে।
এর কারণ হল গল্প – সিনেমা হোক, বই হোক, গান হোক বা ঠাকুরমার ঝুলি – আমাদের সবার ভাল লাগে। বাচ্চা হোক কিংবা বুড়ো, গল্পই আমাদের আশেপাশের পৃথিবীকে পূর্ণ করে।
গল্প শুধু আমরা অন্যদেরই শোনাই না, নিজেদেরকেও শোনাই।
কারণ নিজের সাথে কথা বলা আসলে অবচেতন ভাবে নিজেকে গল্প বলা ছাড়া আর কি?
আমরা আসলে নিজেদেরকে বলা কাহিনী
আমার গল্প বলার যাত্রা শুরু হয় নিজেকে বলা গল্পগুলি বিশ্লেষণ করা শুরু করে, অর্থাৎ নিজের সাথে বলা কথাগুলি উপলব্ধি করে।
আমার বিশ্বাস ছিল যে আমি খুব চুপচাপ, রোগা, তীব্র ব্যাঙ্গাত্বক, খুব আবেগপ্রবণ, স্বাধীনচেতা… কারণ এই কথাগুলো আমি লোকের থেকে শুনেছি এবং নিজেকে ঠিক বলে বুঝিয়েছি।
দেখা গেল যে, সেই চুপচাপ মেয়েটাই ১৫ বছর বয়সে জার্নাল লেখা শুরু করল
সেই তীব্র ব্যাঙ্গাত্বক, রোগা মেয়েটা ২২ বছর বয়েসে রসবোধের সাথে বডি-শেমিং নিয়ে লেখা শুরু করল
স্বাধীনচেতা মেয়েটা যার একলা ঘুরে বেড়ানোর সাহস ছিল, সে ২৪ বছর বয়সে নিজের চাকরি ছেড়ে ২৬ এর মধ্যে নিজের পছন্দমতন ব্যবসা করা শুরু করল
আবেগপ্রবণ মেয়েটি থেরাপির সাহায্যে আর নিজের যত্ন নিয়ে – নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করল – নিজের গল্পগুলিকে খুঁজে পেল
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আমার জীবনের দীর্ঘ কাহিনীর একাধিক সূত্র উঠে এসেছে।
নিজের গল্প আবার বলা
একটা কথা বরাবর আমার মাথায় ঘুরেছে, “যখন নিজের জীবনের গল্প বলতে গেলে আর কান্না পাবে না, জানবেন আপনি সেরে গেছেন।”
এক সময় আমি লেখার মাধ্যমে (আবার) নিজের গল্প বলতে শুরু করলাম – নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের সাথে লড়াই এর গল্প, কারণ আমি যে রোগা, কোথাও মানিয়ে নিয়ে পারি না, নিজের মানসিক সুস্থতা নিয়ে নিজেকে বিভ্রান্ত আর অসহায় লাগে।
এই গল্পগুলি ছিল হৃদয়বিদারক এবং ক্ষতিকর।
লেখার সাহায্যে আমি বরাবরই নিজের অন্তরের চিন্তা ও আবেগগুলিকে চিহ্নিত করতে পারতাম। এটা আমার নিজের জন্য একটা যায়গা তৈরী করে দিয়েছে যেখানে আমি নিজের সাথে সময় কাটাতে পারি বা মনের অস্বস্তিগুলি নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
সেই সময়ই আমি প্রথম উপলব্ধি করি যে আমার চেহারা নিয়ে শুধু বাকিরাই বলছে না, আমি নিজেও বলছি – যে আমি রোগা, আমি কমজোর – এবং তাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা হচ্ছে।
লেখার অভ্যাস আমাকে আমার নিজের বলা গল্পের ফাঁকগুলো বুঝতে সাহায্য করে। দীর্ঘদিনের এই অভ্যাসের ফলে আমি এখন আমার আশেপাশের মানসিক চাপের উৎসগুলিকে চিনতে পারি যা আমার মানসিক সুস্থতাকে নষ্ট করতে পারে। এতে বরং আমার সুবিধাই হয়।
(ক) আমার নিজের আচরণে ও মেজাজে পরিবর্তন নিয়ে আগাম সাবধান হওয়া
(খ) নিজের প্রতি যত্ন বাড়ানো
(গ) নিজের ভাবনা ও অনুভূতি নিয়ে সতর্ক থাকা
(ঘ) ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাকে আটকানো
হ্যাঁ, এরকম ভাবে চিন্তা করলে দেখবেন ঠিক যেন প্রদোষ মিত্তিরের কায়দায় আপনি একটা জটিল রহস্য সমাধান করে ফেললেন!
