আত্মনির্ভরশীল ব্যক্তিদের বিয়ে ও অভিভাবকত্ব
আমি আমার আগের প্রবন্ধে আত্মনির্ভরশীল পুরুষ ও মহিলাদের জীবনে বন্ধুত্ব ও প্রেমের বিষয় নিয়ে মাসলোর দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেছিলাম। এই প্রবন্ধে আত্মনির্ভরশীল মানুষের বিয়ে ও অভিভাবকত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আত্মনির্ভিরশীল মানুষ কি বিয়ে করে এবং দাম্পত্য সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কি তারা বজায় রাখতে পারে?
মাসলোর মতে মানুষের জীবনে একটা বিয়ে তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন সে তার জীবন থেকে অহংকার বা অহমিকাকে ত্যাগ করতে শেখে অথবা নিজের মতো করে নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলি মেটানোর ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রাখতে পারে। তবে মাসলো কখনোই বিশ্বাস করেন না যে বিয়ে হলেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবেগানুভূতির পূর্ণ বিকাশ ঘটে। সেক্ষেত্রে তাঁর মতে মাত্র ১ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক আমেরিকানকে (এর মধ্যে রয়েছেন ১৯৫০-১৯৬০ সালের মধ্যে বিয়ে হওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ) আত্মনির্ভরশীল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যাই হোক, আত্মনির্ভরশীলতার জন্য বিয়ে যথেষ্ঠ একটা মানদণ্ড না হলেও, অত্যাবশ্যক বা প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কারণ বিয়ের মধ্য দিয়েই মানুষের জীবনে কৌমার্য বা কুমারী অবস্থার অবসান হয়, বহুগামিতা প্রতিরোধ করা যায়, যা একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করা হয়।
মাসলো বলেছেন, আত্মনির্ভরশীল মানুষের মনে বিয়ের প্রতি বিরাট কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে। মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতার (পিক এক্সপেরিয়েন্সেস) উপর করা তাঁর গবেষণা থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে সঙ্গীরা একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে একটা আনন্দপূর্ণ ও অর্থবহ জীবনযাপন করে এবং সেই মুহূর্ত বা পরিস্থিতিটির প্রতি তারা কৃতজ্ঞ থাকে। উদাহরণস্বরূপ মাসলো বলেছেন যে, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে একদিকে যেমন দৈনন্দিন জীবনের মূল্যবোধের ক্ষয়কে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি এবং অন্যদিকে জীবনের মূল্যবান অভিজ্ঞতাগুলোকে আলোড়িত করতেও তা সাহায্য করে। একজন মানুষের জীবনে কৃতজ্ঞতার বোধকে আশীর্বাদ বলেই গ্রহণ করা দরকার। সেই সঙ্গে নিজেদের লাভ-লোকসানের কথা না ভেবে তারা যে কী অমূল্য সম্পদ পেল তাকেই সাধুবাদ দেওয়া জরুরি।
সেই যুগ থেকে কৃতজ্ঞতা সংক্রান্ত মাসলোর দৃষ্টিভঙ্গী বা ধারণা মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার জগতে একটা বিশিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছে। বারবার প্রমাণ হয়েছে যে সামাজিক সম্পর্কগুলো, যার মধ্যে বন্ধুত্ব ও প্রেমও রয়েছ, সেগুলোর স্থায়িত্ব রক্ষায় এবং সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। গবেষণায় দেখা গিয়েছে দাম্পত্য জীবনের কৃতজ্ঞতা যুক্ত থাকে মনের উদারতা বা সহৃদয়তার সঙ্গে, যা মানুষকে মারমুখী আচরণ এবং কুচুটে বা হিংসুটে মনোভাবাপন্ন হওয়া থেকে দূরে রাখে। বিবাহিত জীবনের অর্থনৈতিক দুর্দশা রোধ করতেও এই বিষয়গুলো সাহায্য করে।
অভিভাবক হিসেবে একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষ ঠিক কেমন হয়?
