জীবনের সহজ সরল মুহূর্তগুলোর আস্বাদ গ্রহণ জরুরি

জীবনের সহজ সরল মুহূর্তগুলোর আস্বাদ গ্রহণ জরুরি

Published on

রাজকীয় নৈশভোজ এবং বিলাসিতাপূর্ণ ছুটি কাটানোর জন্য আপনি বা আপনারা কি ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন? অতিরঞ্জিত করে স্বপ্ন দেখা সম্ভবত মনুষ্য চরিত্রের একটি  দিক। সেই সঙ্গে নিশ্চিতভাবে সারা বিশ্বে যে কেনা-বেচার শিল্পের ধারণা গড়ে উঠেছে তা আমাদের মনে খিদে, সেরা তকমা এবং মনোরম ছুটি কাটানোর আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র গণমাধ্যমগুলোতে বিপুল পরিমাণ  লটারি জেতার বিজ্ঞাপন করা হয় এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বড় বড় পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। এর উদ্দেশ্য অত্যন্ত সহজ এবং তা হল জীবনে সুযোগ একবারই আসে, আর সেই সুযোগ হাতছাড়া করা কখনোই উচিত নয়।

কিন্তু এক জীবনে আমাদের আনন্দে থাকার জন্য আতিশয্যপূর্ণ ঘটনা ঘটা কি সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ অথবা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়? জীবনে প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করার জন্য আমাদের নানারকম বাধার মুখোমুখি হতে হলেও, ক্ষমতা বা পদমর্যাদা লাভের যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে, তা এর বিপরীত কথাই বলে, আর সেটা হল- ইতিবাচক মনস্তত্ত্ব। এই ইতিবাচকতার দ্বারাই আমরা দৈনন্দিন জীবনে ঘটা অনেক ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর আনন্দ বা সুখ উপভোগ করতে পারি। এবং আমাদের উচিত এই মানসিকতাকেই জীবনে গুরুত্ব দেওয়া।  

অবশ্য এই ধারণা সম্পূর্ণ নতুন নয়। প্রায় আশি বছর আগে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সমারসেট মম তাঁর স্মৃতিকথা 'দি সামিং আপ'-এ লিখেছিলেন: ''জীবনে বয়ে চলা মুহূর্তগুলো সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল থাকি। তবে গুরুত্বপূর্ণ হল সেসব মুহূর্তগুলোর অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য খুঁজে বের করা। কারণ আজ যা তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে একদিন আসবে যখন আজকের সেই তুচ্ছ মুহূর্তকেই অসামান্য বলে মনে হবে।'' ১৯৩৮ সালে মম যখন এই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যগুলো লিখছেন তখন তিনি তাঁর জীবনের মধ্যভাগ অতিক্রম করতে চলেছেন। সেই সময় তাঁর মধ্যে অর্ন্তনিহিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ইতিবাচক মনস্তত্ত্বের ধারণা স্পষ্টভাবে গড়ে উঠেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় জীবনের রস আস্বাদনের মূল্য তিনি উপলব্ধি করেছেন। অর্থাৎ, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাকে গ্রহণ করা, তাকে স্বাগত জানানো এবং ছোট ছোট খুশির মুহূর্তগুলোর উপস্থিতি বাড়িয়ে তোলা- এই সহজ ঘটনাগুলোর গুরুত্বের কথাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক সময়ের গবেষকদের মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন শিকাগোর লয়লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডক্টর ফ্রেড ব্রিয়ান্ট। ব্রিয়ান্ট যখন উঠতি বয়সে  পৌঁছেছিলেন তখন তাঁর মায়ের দেওয়া 'সাধারণ উপহার' বা 'ন্যাচারাল গিফট'-এর দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় সেই সাধারণ উপহারগুলোর সাহায্যেই অনেক ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগ করা সম্ভব। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার মাধ্যমে তিনি দেখেছিলেন যে এই ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগ করার মধ্য দিয়ে মানুষের মানসিক চাপ অনেক কমে এবং সে সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারে। গত শতকে ডক্টর ব্রিয়ান্ট আনন্দের শক্তি ও দুর্বলতা নিয়ে গবেষণারত একটি আর্ন্তজাতিক গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা দেখিয়েছিলেন, মানুষ তার জীবনে ঘটা ভালো ঘটনাগুলোর রসাস্বদনে ব্যর্থ হয়। কারণ এক্ষেত্রে তারা সঠিক কৌশল অবলম্বন করতে পারে না। আর মন্দ ঘটনা ঘটার পিছনে থাকে মানুষের নেওয়া ভুল কৌশল।

