সময়ের সমৃদ্ধি: ভাল থাকার চাবিকাঠি

সময়ের সমৃদ্ধি: ভাল থাকার চাবিকাঠি

ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানীরা ইদানীংকালে এমন অনেক ধরণের বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করছেন যা আমাদের ভাবনাত্মক সুস্থতার জন্য দায়ী – এবং এর মধ্যে সব থেকে বেশি মুগ্ধ করে সময়ের সাথে আমাদের সম্পর্ক। বিশেষ করে সময়ের অবিরাম প্রবাহের সাথে আমরা যে পর্যায়ে সুখানুভূতি – অথবা তাড়া এবং চাপ অনুভব করি – একটি ক্রমাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়, যা আমাদের মানসিক এবং সম্ভবত শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী দেশগুলির সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে উঠছে, এবং আমাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন সময় অঞ্চলের এপার-ওপারে যোগাযোগ বজায় রাখি, যাকে এখন সময়ের সমৃদ্ধি বলা হচ্ছে, এই বিষয়টির গুরুত্ব বেড়ে চলেছে।

অন্যভাবে দেখলে অবশ্য এই বিষয়টি নতুন নয়। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চাশেরও বেশি বছর আগে, ইলিয়নর রুজভেল্ট - আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের স্ত্রী এবং জনগনের প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর পরে একটি যুবকদের উদ্দেশ্য করে একটি জনপ্রিয় বই লেখেন। বইটির শীর্ষক ছিল “লার্‌ন বাই লিভিং”, এবং এতে তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং কৃতিত্ব, অধ্যয়ন ও নিয়মানুবর্তিতা এবং আন্তরিক সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার মতো বিবিধ বিষয়ে নিজের যুক্তিসম্পন্ন দৃঢ় ধারণার কথা লেখেন। এবং, বিশেষত সময়ের ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ আলোচনায় শ্রীমতী রুজভেল্ট বলেছেন, “আমাদের সবার কাছেই সমান সময় রয়েছে। আপনাকে কেউ বলে দিতে পারবে না যে কীভাবে সময় ব্যবহার করবেন। সময়টি আপনার।”

১৯৬০-এ প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীমতী রুজভেল্টের বইটি যখন একটি সাধারণ কাজের দিনে মধ্যাহ্নভোজে দুঘণ্টা সময় ব্যয় করা স্বাভাবিক ছিল – আর ভবিষ্যৎবাদীরা চিন্তিত ছিলেন যে মার্কিন মুলুকের বাসীরা নিজেদের বিস্তর অবসর সময় কীভাবে কাটাবেন। কর্মক্ষেত্রে এবং ঘরে স্বয়ংক্রিয়তার দৌলতে বেশীরভাগ সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন যে বেকারত্ব আর ঘরোয়া গোলামির অবসান ঘটবে। এই মত অনুযায়ী, এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে নিজের অভিরুচি অনুযায়ী শখ পূর্ণ করার প্রচুর সুযোগ থাকবে। এবং সত্যিই ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সমাজবিজ্ঞানীরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন যে এতটা অবসর সময়ের সদব্যবহার আমেরিকানরা (এবং পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশের মানুষেরা) নিজেদের এবং সমাজদের জন্য উৎপাদনমূলক কাজে ব্যয় করতে পারবেন – নাকি টিভি দেখা, মদ খাওয়া, জুয়া খেলার মতো উদ্দেশ্যহীন কাজে নষ্ট করবেন।

এখনকার সময়ে পৌঁছে ওই ভবিষ্যৎবাণীকে হাস্যকর মনে হচ্ছে। যদিও অবসর সময় নিয়ে আকাশকুসুম পরিকল্পনা আরও কয়েক দশক ধরে চলেছিল, বিশেষজ্ঞরা ধীরেধীরে তাদের মত পরিবর্তন করেছেন। ১৯৮১ সালেই মার্কিনী মনোবিজ্ঞানী ডেভিড এল্কাইন্ড তাঁর লেখা বই ‘দা হারিড চাইল্ড’-এ সচেতনবার্তা দিয়েছিলেন যে বাচ্চাদের এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি তাড়ার মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এর ফলে তাদের সৃজনশীলতা এবং কল্পনাশক্তি প্রভাবিত হচ্ছে। এর এক দশক পরে, ভবিষ্যৎএর ছবি এতটাই পাল্টে গিয়েছিল যে সমাজবিজ্ঞানী জুলিয়াট শোরের বই ‘দা ওভারওয়ার্কড অ্যামেরিকানঃ দা আনএক্সপেক্টেড ডিক্লাইন অফ লেজার’এর মতো অনেক বই প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল – কিন্তু গবেষণামূলক তথ্যের অভাব ছিল।

