নিজেকে নিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন

নিজেকে নিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন

Published on

একজন ব্যক্তিকে কোনও বন্ধু বা পরিবারের সদস্যর কথা উল্লেখ না করে, নিজের বিষয়ে বর্ণনা দেওয়ার কথা ভাবুন। শুধু নিজের উপর মনোনিবেশ করে, আপনি কি ভাবেন বা কি রকম আচরণ করেন, আপনার ক্ষমতা বা দুর্বলতা কী, কোন জিনিসটি আপনাকে রাগিয়ে তোলে বা কোন জিনিসটি আপনাকে খুশি করে তা বলার চেষ্টা করুন।

এই অনুশীলনটির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারব যে আমরা নিজেদের প্রতি কতখানি সচেতন। নিজের প্রতি সচেতনতা (নিজেকে জানা বা নিজের অন্তর্দর্শন করা) মানে নিজের ভাল, মন্দ, প্রয়োজন, ইচ্ছা, অসফলতা, অভ্যাস ইত্যাদি জিনিসগুলি বুঝতে পারা। পাশাপাশি কেন আপনি অন্য সকল ব্যক্তির থেকে আলাদা তাও বোঝা প্রয়োজন। আপনি যত নিজেকে বুঝতে পারবেন, ততই আপনি জীবনের পরিবর্তনগুলির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন। নিজেকে ভাল করে বুঝতে পারলে আমাদের নিজস্ব একটি পরিচয় তৈরি হয় যার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন আনতে পারি, বুঝতে পারি কোন জিনিসগুলি করতে আমরা দক্ষ এবং কোন জিনিসগুলির জন্য আমাদের আরও বেশি উন্নতি করতে হবে। লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হলে প্রথম পদক্ষেপ হল নিজের প্রতি সচেতন হওয়া।

গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে নিজের প্রতি সচেতন হলে মানুষ বুদ্ধিগত ও অনুভূতিগত ভাবে সাফল্য অর্জন করেন। এর মাধ্যমে আপনি আপনার ক্ষমতা, দুর্বলতা জানতে পারবেন যা আপনাকে আপনার লক্ষ্য পূরণ করতে সাহায্য করবে। আপনি আপনার ক্ষমতা, দক্ষতা ও পছন্দ অনুযায়ী সঠিক সময় সঠিক পথ ও সুযোগগুলি বেছে নিতে পারবেন। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের আচার আচরণে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসে যা আমাদেরকে নিজেদের সাফল্যের দিকে এগিয়ে দেবে।

একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞেরও নিজের প্রতি সচেতন হওয়া খুব জরুরি। তাঁরা বিভিন্ন ধর্মের, সংস্কৃতির, ভাষার, জীবনধারার মানুষদের নিয়ে কাজ করেন। তাঁদেরকে সঠিক ভাবে কাউন্সেলিং করতে হলে, একজন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন সবার আগে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে বোঝা ও সম্মান করা। একজন ভাল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ নিজের জ্ঞ্যানের বাইরে গিয়ে, নিজে অংশগ্রহণ করবেন একটি রোগীর চিকিৎসা করার জন্য, যা সহজ কোনও কাজ নয়।

একজন কাউন্সেলর যদি নিজের প্রতি সচেতন না হন, তাহলে কি হবে? নিজের প্রতি সচেতনতা না থাকলে একজন কাউন্সেলর তাঁর ক্লায়েন্টের সমস্যাগুলিকে নিজের সমস্যা বলে ভাবতে পারেন। ঘটনাটি উল্টোও হতে পারে। সচেতনতা না থাকলে তিনি ভাবতে পারেন যে সকলের তাঁরই মত সমস্যা রয়েছে। এই ভাবে একজন কাউন্সেলর নিজের সমস্যাগুলি তাঁর ক্লায়েন্টের মধ্যে খুঁজে পাবেন। কিন্তু একজন কাউন্সেলর যদি নিজের প্রতি সচেতন হন, তাহলে সে তাঁর নিজের একটি আলাদা গণ্ডি তৈরি করবেন, এবং তাঁর নিজের সমস্যা ও নিজের ক্লায়েন্টের সমস্যাকে আলাদা করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, নিজের প্রতি সচেতন হলে একজন কাউন্সেলর অনেক ভাবনাচিন্তা করে কাজ করতে পারবেন। এর ফলে তাঁরা আত্মবিশ্বাসের চিকিৎসা খুঁজে বার করতে পারবেন।