অন্যদিকে, আমরা আমাদের আনন্দ, দুঃখ, অনুভূতিগুলো নিয়ে বারবার নিজেদের চিন্তানভাবনা পরিবর্তন করি। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে চিন্তাভাবনার এহেন পরিবর্তনের জন্য আমরা আমাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর বিকাশের পথ অবরুদ্ধ করে ফেলি। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবেই সেগুলো স্রোতের বিপরীত দিকে বয়ে যায়।

 নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডক্টর পল জোস-এর নেতৃত্বে এই বিষয়ে একটি গবেষণা করা হয়। সেখানে ১০১জন পুরুষ ও মহিলার জীবনের ৩০দিনের সুখ-দুঃখ-আনন্দ একটা ডায়েরিতে নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। অংশগ্রহণকারীদের সুখকর ঘটনাগুলোকে নথিবদ্ধ করে দেখার চেষ্টা হয়েছিল যে তারা ওই ঘটনা কতখানি উপভোগ করেছিল বা ওই ঘটনা থেকে কোনও স্বাদ  তারা আদৌ গ্রহণ করতে পেরেছ কিনা। রসাস্বদনকারীরা তাদের খুশির মাত্রা  বাড়িয়েছিল ইতিবাচক ঘটনার দিকে আলোকপাত করে, তা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে, হাসাহাসি করে এমনকী, ঠাট্টা-তামাশা করে। পক্ষান্তরে, যারা রসাস্বদন করতে পারেনি তাদের কাছে আনন্দটা যেন ছিল জোর করে চাপিয়ে দেওয়া, যেন তারা সেই আনন্দের ভাগিদার হতে চায় না অথবা আনন্দের মাত্রা খুব কম হয়েছে বা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি- এইরকম মনোভাবে তাদের দেখা গিয়েছিল। এই বিষয়ে ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন গবেষক ডিআরএস ড্যানিয়াল হার্লি এবং পল কোয়ন আরেকটি গবেষণায় দেখিয়েছিলেন মানুষ যখন তার জীবনে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তারা রসাস্বদনকারী মুহূর্তগুলোর মাধ্যমেই চাঙ্গা থাকতে পারে। অন্যদিকে মানুষের জীবনে যতই ইতিবাচক পরিস্থতি থাকুক না কেন যদি তারা তা উপভোগ করতে না পারে তাহলে জীবনের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর হয় না। গবেষণাগুলো থেকে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলেন যে যখন মানুষের জীবনে খুশির বাতাবরণ তেমন থাকবে না তখন ছোট ছোট মুহূর্তগুলো থেকে রসাস্বদন করা বা তা উপভোগ করার মানসিকতা মানুষের সুস্থতার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত হয়ে দাঁড়ায়।

মানুষ কি একরকমভাবেই আনন্দ বা খুশির স্বাদ গ্রহণ করতে পারে? ডক্টর ব্রিয়ান্ট  ও তাঁর সহকর্মীরা এক্ষেত্রে চারটি উপায়ের কথা বলেছেন। এবং এই চারটি পন্থা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রয়োগ করে থাকি। সেগুলো হল-

১. প্রশংসা বা অভিনন্দন গ্রহণ- বিশেষ করে সেইসব মানুষের কাছ থেকে যাদের মতামতের একটা গুরুত্ব আমাদের কাছে রয়েছে।

২. অবাক করা মুহূর্তগুলোকে মুক্ত মনে স্বীকার করা- অনেকসময়ে যখন আমরা সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যাই তখন এমন মনোভাব দেখা দেয়।

৩. অনুভূতিগুলোর বিলাসিতাকে উপভোগ করা- ভালো কফি বা সতেজ ফুলের ঘ্রাণ নেওয়ার সময়ে এমন উপলব্ধি হয়।

৪. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা- কাউকে কৃতজ্ঞতা জানানোটা যাতে অন্তর থেকে করা যায় সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।