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ডঃ লেজলি পারলো সমাজবিজ্ঞানীদের সেই প্রথম দলের মধ্যে একজন যারা এই সমস্যাটির পরিমাণ অনুসন্ধান করেন – এবং ১৯৯৯-এর তাঁর বর্ণনাকারী সময়ের দুর্ভিক্ষ পেশাদারী জগতে আলোড়ন ফেলে দেয়। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের এমন একটি দলকে নিয়ে গবেষণা করা হয় যাদের সব সময় মনে হত যে তাদের প্রচুর কাজ করতে হচ্ছে এবং তাদের কাছে যথেষ্ট সময় নেই। ডঃ পারলোর দৃঢ় মত যে সংগঠনগুলি তাদের কর্মীদের উৎপাদনশীলতা আসলে কম করে দিচ্ছে তাদের ‘দ্রুত-গতি, উচ্চতর-চাপ এবং সঙ্কটপূর্ণ” পরিস্থিতিতে সারাক্ষণ রেখে। তিনি জানান “কর্পোরেট আইনজীবী, ব্যাঙ্কের বিনিয়োগ বিভাগের কর্মী, কম্পিউটার প্রোগ্রামার্স এবং এমন অনেক কর্মীরা নিয়মিতভাবে সপ্তাহে ৭০ থেকে ৮০ঘন্টা কাজ করেন; এবং ব্যস্ততার সময় আরও বেশি মাত্রায় কাজ করেন। এই মহিলা এবং পুরুষেরা, বিবাহিত এবং অবিবাহিত, মানসিক চাপ আর ক্লান্তিতে ভরা, এবং কিছুজন এমন চরম সময়সূচীর কারণে মারা যাচ্ছেন। কাজের জায়গায় এবং কাজের বাইরের জীবনে তাদের কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করা হয় সবকিছুর জন্য তাদের কাছে সময় অপর্যাপ্ত।” ডঃ পারলো আরও বলেন যে সংগঠনের কর্তারা যন্ত্রমানবের বদলে যদি আদতেও সৃজনশীল কর্মী চান, তাহলে আরও বেশি অবসর সময় প্রয়োজন। ইদানীং সময়ে মার্কিনী মনোবিজ্ঞানী টিম কেস্‌সার এবং কেনেথ শেল্ডন সময় সমৃদ্ধির ধারণাটি বিকশিত করেছেনঃ হাতে প্রচুর অবসর সময় থাকার ব্যক্তির নিয়মিত অনুভূতি। চারটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে তাঁরা জেনেছেন যে ধনকে সম্ভাব্য গুণক রূপে নিয়ন্ত্রিত করা সত্ত্বেও, একজন ব্যক্তির সময়ের সমৃদ্ধির সাথে তার বৃহত্তর সুখ জড়িত। আশ্চর্য ব্যাপার যে যাদের জীবনে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সময়ের সমৃদ্ধি অনুভব করেবেন। গবেষণার থেকে পাওয়া এমন তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে সময়ের সমৃদ্ধি আমাদের শারীরিক আর মানসিক সুস্থতা, এবং পরিবার আর বন্ধুবান্ধবদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপকারী।

