অভিভাবকত্বে সচেতনতার অনুশীলন করুন
মানুষের জীবনে অভিভাবকত্বের সময়টা খুবই আনন্দের হলেও প্রকৃত অর্থে বেশ চ্যালেঞ্জিং-ও বটে। বাবা হিসেবে এই সত্যটি আমি উপলব্ধি করেছি। যখন বাবা-মা তাঁদের সদ্যোজাত বাচ্চাকে প্রথমবার হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন, সেই স্মরণীয় প্রথম দিনটিতে তাঁদের মনে সহসা কী অনুভূতি দেখা দেয় তা একজন আমেরিকান কৌতুক অভিনেতার বিবরণে ধরা পড়েছে – “এবার কী করব? নির্দেশাবলী কোথায়?” ইতিবাচক মনস্তত্ত্বে সেরকম কোন নির্দেশাবলী এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি কিন্তু অভিভাবকত্ব নিয়ে সমসাময়িক গবেষণায় একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা ক্রমশই বেড়ে চলেছে, আর তা হল অভিভাবকত্বে সচেতনতার ভূমিকা। হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের জন্য লেখা আমার আগের একটি প্রবন্ধে মুক্তমনা ব্যক্তিত্বের লক্ষণ হিসেবে সচেতনতার কথা আলোচনা করেছিলাম। এর ফলে মানুষের বর্তমান সময়ের প্রতি নজর দেওয়ার ক্ষমতা জন্মায় এবং সে মানসিক ও শারীরিকভাবেও সুস্থ থাকে। এই ইতিবাচক প্রভাবগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এবং প্রেম-ভালোবাসার বিষয়টিও, মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়ে, এমনকী হৃদ্যন্ত্রও সুস্থ-সবল হয়।
সচেতন অভিভাবকত্বের সঙ্গে আরও অনেক বিষয় যুক্ত থাকে। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ লারিসা ডানকান এইধরনের অভিভাবকত্বের দিকে সর্বপ্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর মতে, এর মাধ্যমে বাবা-মায়েরা ''উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতি মুহূর্তে অভিভাবক ও সন্তানের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে সচেতন থাকেন।'' এসত্ত্বেও গবেষণার মাধ্যমে দেখা গিয়েছে যে সার্বিক সচেতনতা অভিভাবকত্বের জন্য যথেষ্ঠ নয়। কেন এমন হয়? কারণ এর ফলে সারাদিন ধরে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও, একটি ছ'বছরের বাচ্চার মেজাজ-মর্জি আর বায়না সহ্য করা বা অথবা একটি টিনেজার রাত দু'টোর সময় বাড়ি ফিরেছে – এই ধরনের পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করার জন্য উচ্চ স্তরের সার্বিক সচেতনতা যথেষ্ট নয়। এমন কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সচেতন অভিভাবকত্বের বিশেষভাবে প্রয়োজন দেখা দেয়।
ডানকানের মতে, সচেতন অভিভাবকত্ব এমন একটি কৌশল যা সব অভিভাবকরাই শিখতে পারেন। এর আলাদা-আলাদা পাঁচটি কিন্তু একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত দিক রয়েছে:
১) সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শোনা, যাতে আমরা আমাদের বাচ্চাদের আচার-আচরণ সঠিকভাবে বুঝতে পারি।
২) কোনওরকম মতামত না দিয়ে নিজেকে এবং বাচ্চাকে গ্রহণ করা, এভাবে সন্তানের জন্য আমরা একটি বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা ও লক্ষ্য স্থির করতে পারব।
৩) মানসিক সচেতনতা জরুরি নিজের এবং সন্তানের বিষয়ে, যাতে আমরা আমাদের সন্তানের আবেগ-অনুভূতিগুলোকে সঠিকভাবে বুঝতে ও সম্মান করতে পারি।
৪) অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এর ফলে আমরা শান্ত থাকতে পারি এবং আমাদের বাচ্চাদের ভুলভ্রান্তি, অযৌক্তিক চাহিদা, বদমেজাজ এবং অন্যান্য নেতিবাচক আচরণগুলো নিয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো প্রভৃতি এড়িয়ে চলতে পারি।
৫) নিজেদের এবং সন্তানের জন্য সমবেদনা থাকা জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে সন্তানদের প্রতি কতগুলো আন্তরিক অনুভূতির বিষয়, যেমন- স্নেহ, দয়া-মায়া, ক্ষমাশীল মনোভাব এবং কৃতজ্ঞতা বোধ আর নিজের প্রতি সহানুভূতি।
যদিও কোনও অভিভাবক-ই সবসময়ে এসব বিষয়গুলো মেনে চলতে পারে না। ডানকান এবং তাঁর সহকর্মীরা একে বাস্তবসম্মত আদর্শ হিসেবে দেখেছেন এবং এই সংক্রান্ত কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতি মুহূর্তে তাদের অভিভাবকত্বের অনুভূতি ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে না। এর পেছনে এটাই মূল ভাবনা। তাই সাধারণভাবে এই সচেতনতাজনিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত দৈনন্দিন চাপ সামলানোর শিক্ষার বন্দোবস্ত করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।