আবার বলা থেকে আবার সাজানো
এর ফলাফলস্বরূপ, আমার নিজের গল্প বলার যাত্রা – নিজেকে গল্প বলার যাত্রা – আমার নিজের গল্পগুলি সাজাতে শিখিয়েছে, নিজেকে দুর্বল ভাবা ভুলতে শিখিয়েছে।
এর জন্য আমি নিজের প্রতি প্রথমবার করুণা, ধৈর্য্য আর সংবেদনশীলতা দেখতে শিখেছি - বিশেষ করে সেইদিনগুলিতে যেদিন আমার নিজেকে অপদার্থ বলে মনে হয়। এতদিন আমার আশেপাশে সবাই কিন্তু আমায় সেভাবেই দেখেছে।
এছাড়া, এখন আমার নিজের উপরে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয়। একটু একটু করে আমি নিজেকে ফিরে পাচ্ছি। আমি শিখেছি সব সময় নিজের মন ভাল নাও থাকতে পারে।
ব্যক্তিগত পরিসরে, বহির্জগতের সামনে আমার নিজের প্রকাশভঙ্গি পালটে গেছে। এখন আমি আমার ইচ্ছেমত হ্যাঁ বা না বলতে পারি।
মাঝে মাঝেই আমি নিজেকে থামিয়ে প্রশ্ন করি: আমি নিজেকে কোন গল্পটা বলছি? নিজেকে যাচাই করার জন্য এটা এক চমৎকার পদ্ধতি, যা লেখার সময় ছাড়াও আমি করে থাকি।
নিজের জন্য একটা জায়গা
এই আবার নিজেকে গল্প বলা ও আবার সাজিয়ে তোলার অভ্যাস আমার অন্তর্মূখী মানসিকতাকে আশেপাশের লোকজনকে (আমার বন্ধুবান্ধব বা আমার ভাইবোন) আমার কাহিনি শোনানোর শক্তি যুগিয়েছে। এর ফলে নিজের গল্পের সাহায্যে আমি তাঁদেরকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুলতে পেরেছি।
আমার থেরাপি শেষ হওয়ার প্রায় এক বছর পরে ইস্টাগ্রামে একটা ছোট পোস্টের মাধ্যমে আমি প্রথম সবার সামনে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেছিলাম। সম্প্রতি, আমি আমার মানসিক সুস্থতার লড়াইয়ে শেখা জিনিসগুলি অকপটে একটা ব্লগপোস্টের মাধ্যমে সবার সাথে ভাগ করেছি।
লেখার মাধ্যমে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের কর্মশালাগুলিতে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করা ছাড়াও আমি লোকজনকে নিজের সাথে কথা বলতে শেখাই। তাছাড়া কেউ নিজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যাক্তিগত ভাবে বা সকলের সাথে কথা বলতে চাইলে আমি তার জন্যে একটা জায়গাও তৈরি করে দেই।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে থেরাপির কোনও বিকল্প নেই।
এই অভিজ্ঞতাগুলির মাধ্যমে আপনার আশেপাশের লোকজনেরাও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করা শুরু করেছে।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করার একটা জায়গা তৈরি করা ছাড়াও আমি বিষয়টিকে আরও গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
এলিটা একজন প্রশিক্ষক ও ফ্রিল্যান্সার ব্লগার যিনি এর আগে উন্নয়নের খাতে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি লেখার মাধ্যমে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের কর্মশালা পরিচালনা করার পাশাপাশি সমমানসিকতার সংস্থাগুলির সাথে মানুষ কেন্দ্রিক কন্টেন্ট বানান।