পুনর্জাগরণ: আপনিও হয়ত জানেন না আপনার মধ্যে কতটা ইচ্ছাশক্তি লুকিয়ে রয়েছে
কখনো কি এমন হয়েছে যে কোন একটা জরুরি কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ ক্লান্ত বা হতোদ্যম হয়ে কাজ থামিয়ে দিয়েছেন, তারপর কোথা থেকে এনার্জির গুপ্ত ভান্ডার খুলে গেল আর আপনিও চনমনে হয়ে কাজে ফের নেমে পড়লেন? প্রায় ১৮০০-এর শেষ ভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রবাদের খুব প্রচলন হয়েছিল – “গেটিং ইয়োর সেকেন্ড উইন্ড”, অর্থাৎ উদ্যমের পুনর্জাগরণ হওয়া। এই উদ্যম বা এনার্জি ফিরে আসাই ভাবিয়েছিল মার্কিন দার্শনিক তথা মনস্তত্ত্ববিদ উইলিয়াম জেমসকেও প্রায় এক শতাব্দী আগে। উইলিয়াম জেমসের জীবনও কম রোমাঞ্চকর নয়। অ্যামেরিকান সাইকোলজির প্রতিষ্ঠাতা জেমস এক সময় ভেবেছিলেন পেশাদার আঁকিয়ে হবেন। কিন্তু চিত্রশিল্পী হওয়ার মতো যথেষ্ট প্রতিভার অভাবে তিনি পড়াশোনার কোরিয়ারই বেছে নেন।
তাঁর হাত ধরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যামেরিকার প্রথম মনোবিজ্ঞানের গবেষণার গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে তাঁর চিন্তা ভাবনা ও কর্ম দর্শনে আধ্যাত্মবাদের নিদর্শন পাওয়া যায়। সুস্বাস্থ্য ও অসুখের মধ্যে যে মানব দেহ এবং মনের গূঢ় সম্পর্ক রয়েছে তা নিয়েও তিনি ভাবনা এবং স্পষ্ট মত প্রকাশ করেন। এই সব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি ভারতীয় আধ্যাত্মিক বিষয় এবং বিশেষ করে যোগাভ্যাস নিয়েও পড়াশোনা করতে থাকেন। নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯০৬-এর ডিসেম্বর মাসে এ্যামেরিকান ফিলোসফিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের এক সভায় তার একটি যুগান্তকারী বক্তৃতা এই সংক্রান্ত ভাবনা চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই দুরন্ত বক্তৃতার কয়েক সপ্তাহ পর সম্ভাষনটি “দ্য এনারজিস অফ মেন” শীর্ষক এক প্রবন্ধের আকারে দ্য ফিলোসফিক্যাল রিভিউ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরেই নিবন্ধটি সায়েন্স ম্যাগাজিনেও পুনঃমুদ্রিত হয়। নিবন্ধটি দারুন জনপ্রিয় হয় এবং বহু পেশাদারকেই চিন্তা ভাবনার রসদ যোগায়। এই বহু চর্চিত নিবন্ধে উইলিয়াম জেমস উল্লেখ করেন যে মানুষ কোনো কাজ করতে গিয়ে মাঝ পথে হতোদ্যম হয়ে থেমে যান আবার হঠাৎ কোথা থেকে অসম্ভব জীবনীশক্তি চলে আসে এবং হারিয়ে যাওয়া উদ্যমের পুনর্জাগরণ ঘটে। একেই তিনি "সেকেন্ড উইন্ড" বা ঠিক যেন আরেক দমকা হাওয়া বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে আমাদের মনস্তত্ত্বে বেশ কিছুটা উদ্যম কোনো এক লুকোনো ভাড়ার ঘরে তুলে রাখা থাকে। এমনই কোনো এক প্রয়োজনের সময় তা আপনা থেকে প্রকাশ পায়। এ এক অদ্ভূত প্রকৃয়া যা নিতান্তই স্বাভাবিকভাবে ঘটে আমাদের প্রায় সবার জীবনেই।
এর জন্য কোনো পরিকল্পনা বা বাড়তি উদ্যোগ গ্রহনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু উইলিয়াম জেমস বিশ্বাস করতেন যে কোনো এক দিন মনোবিজ্ঞান সেই বাড়তি তুলে রাখা উদ্যমের বা এনার্জির ভাড়ার ঘরটি খুঁজে পাবে আর তা শারীরিক, বৌদ্ধিক,নীতিগত ও আধ্যাত্মিক কাজে ব্যবহৃত হবে।
পুনর্জাগরণের নিজের ক্ষমতাকে বিকশিত করা
যদিও তিনি তার পেশাগত জীবন শুরু করেন চিকিৎসা ক্ষেত্রে - গবেষণাগারে গবেষক হিসেবে - ক্রমেই তিনি আধ্যাত্মিক ও অপ্রাকৃত জগতের প্রতি টান অনুভব করতে শুরু করেন। তার এই আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি আগ্রহ মানব মনের গহনে ঘটে চলা জটিল মনোবিজ্ঞানের অনেক অব্যাখ্যাত অধ্যায়কে সরল করে উপস্থাপন করতে সহায়তা করে।