মাসলোর প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় তাঁর যেসব মন্তব্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই আত্মনির্ভরশীল মানুষের অভিভাবকত্বের বিষয়ে তাঁর একটা ধারণা পাওয়া যায়। মাসলো এবং তাঁর স্ত্রী বার্থার দুটো মেয়ে ছিল। এবং মাসলো নিজের চোখে তাঁর নাতনি জেন্নিকে জন্মাতে ও তার শৈশবস্থা দেখেন। নাতনির জন্মের পর মাসলোর যখন একটা বড় হার্ট অ্যাটাক হয়, তখন নাতনি কাছে থাকায় তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। এক দশক আগে তিনি তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্তিত্বের পার্থক্য লক্ষ করেছিলেন, এমনকী তাঁরা যখন গর্ভবতী ছিলেন তখনও সেই পার্থক্য তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। তা দেখে মাসলো নিশ্চিত হয়েছিলেন যে সত্যিকারের মানব-প্রকৃতির তত্ত্বের মধ্যে মানুষের জন্মগত দিকগুলি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেমন, তিনি বলেছিলেন, ''আত্মনির্ভরশীলতা মানে নিজের ব্যক্তিত্ব বা স্বকীয়তাকে বাস্তবায়িত করা। মানুষ মাটির ডেলা বা ট্যাবুলা রোসা নয়।''
অভিভাবক হিসেবে একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষের মেজাজ ঠিক কেমন হওয়া জরুরি? হায়ার মোটিভেশনের উপর করা তাঁর গবেষণায় মাসলো বলেছেন: ''বাচ্চাদের উপর অভিভাবকদের পর্যবেক্ষণ তাদের খুবই আনন্দ দেয় এবং তাদের একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে।'' অবশ্যই এই দুটি গুণ একে অপরের থেকে কিছুটা আলাদা। একজন অভিভাবক তার সন্তানকে একটু কঠিন হয়ে অথবা একটু নরম হয়ে মূল্যবোধ বা নীতিবোধের শিক্ষা চাপিয়ে দিতে পারেন, আবার মূল্যবোধ বা নীতিবোধের শিক্ষা তাদের একটু একটু করে না দিয়ে ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে খেলার ছলেও সেই শিক্ষা অভিভাবকরা তাদের দিতে পারেন। তবে মাসলো স্পষ্টভাবে একটা বিষয় জানাতে চেয়েছিলেন যে এই দুটো গুণের সঙ্গে আনন্দ ও মূল্যবোধ জড়িয়ে থাকে, যা একজন আত্মনির্ভরশীল অভিভাবকের কাছে বিপরীত বলে মনে হয় না বরং এক সূত্রে গাঁথা বলেই মনে হয়। মাসলোর মতে, আত্মনির্ভরশীল অভিভাবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে খুব আনন্দে থাকে এবং বাবা-মা মিলিতভাবে বাচ্চাদের সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে তাদের (মাসলোর ভাষায়) ''একজন ভালো মানুষ'' হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে।
মাসলো লক্ষ করেছিলেন যে আত্মনির্ভরশীল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অনন্য বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্রতি অত্যন্ত বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল হন। এইধরনের সংবেদনশীলতা বাচ্চাদের প্রতি সত্যিকারের মনঃসংযোগ করার থেকে জন্মায় (আজকের দিনে এদের সাবধানী বাবা-মা বা সতর্ক অভিভাবক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়)। মাসলোর মতে এই মনোযোগের কোনও বিকল্প নেই। মাসলো তাঁর ''টুওয়ার্ড আ হিউম্যানিস্টিক বায়োলজি'' নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ''একজন মা নিজের মনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য বাচ্চার প্রতি এতটাই মুগ্ধ ও স্নেহপরবশ হন যে তাকে বারবার খুঁটিয়ে দেখেও তার মনের আশা মেটে না। আক্ষরিক অর্থে মা তার বাচ্চার খুঁটিনাটি বিষয় জানতে শুধু যে নিজে উঠে-পড়ে লাগেন তা নয়, যিনি ওই বাচ্চাটির প্রতি আদৌ আগ্রহী নন তাকেও তিনি নিজের বাচ্চার প্রতি মনোযোগ দিতে একপ্রকার বাধ্য করেন।''
মাসলোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বন্ধু ডেভিড এম লেভি তাঁর আবিষ্কৃত প্লে থেরাপির সাহায্যে মাসলোকে তাঁর দুই মেয়ের প্রতি আনন্দ সহকারে চরম মনোযোগ দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই মাসলো তাঁর দুই মেয়ে অ্যান এবং এলেনকে তাদের পুতুলের কথা জিজ্ঞাসা করতেন, তারা আনন্দ পায় বা খুশি হয় এমন কাজ করতেন। এই কাজ তিনি তত বছর করেছিলেন যতদিন না মেয়েরা নিজেদের চিনতে শেখে এবং তিনি তাদের মধ্যে এই উপলব্ধি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন যে তারা নিজেদের ব্যক্তিসত্তা প্রকাশের মধ্য দিয়ে পুতুলের গল্পের আসল তাৎপর্য বুঝতে পারে।