এই ধরনের প্রশিক্ষণ কি বাস্তবে কার্যকরী করা সম্ভব? এর উত্তরটা অবশ্যই হ্যাঁ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এবিষয়ে জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ কেটলিন টারপিন অভিভাবক এবং তাদের সচেতন অভিভাবকত্বের মাত্রা নিয়ে একটা সমীক্ষা করেছিলেন এবং তারপর বিশ্লেষণ করেছিলেন যে কীভাবে তারা তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব নিয়ে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি সন্তানদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। যেসব বাবা-মা অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে খুব বেশি সচেতন হন তাদের আচরণে নেতিবাচক অনুভূতি (যেমন- রাগ বা ক্রোধ) খুব কম প্রকাশ পায়। এর পরিবর্তে তাদের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি (যেমন- প্রাণ খুলে হাসা) কম সচেতন অভিভাবকদের তুলনায় বেশি করে দেখা দেয়। অন্যদিকে, ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ জাস্টিন পেরেন্ট-এর নেতৃত্বে আরেকটি গবেষণায় অভিভাবকত্বের মূল্যায়ন করা হয়েছিল। সেখানে সর্বাঙ্গীণভাবে সচেতন অভিভাবকত্বের বিষয়টি তুলে ধরা হয় এবং তারপর তাদের সন্তানদের মধ্যে জন্মানো বিভিন্ন অনুভূতিজনিত সমস্যা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানে দেখা যায় যে, শিশু ও বয়ঃসন্ধিকালীন- দু'ধরনের সন্তানদের ক্ষেত্রে সার্বিক সচেতনতার পরিবর্তে উচ্চ মাত্রার সচেতন অভিভাবকত্ব তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভালো ফল দেয়।
অভিভাবক হিসেবে কীভাবে আপনি আপনার সচেতনতার উন্নতি ঘটাতে পারেন? এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হল নিজের আচরণ বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনাকে বিচার করতে হবে যে আপনি ঠিক কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী আপনি কীভাবে আপনার আচরণের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রকাশ করতে পারেন। যেমন ডানকানের নেতৃত্বে গঠিক গবেষক দল একটি প্রশ্নমালা তৈরি করেছিলেন যেখানে একটি বাচ্চার বাবা-মায়ের বিগত দু'সপ্তাহের অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত আচার-আচরণের বিষয়ক প্রশ্নগুলোর ধরন ছিল এইরকম- ''যখন আপনার সন্তান তার মনের চিন্তাভাবনার কথা আপনাকে বলছে না তখন কীভাবে আপনি তা নিজে থেকে বুঝতে পারবেন?'', ''আপনি কি চান যে আপনার বাচ্চা অন্য আরেকটি বাচ্চার মতো হোক?'', ''যখন আপনার সন্তান আপনার সঙ্গে কথা বলে তখন কি আপনি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন?'', ''আপনি কি লক্ষ করেছেন কীভাবে আপনার আচরণ বা অনুভূতিগুলো আপনার বাচ্চার উপরে প্রভাব ফেলছে''? এবং ''আপনি আপনার অভিভাবকত্বের বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণের জন্যও কি চিন্তাভাবনা করেন?''
এই পাঁচটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে যদি আপনার মনে হয় যে সচেতন অভিভাবকত্বের উন্নতি সম্ভব তাহলে পরের দুই সপ্তাহের জন্য একটা জার্নাল সঙ্গে রাখুন এবং প্রতিদিন অভিভাবকত্বের ভালো কাজগুলো সম্বন্ধে একটা করে অনুচ্ছেদ লিখুন। যে বিষয়ে উন্নতি প্রয়োজন সেটা নিয়েও লিখুন। নিঃসন্দেহে আপনি নিজের মধ্যে এই কাজের কার্যকরী প্রতিফলন দেখতে পাবেন।
ডা: এডওয়ার্ড হফম্যান, নিউ ইয়র্ক শহরে ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। উনি একজন অনুমোদিত মনোবিদ যিনি সাইকোলজি নিয়ে ২৫ টিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্প্রতি উনি ডা: উইলিয়াম কম্পটন -এর সাথে ‘পজিটিভ সাইকোলজি: দ্যা সায়েন্স অফ হ্যাপিনেস অ্যান্ড ফ্লারিশিং’ রচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পজিটিভ সাইকোলজি’ এবং ‘জার্নাল অফ হিউম্যানিস্ট সাইকোলজি’র সম্পাদক মন্ডলীর সঙ্গে যুক্ত। আপনি তাঁর সাথে columns@whiteswanfoundation.org -এ যোগাযোগ করতে পারেন।