নিজের প্রতি সচেতন হলে আপনি বুঝতে পারবেন কি থেকে আপনার মধ্যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, এবং তা জানতে পারলে সেখান থেকে নিজেকে সামলানোর উপায়ও খুঁজে বার করতে পারবেন।

সাইকোথেরাপির প্রত্যেকটি বিভাগে নিজের সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর পদ্ধতি রয়েছে। আধুনিক সাইকোথেরাপি শুরু হয় সিগমন্ড ফ্রয়েডের সাইকোঅ্যানালিসিস ও মৌখিক চিকিৎসা দিয়ে। সাইকোঅ্যানালিসিসের মাধ্যমে মানুষের সচেতন মস্তিষ্কে চিন্তা ও স্মৃতির প্রবাহ নিয়ে তাঁদের সজাগ করা করা হয়।

একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট মানুষের স্বপ্নগুলির মানে খুঁজে বার করেন তাঁদের আবেগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে, যা অন্য ভাবে বোঝা সম্ভব নয়। বর্তমানে কগনিটিভ থেরাপিতে বৌদ্ধ ধর্মের নিরপেক্ষ কিছু অংশবিশেষ শেখানো হয়। মনোনিবেশ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে মানুষ নিজের মূল্যবোধ অনুযায়ী কাজ করে। কোনও সমস্যা থেকে পালানোর চেষ্টা করে না। নিজের উপর বিশ্বাস বাড়াতে ক্লায়েন্টদেরকে নিজেদের শ্বাস প্রশ্বাসের উপর লক্ষ্য রাখা বা অঙ্গ সঞ্চালনের প্রতি খেয়াল রাখতে বলা হয়। লোকের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা না করে জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতে শেখানো হয়। ক্লায়েন্টদের মনমেজাজ, ভাবনাচিন্তা, অনুভূতি ও কঠিন সময়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়ার একটি হিসাব রাখার জন্য তাঁদেরকে ডাইরি লিখতে বলা হয়। এই ডাইরি লেখা কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি’র (সিবিটি) অন্তর্গত। এর পর ক্লায়েন্টদের পরিস্থিতি অনুসারে নিজের ধারণা ও বিশ্বাস ভদলাতে উৎসাহ দেওয়া হয়। ফলে তাঁরা অসহায়তা ও ভগ্ন আশা থেকে জন্ম নেওয়া দুশ্চিন্তা এবং হতাশাকে কমাতে পারেন।

আপনি যদি একজন চিকিৎসক হন, তা হলে নিচে লেখা পদ্ধতিগুলি আপনার ক্লায়েন্টকে নিজের প্রতি সচেতন হতে সাহায্য করবে:

  • জার্নাল লেখা, যেখানে একজন ব্যক্তি নিজের চিকিৎসার বাইরের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখবেন। এর ফলে চিকিৎসা আরও কার্যকরী হতে পারে।

  • বই চিকিৎসা, যেখানে একজন ব্যক্তি তাঁর চিকিৎসকের পরাআমর্শ অনুযায়ী বই পড়বেন, বিশেষ করে নিজেকে সাহায্য করার জন্য যে বইগুলি লেখা হয়।

  • শিল্পকলা নির্ভর চিকিৎসা এবং বালির ট্রে, যার মাধ্যমে একজন তাঁর শৈশবের কল্পনা দিয়ে নানা রকম আকার ও ছবি বানাতে পারবেন এবং নিজেকে আরও ভাল ভাবে চিনতে পারবেন।

