যোগের চার পথ
যখন থেকে যোগ-এর শুরু তখন থেকেই যোগের এই চারটে পথেরও শুরু। কিন্তু অতীতে, একটা নির্দিষ্ট সময়ে, কেবলমাত্র একটা পথকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। শ্রীভগবৎগীতাতে যোগের চারটে পথের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু, শঙ্করাচার্যের সময় ঞ্জান যোগকে; রামানুজের সময় ভক্তি যোগকে প্রধান পথ বলে মানা হয়েছে। আবার পতঞ্জলির যোগ-সূত্রতে রাজ যোগকেই বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৮৯০ সালে স্বামী বিবেকানন্দর বিখ্যাত বক্তৃতা, যেখানে তিনি সমগ্র বিশ্বকে চার ধরণের যোগের কথা জানান, তার আগে কর্ম যোগের কথা সে রকমভাবে জানা যায়নি।
রাজ যোগ – ইচ্ছাশক্তির পথ
পতঞ্জলির যোগসূত্র অনুসারে, যোগাভ্যাসের মাধ্যমে মনের ওপর অধিকার লাভ করা যায়। রাজ যোগের দু’রকম প্রকারভেদ আছেঃ
বহিরঙ্গ যোগে ব্যবহারিক জীবনে অনেক নিয়ম-কানুন ও তার সাথে সাথে শারীরিক কসরতের অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে শরীর ও মনের ওপর অধিকার অর্জনের জন্য (আসন ও প্রাণায়ম্)।
অন্তরঙ্গ যোগ হল মনঃসংযোগ, ধ্যান ও সমাধির সমন্বয় যা মানুষের মনের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে।
কর্ম যোগ – কাজের রাস্তা
কর্ম যোগের বিষয়ে জানার প্রধান রাস্তা হল শ্রীভগবৎগীতা; পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই রাস্তা জোর দেয় একনিষ্ট কাজের ওপর; ফলের প্রত্যাশা না করে শুধুমাত্র কাজ করা।
কাজগুলোকে নিম্নরূপ ভাগ করা হয়েছেঃ
তামসিক: যদি সেখানে কোনপ্রকার বন্ধন থাকে, ইগো থাকে ও তার সাথে সাথে মনের ভুল ও দ্বন্দও থাকে।
রাজসিক: যখন এটা মনের ইচ্ছাতে, অনেক পরিশ্রমের দ্বারা করা হয়।
সাত্ত্বিক: যখন এটা সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত এবং ভালবাসা ও ঘৃণা দুইয়েরই উপরে উঠে যায়।
কর্ম যোগের প্রধান উদ্দেশ্য হল কাজ করার ইচ্ছাকে যোগিক কর্মে পরিণত করা; সমস্ত কিছুর সাথে বিচ্ছিন্নতা স্থাপন করে মানুষের সকল শক্তিকে অবিরল কর্মে রূপান্তরিত করা।
ভক্তি যোগ – আরাধনার পথ
ভক্তি যোগের কাজ হল একজন মানুষের আবেগকে পরিপূর্ণ করা, সমাজের জন্য ভালবাসা জাগানো এবং সর্বত্র একাত্মতা ও বিশ্ব ভাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। এর ফলে কামনা-বাসনাতে যুক্ত ভালবাসা এক শর্তহীন ভালবাসাতে পরিণত হয়। কাম (ডিসায়ার) ও ত্যাগ (স্যাকরিফাইস্) সংযুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় প্রেম বা ভালবাসা। প্রেমের সাথে শরণাগতি বা সমর্পণের মিলিত ফল হল ভক্তি।
ভক্তি যোগের পথ মানুষের মনকে শান্ত ও তৃপ্ত করে। এই যোগ হল চারটে যোগের মধ্যে সবথেকে সহজ রাস্তা আর এর সাধনার পথও খুব কঠোর নয়।
ভক্তিযোগ অনেকটা একটা মানুষের সাথে আর একটা মানুষের যে সম্পর্ক হয় ঠিক তেমনি আত্মার সাথে অন্তরাত্মার সম্বন্ধ। ভগবৎ পুরাণে আমরা ন’টা ভক্তির কথা জানতে পারিঃ শ্রবণ (শোনা), কীর্ত্তণ (গুণ গাওয়া), স্মরণ (মনে রাখা), পদ-সেবন (কাজ করা), অর্চ্চনা (আরাধনা), বন্দনা (সন্মান দেওয়া), দাস্য (সেবা করা), সখ্য (বন্ধুত্ব) এবং আত্ম-নিবেদন (নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করা)
জ্ঞান যোগ – শিক্ষার পথ
এই পথের সাহায্যে অপরিমেয় সচেতনতা ও যথেষ্ট ঞ্জানার্জনের মাধ্যমে যুক্তিযুক্ত মন তৈরী হয়। এই ঞ্জান যোগেরও তিনটে দশা আছেঃ
শ্রবণ: জ্ঞানার্জনের প্রথম প্রকাশ, তা সে বই পড়ে হোক বা বক্তৃতা শুনে হোক বা ভিডিও দেখেই হোক।
মনন: সেই অর্জিত জ্ঞানকে সঠিক উপলব্ধি করা
নিদিধ্যাসন: অর্জিত জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগ।
জ্ঞান যোগের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল আত্মাকে চেনা ও তাকে শরীর থেকে আলাদা করে জানা। একজন মানুষ যিনি ঞ্জান যোগের রাস্তাতে চলছেন তিনি জাগতিক সব আকাঙ্খা ও সুখের থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন।
যদিও, যোগের এই চারটে পথ একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তবুও তারা একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় ও একের মধ্যে সকলের সমন্বয় সাধন করে।
ডাঃ বিনোদ কুমার নিমহান্স-এ জুনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসর (যোগ ও সাইকিয়াট্রি)