ডক্টর ব্রিয়ান্ট এবং তাঁর সহকর্মীরা 'আনন্দকে গলা টিপে মেরে ফেলার' চিন্তাভাবনা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছেন। অর্থাৎ, আমরা অনেকসময়ে আমাদের জীবনের ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলোকে অত্যন্ত সচেতনভাবে তুচ্ছ করে দেখি। কিছু মানুষ এভাবেই নিজেকে নিজের শত্রু বানিয়ে ফেলে। কিন্তু কেন? এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে মানুষের কাছে তাদের অভিভাবকরা আদর্শ হয়ে ওঠে। আসলে আমরা আমাদের আচার-আচরণ বা মূল্যবোধের অনেকটাই অভিভাবকদের কাছ থেকে শিখি। তাই আমাদের মধ্যে কখনও এমন চিন্তা জাগে না, ''এই আনন্দের মুহূর্ত বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না, এটা বড় কষ্টের!'' বা ''এই মুহূর্তে আমি আনন্দ করছি কিন্তু এরপর আমায় অনেক কাজকর্ম করতে হবে'' অথবা ''এখনকার আনন্দে বেশি মশগুল হওয়ার চাইতে আমার ভাবা উচিত পরবর্তীকালের খারাপ পরিস্থিতির কথা।'' বাস্তবে কী করলে আমাদের জীবনের ছোট ঘটনাগুলো থেকে আমরা স্বাদ নিতে পারি? এই বিষয়ে ডক্টর ব্রিয়ান্টের সুপারিশ হল-

১) নিজের খুশির মুহূর্তগুলো বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া জরুরি- মজার সিনেমা, ভালো রেস্তোরাঁ বা আনন্দময় ছুটি কাটানোর জায়গার অভিজ্ঞতা বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে। এইধরনের ঘটনাকে গুরুত্ব দিলে তা আমাদের শক্তিকে বাড়াতে সাহায্য করে।

২) সুখের অভিজ্ঞতার স্মৃতি মনে গেঁথে নেওয়া। যেমন- কাছের মানুষের স্পর্শ বা বন্ধুদের হাসি।

৩) নিজের কৃতিত্বের জন্য নিজেকে অভিনন্দন জানাতে হবে। এর ফলে আমাদের আনন্দের বোধ বেড়ে যায়।

৪) আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে আরও ক্ষুরধার করে তুলতে হবে। যেমন- শব্দ, বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ প্রভৃতির প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। আসলে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সক্রিয়তার উপর নির্ভর করে জীবনের রসাস্বদনের বোধ। তাই সেই ইন্দ্রিয়গুলোর সক্রিয়তাকে দুর্বল করা উচিত নয়।   

আমাদের করণীয় বিষয়গুলো হল-

আনন্দ উপভোগ করার জন্য আমাদের দুটো কাজ করতে হবে যা আমরা প্রতিদিন করে থাকি। এর মধ্যে একটা ঘরের কাজ এবং অন্যটা ঘরের বাইরের কাজ। যেমন- ধারাস্নান করা, রাতের খাবার খাওয়া, সাইকেল চালানো বা পার্কে হাঁটাহাঁটি করা। নিদেনপক্ষে প্রথামিকভাবে এগুলো করার চেষ্টা করতে হবে এবং মনঃসংযোগের যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করা চলবে না।

এক্ষেত্রে নিজেকে অনেক শান্ত করতে হবে। নিজের অনুভূতিগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া জরুরি। পাঁচটা ইন্দ্রিয়কেই খোলা রাখতে হবে। তারপর নিজের সচেতনতার জন্য একটাকে গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে কী দেখা যাবে? নতুন বা ভিন্ন চিন্তা জাগবে কি? নিজেকে বোঝাতে হবে সময়ের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নিজের সুস্থতা প্রয়োজন রয়েছে। নিজের জীবনের ভাল লাগার মুহূর্তগুলো বন্ধুবান্ধব বা কাছের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন। অবশ্য কুড়ি মিনিটের জন্য যদি সম্ভব হয় তাহলে একজনের প্রশংসা করার চেয়ে দু'জন মানুষ একে অপরের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারে।  

প্রবন্ধটি লিখেছেন ডঃ এডওয়ার্ড হফ্‌ম্যান। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক। প্রাইভেটে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি অনুশীলন করার জন্য তাঁর ছাড়পত্র রয়েছে। মনস্তত্ত্ব বা সাইকোলজি এবং সেই সংক্রান্ত ২৫টির বেশি বই তিনি লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন। সম্প্রতি ডাক্তার উইলিয়ম কম্পটনের সহযোগী লেখক হিসেবে হফম্যান 'Positive Psychology: The Science of Happiness and Flourishing' নামক বইটি লিখেছেন। এছাড়া পজিটিভ সাইকোলজি এবং হিউম্যানিস্টিক সাইকোলজি নিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় সম্পাদনার কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য এই ঠিকানা ব্যবহার করা যেতে পারে- columns@whiteswanfoundation.org  

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org