এই মতের উপর আরও কাজ করে হওয়ারটন স্কুল অফ বিজনেসের ডঃ কেসি মলিগ্নার এবং তাঁর সহকর্মীরা দেখেছেন যে – বিপরীত ধারার মনে হলেও – আমাদের সময় সমৃদ্ধির ভাব বেড়ে যায় যখন আমরা সদয়ভাবে অন্যদের উপর সময় ব্যয় করি। এটা কী করে সম্ভব? তাঁদের মতে, এমন পরার্থপর ব্যবহার আমার আত্মসম্মান আর আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তোলে – এবং এতে আমার মনে সময়ের বিস্তার বেড়ে যায়। অবশেষে, সমস্ত ব্যস্ততা সত্ত্বেও, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আমাদের যোগদান করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে একটি ফলোআপ প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “সময় যত দান করবেন তত কম তাড়া অনুভব করবেন।”

বিশেষজ্ঞরা কীভাবে সময় সমৃদ্ধির লাভ করেন? ডঃ কেস্‌সার একজন বিবাহিত পুরুষ এবং তিনি দুটি টিনেজার ছেলের বাবা। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান “প্রায় প্রত্যেক বছর আমি আমার কলেজের সাথে এমন বোঝাপড়া করেছি যাতে আমাকে তিন ভাগের দুভাগ বা চার ভাগের তিন ভাগ সময় কাজ করতে পারি এবং এর জন্য তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম পারিশ্রমিক নিই। ১২ বছর ধরে আমার স্ত্রী অর্ধেক দিন কাজ করছেন এবং কখনই বছরে ৩০ সপ্তাহের বেশি কাজ করেন না। এই নির্ণয়গুলি আমরা আমাদের ছেলেদের, সামাজিক কাজে, একেওপরকে আর নিজেদের বেশি সময় দেওয়ার জন্য নিয়েছি।”

এটি একটি প্রশংসনীয় জীবনধারা সিদ্ধান্ত, এবং এমন সিদ্ধান্ত যা তাদের ছেলেরা লালন করবে তখন যখন তারা নিজেরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে নিজস্ব সংসার স্থাপন করবে।

নির্দেশিত কার্য

আপনি যদি বিশ্বের যেকোনো দেশের কোনও একটি শহরের নিবাসী হন তাহলে খুব সম্ভবত গত এক বছরে আপনি সময়ের দুর্ভিক্ষ অনুভব করেছেন। কী করবেন? সময়ের সমৃদ্ধি আর পরবর্তী মানসিক ভাল-থাকা বৃদ্ধির জন্য আমি আপনাকে পরামর্শ দেব যে সপ্তাহে আপনার হাতে যতটুকু সময় আছে সেটাকে আপনি উদার ভাবে ব্যয় করুন। সাপ্তাহিক রুটিনে এমন কাজ রাখুন যাতে অন্যদের উপকার হবে – সে আপনার পরিবারের সদস্য, বন্ধু, বা সমাজের অন্তর্ভুক্ত যে কেউ হতে পারে। সেচ্ছাসেবী রূপে কাজ করলে আপনার মনে হবে সময়ের বিস্তার বেড়ে গিয়েছে – তাই এটি খুঁজে নিন। দুল্কিচালে হাঁটুন, দৌড়াবেন না। যেমন ব্রিটিশ লেখক জে আর আর টল্কিন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস লর্ড্‌স অফ দা রিংস-এ বলেছেন “যারা ঘুরে বেড়ায় তারা সবাই হারিয়ে যায়নি”। মনে রাখবেন, সময়কে যত হাত খুলে খরচা করবেন, তত বেশি সময় আপনি নিজের জীবনে খুঁজে পাবেন।

ডাঃ এডওয়ার্ড হফ্‌ম্যান নিউ ইয়র্কে ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যক্ষ। তাছাড়া উনি একজন অনুমোদিত মনোচিকিৎসক। মনোবিজ্ঞান জগতে ওঁনার সম্পাদিত এবং লেখা ২৫টিরও বেশী বই আছে। সম্প্রতি ডাঃ উইলিয়াম কম্পটন রচিত পজিটিভ সাইকোলজি: দ্য সায়েন্স অফ্‌ হ্যাপিনেস অ্যান্ড ফ্লারিশিং বইটিতে সহলেখকের ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া উনি ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ্‌ পজিটিভ সাইকোলজি এবং জার্নাল অফ্‌ হিউম্যানিস্টক সাইকোলজি’র সম্পাদক মণ্ডলীর অন্তর্গত। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন।          

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org