তাই তিনি বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার অগ্রগতিতে তথ্যের ভূমিকা অপরিসীম। একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ যেমন মানুষের দৃষ্টিশক্তি বিচার করতে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষামূলক চার্ট ব্যবহার করেন ঠিক তেমনি মনোবিজ্ঞানও মানুষের উদ্যম ও ইচ্ছাশক্তির একটি বাস্তবিক পরিধি নির্ধারণ করতে পারে- এমনটাই তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি জানান, "আমাদের প্রয়োজন বিভিন্ন মানব মনকে বিশ্লেষন করা এবং তারা কিভাবে উদ্যমকে সঞ্চয় করে রাখে তা বুঝতে শেখা। তার মাধ্যমেই আমরা আমাদের সত্যিকারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারব।"
কিভাবে আপনার সঞ্চিত উদ্যমের পরিচয় পাবেন:
১) ভেবে দেখুন সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা যখন আপনি কোনো কাজ করতে গিয়ে খুব ক্লান্ত ও হতোদ্যম হয়ে পরেছিলেন কি? এমন কোনও কাজ যা আপনার দেহ ও মনকেও ক্লান্ত করেছিল। তারপর আচমকাই আপনি কোথা থেকে যেন প্রচুর মনের জোর পেয়ে গেলেন নতুন উদ্যমে কাজে ফের ঝাঁপিয়ে পরলেন। ভেবে দেখুন তো ঠিক কোন কারণে আপনি আচমকা এই উদ্যমের পুনর্জাগরণ অনুভব করলেন! অন্য কোনো ব্যক্তি, পরিবার, পরিজন বা বন্ধু কেউ কি আপনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন? না কি নিজেকে নিজেই উদ্বুদ্ধ করলেন? এমনও হতে পারে দুটিই এক সঙ্গে ঘটেছে। নাকি এগুলির কোনোটাই নয় যা ঘটেছে তা সম্পূর্ণ অন্য কিছু।
২) যদি আপনি কোনো প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো খেলা বা বিশেষ কোনো বিষয় শেখাতে গিয়ে উদ্যমের পুনর্জাগরণ ঘটাতে চান তখন তাদের কি করার পরামর্শ দেবেন? শিশুদের এই ক্ষমতা তৈরির পিছনে ঠিক কি ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে পারে? আপনি কি মনে করেন কিশোর বয়সে এই উদ্যম পুনর্জাগরণ সহজ হয়? হলে কেন হয়?
৩) পরবর্তী দুই সপ্তাহ সেই সব ঘটনাগুলো লিখে রাখুন যখন আপনি কোনো কাজ করতে গিয়ে ক্লান্ত বা হতোদ্যম হয়ে পরেছিলেন, অথচ নতুন উদ্যমে খানিক বাদে ফের কাজে লেগে পরেছিলেন। ঠিক কেন এমনটি ঘটলো তা ভেবে দেখুন।
৪) অবশেষে, উদ্যমের পুনর্জাগরণ ঘটাতে ধ্যান করুন, মেডিটেশন করুন, অল্প ঘুমিয়ে নিতে পারেন বা যোগাসন করতে পারেন। উদ্যমের পুনর্জাগরণ হলো কিনা তা নিজেই বিশ্লেষন করে দেখুন।
একটি মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। ১৯১৪ তে বষ্টনে উইলিয়াম জেমসের প্রকাশক এমন একটি সতর্কীকরণ ছাপতে বাধ্য হয়েছিলেন - যদিও এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এই প্রবন্ধের বার্তা বোধ সম্পন্ন এবং সাধারণ ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, খবরের কাগজে প্রকাশিত মতামত দেখা প্রচ্ছদে জানানো প্রয়োজন যে এই লেখা কোনোভাবেই ব্যক্তিদের নিজের সাধারণ সহ্যক্ষমতার বেশি চেষ্টা করার নির্দেশ দিচ্ছে না... এবং জরুরী অবস্থায় কোনো ধরনের নেশা, যেমন মদ বা আফিম, প্রয়োগের কথা বলছে না।
ডাঃ এডওয়ার্ড হফম্যান, নিউ ইয়র্ক শহরে ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। উনি একজন অনুমোদিত মনোবিদ যিনি সাইকোলজি নিয়ে ২৫ টিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্প্রতি উনি ডা: উইলিয়াম কম্পটন -এর সাথে ‘পজিটিভ সাইকোলজি: দ্যা সায়েন্স অফ হ্যাপিনেস অ্যান্ড ফ্লারিশিং’ রচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পজিটিভ সাইকোলজি’ এবং ‘জার্নাল অফ হিউম্যানিস্ট সাইকোলজি’র সম্পাদক মন্ডলীর সঙ্গে যুক্ত। আপনি তাঁর সাথে columns@whiteswanfoundation.org -এ যোগাযোগ করতে পারেন।