  • জন কাবাট জিনের শেখানো মাইন্ডফুলনেস-বেসড্‌ স্ট্রেস রিডাকশন (এম বি এস আর), যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে।

  • ধ্যানের ক্লাস করা, বিশেষ করে সেগুলি যেখানে মনোনিবেশ করার ধ্যান যেমন সমতা বা বিপাসনা শেখানো হয়।

  • দলগত চিকিৎসা, যেখানে একই ধরণের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যাক্তির মতামত শুনে আরেকজন ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ে। এই রকম চিকিৎসা মাঝেমাঝে একটি চিকিৎসক বা দলের সামনেই করা হয়।

একজন ব্যক্তি যে তাঁর নিজের বিষয়ে সচেতন, তিনি একটি শক্তিশালী চিকিৎসাগত সম্পর্ক গড়ে তোলার সঙ্গে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি তাঁকে আরও সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করে।

নিজের বিষয়ে সচেতন হলে, একজন ব্যক্তি নিজের চরিত্রের শক্তি ও দুর্বলতাগুলি বুঝতে পারবেন। এর ফলে আমরা নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে পারব এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারব। নিজের প্রতি সচেতন হওয়া কোনও বইয়ের মাধ্যমে শেখা যায় না, এটি শেখা যায় নিজের সম্পর্কে জেনে এবং নিজের সিদ্ধান্ত, আচরণ, অন্য মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তার ধরণগুলিকে মন দিয়ে উপলব্ধি করে।

নিজেকে কিছু প্রশ্ন করে, নিজের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করুন:

  • আপনার তিনটি ক্ষমতা ও তিনটি দুর্বলতা বিচার করুন।

  • আপনি কোন জিনিসকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন?

  • যা একজন করতে পারেন এবং যা একজন করতে পারেন না, তার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বার করুন

  • কোন অনুভুতিটি আপনি অন্যদের চেয়ে বেশি উপলব্ধি করেন?

  • কিসের জন্য আপনার মধ্যে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা জন্ম নেয়।

  • চাপে পড়লে আপনি কি করেন?

  • জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে আপনার কেমন লাগে? (উদাহরন: বোন, ছাত্রী, প্রিয় বন্ধু, কর্মী, ক্রীড়াবিদ ও ইত্যাদি)

সূত্র

  • সেলিগম্যান, এম. ই. পি (১৯৯৫)। দ্য এফেক্টিভনেস অফ সাইকোথেরাপি: দ্য কনজিউমার রিপোর্টস স্টাডি ইন আমেরিকান সাইকোলজিস্ট, ডিসেম্বর ১৯৯৫ পঞ্চদশ সংখ্যা, নম্বর ১২, পৃষ্ঠা ৯৬৫-৯৭৪। পুনঃপ্রকাশিত ডিসেম্বর ১৬, ২০০৮ http://tinyurl.com/dn3ofg

  • ক্রিস্টোফার, জে. সি., ক্রিস্টোফার, এস. ই., ডুন্নাগন, টি., এবং সিউর, এম. (২০০৬)। টিচিং সেলফ্‌কেয়ার থ্রু মাইন্ডফুল প্র্যাক্টিসেস দ্য অ্যাপলিকেশন অফ যোগা, মেডিটেশন, অ্যান্ড কুইগং টু কাউন্সেলর ট্রেনিং। জার্নাল অফ হিউম্যানিস্টিক সাইকোলজি, ৪৬, ৪৯৪-৫০৯। ডি ও আই: ১০.১১৭৭/০০২২১৬৭৮০৬২৯০২১৫

  • http://www.counseling.org/docs/default-source/vistas/article_30.pdf

ডাঃ গরিমা শ্রীবাস্তব দিল্লীতে কর্মরত একজন ক্লিনিক্যাল সাইকলজিস্ট। তিনি অল ইন্ডিয়া ইন্সিটিউট অফ মেডিক্যাল সাইন্স থেকে পি এইচ ডি করেছেন।

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org